Monday 30 January 2017

প্রচ্ছদ নিবন্ধ – ৩
...........................................................................................................................
শীত – একটা নস্টালজিয়ার কঙ্কাল
স্পন্দন চট্টোপাধ্যায়
মোটামুটি প্রতিবছরই এই নভেম্বরের শেষ দিকটা থেকে তল্পিতল্পা, বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে দোরগোড়ায় এসে হাজির হয় আহাম্মকটা। যেতে যেতে তার সেই ফেব্রুয়ারীর মাঝখান পার করে তিনকাল গড়িয়ে এককালে ঠেকে প্রায়। আর, সে এত বড়ই নির্বোধ, বোঝেও না যে, এই বিশ্বায়নের অসীমে, দুর্বার সুপারসনিক গতির ঝিকমিক চুমকি বসানো জীবনে, ঐ আলস্য আর বেড়ালের মত চুপটি করে আরামে চোখ বুজে শুয়ে থেকে পিঠে রোদ পুহিয়ে নেওয়া স্রেফ আর চলেনা। তোমরা, প্রতিটি মনুষ্যশিশুই, পৃথিবীতে জন্মেছ, জন্মাচ্ছ আর জন্মাবেও শুধুমাত্রই ছোটার জন্য। হ্যাঁ ঠিক আছে, এক্কেবারে প্রথম যে-কটা বছর হামা দিচ্ছ, হাঁটতে শেখোনি, সে সময়টুকু ক্ষমা-ঘেন্না করে দেওয়া যাবে’খন, কিন্তু একবার হাঁটতে শিখে গেলে আর থামা নয় ভাই। হাঁটো হাঁটো... হ্যাঁ ঠিক আছে, স্পিড বাড়াও এবার... চলো আর একটু জোরে... আরও জোরে... চলো ভাই ছোটো... ফাস্ট ফাস্ট... থামবে না। এই তুমি কে ভাই বসলে? জিরোবে পরে। আসল কথা হল, জিরোবেই না। একদম সেই ইহজগতের মায়া-ফায়া ত্যাগ করলে তবে বিশ্রাম। তার আগে আবার রেস্ট কি? মোটামুটি এইটে হল গিয়ে ছকটা। মানে ওপর থেকে জীবনের একখানা স্যাটেলাইট ভিউ নিলে এটাই দাঁড়াবে।
তা মোটামুটি এটাই হল যেখানে ব্লু-প্রিন্ট, সেখানে যে-কোন মানুষ, মনুষ্যেতর প্রাণী, জড়পদার্থ, অভ্যেস যাই আলস্য নিয়ে আসুক না কেন, সে আহাম্মক ছাড়া কি! আর শুধু আহাম্মকই নয়। জাত শত্তুর। দেখবেন, শীতকাল পছন্দও করে কারা? অলসরাই কিন্তু। বিছানাটাকেই মোটামুটি আইসল্যান্ড বানিয়ে লেপটাকে ইগলু বানিয়ে ফেলে তার মধ্যেই বসবাস যাদের। যদিও বা বেরোনো, সেও সোয়েটার, জ্যাকেট, গ্লাভস, টুপির বর্ম সমেত। আর একটু কবিতা-টবিতা লেখার আঁতলামি থাকলে, কিম্বা ফালতু গল্পের বই-টই পড়ে সময় নষ্ট করার বদভ্যেস থাকলে তো কথাই নেই। ওদের চেয়ে ভালো শীতকে আর কে বাসে! বিছানায় লেপ জড়িয়ে বসে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে কিম্বা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে গুরুগম্ভীর তত্ত্ব কপচানো আর কবিতার লাইন আওড়ানো। আর এক রকমের প্রাণীও আছে বটে যারা শীতকাল ভালোবাসে। যদিও তারাও বেশ বিলুপ্তপ্রায় এখনই। মেঘ না-ডাকা পর্যন্ত গোসাপের কামড়ে পড়ে থাকার মত সেই আদ্যিকালের বনেদিয়ানার গায়ে এখনও এঁটুলির মত লেগে থাকা কিছু সাবেকি জয়েন্ট ফ্যামিলি। কিছু সোঁদা শ্যাওলা গন্ধের পুরোনো আমলের লোক। বিষ পুরো এগুলো। পলেস্তারা খসে খসে পড়ে যাচ্ছে, বটের শেকড়-ফেকড় ছড়িয়ে গিয়ে দেওয়াল হেলিয়ে দিচ্ছে, তবু সে বাড়িতেই থাকবে। দুপুরবেলা বারান্দায় রোদে বসে গায়ে ভালো করে তেল মাখবে, গা-হাত-পা ডলবে, খেয়েদেয়ে সবাই মিলে ছাদে উঠবে, তারপর মাদুর পেতে বসে কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে রোদ পোহাতে পোহাতে সবাই গুলতানি মারতে মারতে লেবু খাবে। সে যেন শ্রীকৃষ্ণের দেওয়া কমলালেবু। কোয়া আর শেষই হয়না। ছ্যাঃ। এভাবে কেউ সময় নষ্ট করে!
