Friday 10 March 2017

বার্ণিক ...
( বর্ণশিল্পীর ক্যানভাস  )
ফেব্রুয়ারী- মার্চ সংখ্যা  , ২০১৭ ।।
( নতুন পর্যায়, পরিবর্তিত নামে প্রথম সংখ্যা)
দ্বিতীয়  সংখ্যা  ** নবম বর্ষ ** ২০১৭ ।।
............................................................................................................
লেখা পাঠাতে হলেঃ
Word  ফাইলে যে কোন লেখা পাঠাতে পারেন amdrbarnik@gmail.com আই-ডি  তে ।
বিষয়ভিত্তিক লেখা পাঠাতে আমাদের ফেসবুক পেজে নজর থাকুক – www.facebook.com/ বার্ণিক প্রকাশন
অথবা whatsapp / call – 8391058501
টিম বার্ণিকঃ
শিশির চন্দ, রুমকি রায় দত্ত, সন্দীপ মণ্ডল, ইন্দ্রনীল বক্সী , ইমরাজ হাসান, তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্য রায় , সায়ন্তন মাইতি  ও মধুসূদন রায় ।।
.....................................................................................................................

লিখেছেন যারা ----------------------------------
*******************************************************
বসন্ত বিষয়ক গদ্য -
লিখেছেন – চমক মজুমদার, অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায়, নীপবিথি ভৌমিক, বৈশাখী রায় চৌধুরী, শুভদীপ ঘোষ, মুনমুন সিংহ ও রুমকি রায় দত্ত ।
কবিতা –
লিখেছেন – চয়ন ভৌমিক, দীপ রায়, ইমরাজ হাসান, পৌলমী দাম, অনুক্তা ঘোষাল, অচিন্ত্য রায়, সুজিত মান্না, পিন্তু পাল, শ্যামল দত্ত, শৈলেন চৌনি, তন্তু ঘোষ, পারমিতা রায় ।
গল্প – রূপক সান্যাল, অনিন্দিতা মণ্ডল, প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ , রাণা পাণ্ডা, অভিজিৎ মান্না, সুমন কান্তি দাস, শুভঙ্কর দে, সৌরভ নায়ক ও শুভঙ্কর চৌধুরী ।
অণুগল্প – ধরিত্রী গোস্বামী, পরিমল হাসদা, শুভ্র, বিধান শীল ও বর্ণালি সেন ।
বসন্ত বিষয়ক গদ্য .................................................................................................................................................................................


পাতিকাক ও বসন্তের গল্প
--চমক



যে জানালাটার পাশে ছোটবেলায় পড়তে বসতাম, তার পাশেই ছিল একটা ঝাকড়া নিমগাছ। মাঝে মাঝেই একটা কাক করুণ স্বরে ডেকে উঠতো মগডালের বাসা থেকে। আমিও কেসি নাগের উপপাদ্য, পিকে দে সরকারের গ্রামার, সিআরডিজি’র আলো ফেলে তাকিয়ে থাকতাম ওর দিকে। সামান্য একটা কাক, পাতিকাক, কিন্তু কী করুন এক আর্তি ছিল সেই ডাকে। একটা হাহাকার ছিল—যা উথাল পাথাল করে দিত আমার পড়াশুনো। সেই হাহাকারের কারণ খুঁজে পাইনি তখন। সেই কাকের নাম পাতিকাক কেন হয়েছে জানি না। হয়তো কাকের সংসারে ‘পাতি’ বা গুরুত্বহীন বলেই হয়তো এই নাম। দাঁড়কাকের গুরুত্ব বা ওজন নিশ্চয় বেশি ছিল। তার স্বরের গভীরতা থেকেই তা আন্দাজ করা যেত। ছোটবেলায় আমি কখনও কোকিল দেখিনি। দেখলেও হয়তো চিনতে পারিনি, দাঁড়কাক ভেবেই হয়তো ভুল করেছি। কিন্তু শীত শেষ হতে না হতেই তার কুহকিনী ডাক বহু শুনেছি। নব্বই দশকের শেষে আমাদের মফস্বল হতে চাওয়া গ্রামটায় প্রচুর গাছপালা ছিল। সেই সব গাছের মাঝে কোথা থেকে কোকিলের কুহকিনী সুর ভেসে আসতো বুঝতেই পারতাম না। পাতিকাকের কান্না শুনে জানলা দিয়ে তাকাতেই নিমগাছের মগডালে দিব্যি ওকে দেখতে পেতাম। কিন্তু কিছুতেই কোকিলকে দেখা যেত না।
আরো ছোটবেলায় থাকতাম কলকাতার একদম দক্ষিণপ্রান্তে। আমার মা আর অবিবাহিত পিসিদের দারুন সিনেমা দেখার নেশা ছিল। সুযোগ পেলেই তারা পাড়ার কিছু বন্ধুবান্ধবদের সাথে দলবেঁধে আসেপাশের পদ্মশ্রী, বান্টি বা মহুয়ায় ম্যাটিনি বা ইভিনিং শো দেখতে চলে যেত। আর সুযোগ না হলে? কুছ পরোয়া নেহি! বাড়িতে তো নতুন সোনোডাইন টিভি আছেই। তখন টিভিতে একটাই চ্যানেল—দূরদর্শন। তাও ঘড়ি ধরে টেলিকাস্ট, বাকি সময় ঝিরঝির। প্রতি শনি-রবিবার বিকেলে সিনেমা দেখাতো সেই চ্যানেলে। পাগলা খাবি কি! এই সুযোগ কেউ ছাড়ে। দল বেঁধে বসে পড়ত সবাই। এখনকার মতো বাড়িতে বাড়িতে টিভির চল ছিলো না তখন। পাড়াতে একটা বা দুটো বাড়িতেই তখন টিভি। রবিবার আমাদের বাড়িতে পুরো পাড়া ভেঙে পড়তো। সকালে বিআর চোপড়ার মহাভারত আর বিকেলে সিনেমা। এমনই এক বিকেলবেলা মা-পিসিদের পাশে বসে প্রথম দেখেছিলাম—বসন্ত বিলাপ। অত ছোট বয়েসে কী বুঝেছিলাম জানিনা, কিন্তু মনে আছে পাড়ার চন্দনা পিসি, লাল্টু কাকাদের সাথে বসে দারুন হেসেছিলাম। তারপর থেকে আজও টিভিতে বসন্ত বিলাপ দিলেই আমি কাজ সেরে বসে পড়ি। যতবার দেখি ততবার বসন্তের প্রেমে পড়ি আমি। আর ওই গানটা—ও শ্যাম যখন তখন, খেলো না খেলা অমন ... আমি বার বার মুগ্ধ হই। মনে হয় সত্যি আমরা খেলাটায় ধরা দেওয়ার জন্য বসেই থাকি। আমাদের সাহিত্য সভায় বহুবার বন্ধুপত্নী দোয়েলের কাছে এই গানটা শোনানোর বায়না করেছি। বেচারা হয়ত আমার করুন মুখটা দেখেই প্রতিবার শুনিয়েছে গানটা।
যেহেতু বাড়িতে সিনেমার চর্চা ছিলই তাই আমার পেকে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। প্রতি সপ্তাহেই সিনেমা দেখা প্রায় অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তখনই লোকটার দেখা পাই। দুস্টু লোক, লাল জল খায়, মেয়েদের আঁচল ধরে হাসতে হাসতে টানে আর গালে বসন্তের দাগ। তখনো ‘শকুনি’ দেখিনি, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়কে এভাবেই চিনেছিলাম। তখন আমার কাছে বসন্তের দাগ মানেই ভিলেন, দুস্টু লোক।
একটু বড় হওয়ার পর আমরা কলকাতা ছেড়ে এই জেলা শহরটায় চলে আসি। জানালার ধারে পড়তে বসি। আর দেখতে থাকি ওই পাতিকাকটাকে। সেই সময় আমার কাছে শীত পেড়িয়ে বসন্ত আসতো পড়াশুনোর সময় বৃদ্ধি নিয়ে। সামনেই অ্যানুয়াল পরিক্ষা। ফলে পলাশ ফুটলো কি ফুটলো না, বাতাসে প্রেম বহিল কি বহিল না, দেখার সময় নেই। স্টেজে মেকাপ দেওয়ার যাতনায় হুমড়ি খেয়ে পড়া বইয়ের উপর। তখন জানলা দিয়ে পাতিকাকটাকেও দেখা বন্ধ। হয়ত সেই সময় পাতিকাকটা আমার দিকে চেয়ে থাকতো। বাড়িতে নাম-কা-ওয়াস্তে সরস্বতী পুজো হলেও আমি কখনো অঞ্জলি