হ্যাঁ মশাই, সময় নষ্টই। তা ছাড়া আর কি! সব সময় নেগেটিভ দিকটাই দেখবেন না তো বিশ্বায়নের। আমাদের এই গ্লোবালাইজেশানের শিক্ষাটাই হল, চোখের সামনে যা কিছু আছে সেটাকেই পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করো। আর সময়ের মত এমন নিরবিচ্ছিন্ন কাঁচামাল কি আছে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে? কাজেই, সময়টাকে বিশ্বায়নের মিক্সিতে ফেলে তাকে ছেকড়ে ঘেঁটে নাড়িয়ে ছিঁড়ে পিষে নিয়ে নির্যাস্টুকু বের করে মুনাফা করে নাও যতটা পারো। যতক্ষণ নিঃশ্বাস আছে। আর, মুনাফা মানে কিন্তু তোমাদের জ্ঞানজ্ঞম্যি, চোখে চশমা আঁটা মণ-মণ ওজনের ভারী ভারী দর্শন নয়, ভাইরা। মুনাফা মানে একটাই। জিডিপি। ফোর্বস লিস্ট। বছরে কত প্যাকেজ। ইটালিয়ান মার্বেল। আর কিছু না। আর কিচ্ছু হতে পারেনা। আর এই তামাম উন্নত মানসিকতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল আলিস্যি, যেটা বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, কড়াইশুঁটি, বেগুন, পাটালি গুড়, জয়নগরের মোয়ার মতই শীতের একখানা বাইপ্রোডাক্ট।
কাজেই, শত্তুরের সাথে যা করা উচিৎ, আমরা, এই মুক্ত বাজার অর্থনীতিও, তাই করেছি শীতের সঙ্গে। তবে খুব আস্তে আস্তে। স্লো-পয়জনিং। যাতে সেভাবে কেউ টের না-পায়। এরম করতে করতে একদিন কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে খেতে খেতে শেষ কোয়াটায় গিয়ে পৌঁছে হঠাৎ মুখটা তুলে দেখবেন, মাল হাপিস। স্রেফ ‘নেই’ করে দিয়েছি শীত বলে কনসেপ্টটা। এখনই অনেকটা করা হয়ে গেছে। আজ থেকে পাঁচ-দশ বছর আগেও যতটা জাঁকিয়ে পড়ত ও-জিনিষ, এখন আর পড়ে? হুঁ হুঁ বাওয়া, তরতর করে দশ-কুড়ি-পঞ্চাশ-একশো-দেড়শো তলার সাঁ-সাঁ সব বুর্জ খলিফা উঠে যাচ্ছে, শিল্পায়ন হচ্ছে, বড় বড় কারখানা বসছে জঙ্গল পুড়িয়ে, এক সেকেন্ডের একশো কোটি ভাগের মধ্যে তোমার মেসেজ আমস্টারডাম থেকে আদিসপ্তগ্রাম চলে যাচ্ছে...  অত তাড়াতাড়ি বোধহয় একটা গোটা আর্টপেপার সাইজের পৃথিবীর ম্যাপের ওপর আমস্টারডাম্‌ টু আদিসপ্তগ্রাম আঁকও কাটা যায়না। তা, তার জন্য একটুখানি শীত আপোষ করা যাবে না?