দিইনি। কেউ দেওয়ার জন্য জোরও করেনি। সরস্বতী পুজো যদি বসন্তের ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ হয়ে থাকে তবে আমি ইন্ডিয়া, শুধু টিভিতে খেলা দেখে বিশেষজ্ঞের মতামত দিই, খেলতে পারিনা। আমাদের শহরটায় সরস্বতী পুজো বিখ্যাত হলেও আমার দেখা হয়নি ওই পরিক্ষার জ্বালায়। ঠিক একই কারনে হোলি আমার কাছে ছিল, খেলবো হোলি রং দেবো না টাইপ। সবচেয়ে মজা হতো রং খেলার পরের দিনগুলোর স্কুলে। প্রায় কারোরই গা থেকে রং উঠতো না। সেই সব লালমুখো, বাঁদুড়ে রঙা ছেলেরা মারাত্মক সিরিয়াস হয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ লিখত পরীক্ষার হলে। পুজো, হোলি, পরীক্ষা মিটে গেলেও বসন্ত থাকতো আর আমাদের শুরু হয়ে যেত ক্রিকেট খেলা। গোঁফ ওঠা আর গলা ভাঙার সময়টা বসন্তকে কখনোই সিরিয়াসলি নিইনি। একবারই নিতে হয়েছিল। ক্লাস এইটে অ্যানুয়াল পরিক্ষার পরই আমায় অ্যাটাক করলো গুটি বসন্ত। দিনের পর দিন মশারির ভিতর পড়ে থাকা আর নিমের ডাল দিয়ে শরীরে বোলানো। সকলের আমার ঘরে আসতে মানা, এক্সেপ্ট ফেলুদা আর টিনটিন। এই রোগটার নাম চিকেন পক্স কে দিয়েছে কে জানে! তবে রীতিমত মুরগি হয়েই ভাবতাম বন্ধুরা কেমন ব্যাট বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। আমি শুয়ে শুয়ে শুনতাম লুকোনো কোকিলের ডাক আর পাতিকাকটার কান্না।
পাড়ায় যদিও কাকু-কাকিমাদের দলটা দোল খেলত। মদ, সিদ্ধি ছাড়া একেবারে নিষ্পাপ দোল। আবিরে আবিরে ভরে যেত আমাদের মোরাম ফেলা গলিটা। আর দোল খেলার পর প্রতি বাড়ি থেকে কিছু না কিছু খাবার। কেউ খাওয়াতো ঘুঘনি তো কেউ বাতাসা। রং না খেললেও আমার ভাগ বাদ যেত না, ঠিক পৌঁছে যেত বাড়িতে। একবার দোল খেলার পর কুয়োতলায় মা স্নান করছে। গলার হারটা খুলে রেখেছে পাঁচিলের উপর সাবান মাখার আগে। স্নান শেষের পর দেখে হারটা নেই। উধাও। খুব প্রিয় ছিল হারটা মায়ের। আমার ঠাকুমা মারা যাওয়ার আগে মা’কে দিয়ে গিয়েছিলেন ভরিখানেকের সেই হারটা। শ্বাশুড়ির শেষ স্মৃতি ফেরত পাওয়ার জন্য সমস্ত বাড়ি উথাল পাথাল করেছিল মা। এমনকি কুয়োতেও কাঁটা নামানো হয়েছিল। পাওয়া যায়নি।
ক্লাস নাইনেই বসন্ত আমাকে অনেকটা বড় করে দিলো। গুলি মারো অ্যানুয়াল পরিক্ষার। ক্লাস নাইন মানে স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্বে। আরও পরিস্কার করে বললে, পাশের গার্লস স্কুলে নিমন্ত্রণের চিঠি দেওয়ার অছিলায় ঢোকার পারমিট। যে বন্ধ গেটের ওপার থেকে লেডিবার্ডে একের পর এক পরিরা বেড়িয়ে আসে, আমাদের ভুভুক্ষু চোখকে সাইডে রেখে উড়ে যায় হেথা হোথা—সেই গেটের ওপারের ঐশ্বর্য দেখার সুবর্ণ সুযোগ।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর সকলেরই ল্যাজ গজায় কম বেশি। আমারও কিছু কম গজালো না। কলেজে পড়ার সময়েই নাটকের দলে চোখে চোখ। ভালো লাগা আর ‘ভালোবাসি’ বলে ফেলার মাঝে যে বুক ধুকুপুকু তা যে অংক পরীক্ষার আগের দিনের টেনশনের সাথে তুলনীয় তা কে না জানে। এখনকার মতো ফেবু, হোয়্যাটস্যাপের সুযোগ থাকলে তো কথাই ছিল না। তখন প্রাইভেট পড়ার ব্যাচেও মেয়েরা আলাদা সারিতেই বসতো। অনেকগুলি কাছে যাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা টপকে প্রেম নিবেদন করাটা সহজ কাজ ছিল না মোটেই। তবে পরিবেশ হয়তো সবকিছুই সরল করে দেয়। ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল’ বলে আমরা ঠিক নেমে পড়লাম বসন্তোৎসবে। গান নাচ আবৃত্তির ফাঁকে ফাঁকে চলল আবির খেলা, আমাদের নাটকের ক্লাসে। আর সেই ভিড়ের মাঝেও আমি সুযোগ পেয়ে গেলাম মুঠোভর্তি আবির তার গালে মাখানোর। কী পেলব সেই গাল! হলুদ, সবুজ, লালে ভরা সেই মুখ আমার আবির মেখে আরো সলজ্জ হলো আর আমি জানিনা কীভাবে বলে ফেললাম—ভালোবাসি। তার চকিত দৃষ্টি আর নামিয়ে নেওয়া চোখে লেখা ছিল সহমতের প্রতিশ্রুতি। ব্যস, পাড়ার লাইট পোস্টে বাঁধা চোঙে রবি ঠাকুরের পাশাপাশি দিব্যি চলতে লাগলো ‘এসেছে হোলি এসেছে’ বা ‘রং বরসে’। সেই আবির রাঙানো মুখের দিকে কয়েক মিনিট তাকাতে পেরেছিলাম; তারপর একটা হারকিউলিস আর একটা লেডিবার্ডের চাকা ঘুরেছিল পাশাপাশি। আমি পড়ে গেলাম—প্রেমে। ফেলে দিলো একটা বসন্তই। সেবারই প্রথম দেখলাম মাঠের পাশের কৃষ্ণচূড়াটা লালে লাল। লজ্জার রংও কি লাল? নইলে সেই অত আবির মাখানোর পরও ‘ভালোবাসি’ শুনে সেই মুখে লালের আভা এলো কী করে!
প্রেমে পড়ার পর বসন্তকে চিনতে ভুল হয়নি। কারণ ফি সরস্বতী পুজোয় তাকে নিয়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরার কথা কোকিলটা ঠিক মনে করে দিত। প্রেমে পড়ার পর হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে রাখতে হতো ভ্যালেন্সটাইন ডে’র গিফটের জন্য, সেও প্রতি বসন্তেই। বছরের পর বছর বসন্ত শুধু প্রেমের উদ্‌যাপন করে গিয়েছে দুটো হৃদয়ের মাঝে, হারকিউলিস আর লেডিবার্ডের মাঝে।
কলেজে পড়তে পড়তে আমি যখন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি, একা একটা সিগারেট ফুঁকে দিতে পারি, কলকাতা চষে বেড়াই; তখন বসন্ত এসেছিল পর্দার আড়ালে। প্রেমিকাকে নিয়ে আমার মাসিক প্রেমের ডেস্টিনেশন—বসন্ত কেবিন। দুটো কোল্ড ড্রিংক্স আর এক প্লেট মোমো’র বদলে ভারী পর্দা টেনে দিলেই ঘরের ভিতরে ঘর, পাক্কা এক ঘন্টার জন্য। একটা এক ফুট চওড়া টেবিল আর একটা লো বেঞ্চের মাঝে কোনো রকমে দুজনের বসার জায়গা। উত্তপ্ত নিশ্বাস সেসব খামতি কখনো গায়ে মাখেনি। প্লাইয়ের দেওয়ালের ওপাশের কেবিনটায় হয়তো খদ্দেরের সাথে কোনো বেশ্যার বোঝাপড়া। আমি তখন সেই আবির মাখানো পেলব গালদুটোর ঠিক নিচে খুঁজে নিচ্ছি নরম এক জোড়া ঠোঁট, যার নোনতা স্বাদ আমার রক্তের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওর সবটুকু লিপস্টিক খেয়ে নেওয়ার মতো গোপন যায়গাটুকু বিক্রি করে দিত বসন্ত কেবিন। ডবল দামের গরম মোমো’র ধোঁয়ার দিব্যি, ভোলা যায়না বসন্তকে, বসন্ত কেবিনকে।
“বেকার ছেলে প্রেম করে আর পদ্য লেখে হাজার হাজার
এমন প্রবাদ হেব্বি প্রাচীন অরণ্যে
কিন্তু তার আড়ালের খবর? জবরদখল? দখলজবর?