তথ্য বলছে, গত দশ বছরে শীত প্রায় হাফ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গেছে আমাদের পৃথিবীতে। ২০০০ থেকে ২০১০, এই দশকটা পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম দশক বলে চিহ্নিত হয়েছে, কেননা, এই দশ বছরের মধ্যেই এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের উষ্ণতম আটটা বছর রয়েছে। সৌজন্যে, এই ভূপৃষ্ঠের ওপর হেঁটে চলে বেড়ানো সর্বশ্রেষ্ঠ জাত।
অথচ, শীত কিন্তু কারও বাড়া ভাতে ছাই দেয়নি। সে খানিক স্লথ গতির একাকী অভিমানী বৃদ্ধের মতই পড়ে আসা বিকেলের আলোয় পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকে প্রতিবছর। তারপর সময় ফুরিয়ে এলে সব গুছিয়ে নিয়ে চলে যায়। সে তো দেখেছে, কিভাবে তারই পাশের বেঞ্চিতে একসময় এসে বসত হেমন্ত। ক্রমে ক্রমে সেও উঠে গেছে অনেকদিন হল। এখন আর আসেনা। কিম্বা আসলেও বোঝা যায় না তেমন। একটা ঠান্ডা চাহনির ওয়ার্নিং তাই সব সময়েই রয়েছে শীতের দিকে।
কাজেই শীতকাল নিয়ে ঐ চাদরে চলকে পড়া চায়ের দাগের মত একটু নস্টালজিয়া আর স্মৃতিরোমন্থনই শুধু পড়ে আছে এখন। সেই যে অনেকবছর আগে কবীর সুমন বর্ষার গান বাঁধতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘এসো, করো স্নান নবধারাজলে বলবে কে আর? / রিয়েল এস্টেট শোনে কি কখনও মেঘমল্লার?’ আসলে শীতের অবস্থাও কতকটা তেমনই হয়েছে এখন। কেউ শোনেনা। রিয়েল এস্টেট, শিল্পায়ন, মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে মঙ্গল-শনি-প্লুটো হাঁটকে প্রাণ খোঁজা, দুরন্ত ইন্টারনেট, বুর্জ-খলিফা, স্মার্টফোন, সেন্ট্রাল এসি, প্রফেশানালিজ্‌ম্‌, খোলা বাজার... কেউ না। কেউ ছাদে বসে রুটি বেগুনভাজা খায়না, কমলালেবু খায়না, পাটিসাপটার জন্য বায়না করেনা, গড়চুমুকে পরিযায়ী দেখতে যায়না, রান্নাঘরে বসে মা-কে কড়াইশুঁটির খোসা ছাড়িয়ে দেয়না, পাটালি গুড়ের গন্ধে পাগল হয়না, সবাই মিলে পিকনিক করেনা, বান্ধবীর সাথে চিড়িয়াখানা যায়না, যাদুঘর ঘোরেনা... কিচ্ছু করেনা।
শীতকে আসলে আমরা মূল্যায়নই করতে পারিনি ঠিক করে। শীত একটা ঋতু তো বটেই, তবে তারও ওপরে, সে একটা বোধ নিয়ে আসে। যে বোধ বলে, শুধু ছোটাছুটিই নয় গোটা জীবনটা। খানিক থিতু হয়ে বসে জগতের নির্যাস টুকু নেওয়াও জীবনের বড় আংশ একটা। আর, আরও একটা যে বড় শিক্ষা দিয়ে যায় শীত, তা হল, পুরোনোকে নতুন আসার আনন্দে স্বচ্ছন্দে যেতে দেওয়ার শিক্ষা। আমরা, এই মনুষ্য জাতিটা অনুধাবনই করতে পারলাম না, শুধু যাওয়া আসা আর শুধু স্রোতে ভাসা নিয়ে যে জীবনটা, সেখানে এমন একখানা চ্যাপ্টার এত সহজে পড়িয়ে দেওয়ার জন্য শীতের মত শিক্ষক আর কে আছে!

No comments:

Post a Comment