হাজারবার মরার আগে মরণ নেই”।
শ্রীজাত’র এই কবিতাটা যখন বই হয়ে বের হয়েছিল, তখনই শুনিয়েছিলাম ওকে। সেই সময় আমার বেকারত্ব আর নিকোটিনে ভরা হৃদয় দিব্যি বুঝতে পারছিল, কোথায় যেন সব লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। প্রেম যতটা না হচ্ছে, ঝগড়া হচ্ছে তার ডবল। ছয় বছরের সম্পর্ক বুঝতে পারছিল ওর বাড়িতে বিয়ের চাপটা আমার ছ্যাচড়া কবিতাগুলো নিতে পারছে না। বেকার প্রেমিক যতই ভালো চুমু খাক, বিয়ের মার্কেটে এখনো সরকারী কর্মচারীরাই যুবরাজ সিংহ, বিয়ে-আইপিএল নিলামে সর্বোচ্চ দর। তাই জবরদখল আর দখলজবরের লড়াই জারি। প্রতি রবিবারের দেখা করার প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে আমি যেতাম পরিক্ষার সেন্টারগুলোতে। একটা গ্রুপ ডি’র চাকরিও জবরদখলটা পাকা করে দিতে পারে যে। কবিতার খাতাগুলো ভর্তি হতে থাকলো জিআই আর জিকে’র প্রশ্নোত্তরে।
এক রবিবারে পিএসসি দিয়ে ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল। মোরের মাথায় ফুচকা খাচ্ছে ও, সাথে আর একজন। সেও এক শেষ বসন্তের বিকেলবেলা। পরে বন্ধুদের কাছে খবর নিয়ে জানতে পারলাম, বিয়েটা ঠিক, পাত্র সরকারী চাকুরে। বুঝতে পারলাম, জবরদখল আর দখলজবরের লড়াইয়ে সামান্য হেরো পার্টি হয়েই রয়ে গেলাম। পড়ার ঘরে জানলা দিয়ে ঝাপসা চোখে তাকাতে তাকাতে আবার শুনতে পেলাম কাকটার ডাক। এত বছর পর বুঝতে পারলাম, কাকটা কাঁদছে, প্রতারিত হয়ে। কোকিল, যার মোহমহী স্বরে মুগ্ধ হই আমরা, প্রতারণা করে গেছে কাকটাকে, প্রতারণা করে যায় বারবার, প্রতিবার বসন্তের শেষেই।
একযুগ পরে আমি এখন বসন্ত উদ্‌যাপন করি শান্তিনিকেতনের রিসর্টে। দাঁড়কাককে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায়না। আমার মতো পাতিকাকেরাই ভিড় করে এসব যায়গায় আর আঁতেল সাজে। সকালে মেলার মাঠে বসন্তোৎসব আর রাতে হুইস্কি। সাউন্ড সিস্টেমে ‘লংগা ইলাইচি কা’ আর ফেবুতে হলুদ পাঞ্জাবীতে সেলফি। সারা বসন্তোৎসবের মাঠ জুড়ে আমি খুঁজে চলি সেই পেলব গালদুটোকে, যাতে আবির মাখালে লাল হয়ে ওঠে।
বেশ কিছুদিন আগে নিমগাছটাকে কেটে ফেলা হয়েছে। পাশের বাড়িটা দোতলা হবে বলে। পাতিকাকটা আবার ডাকতে শুরু করেছিল করুণ স্বরে। কেউ পাত্তা দেয় টেয়নি। পাতিদের কেই বা কবে পাত্তা দিয়েছে। গাছ কেটে ফেলার পর মাটিতে ছিটকে পড়ে পাতিকাকের বাসা। সেই সময় কোনো ডিম ছিল না বাসায়, কোনো উড়তে না পারা বাচ্চা কাকও ছিল না। তবু উপস্থিত মানুষগুলো হাঁ হয়ে যায়। ভেঙে পড়া বাসার মধ্যে জ্বলজ্বল করছে একটা সোনার হার, আমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া।  ‘পাতি’রাও সময়ে সময়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
পুনশ্চঃ তার বিয়েটা হয়ে যাওয়ার আগেই আমি চাকরি পেয়ে সরকারী আধিকারিক হয়ে যাই। সে ঠিক হওয়া বিয়েটা ভেঙে আমাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু আমি চাইনি। এ ঘটনাও ঘটেছিল এক বসন্তে।  
 
বসন্ত বিষয়ক গদ্য .................................................................................................................................................................................


বসন্ত জাগ্রত দ্বারে

অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায়




কবে কখন কীভাবে যে বসন্ত এসেছিল জীবনে,
মনে নেই।
শুধু মনে আছে, মায়ের কোল জড়িয়ে ঘুম ভাঙ্গতেই
হঠাত একদিন কোকিল ডেকে উঠেছিলো।
কোলের ভাইটি সদ্য স্কুলে ভর্তি হয়েছে তখন।
কি এক অজানা আশঙ্কায় ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়েছিলুম।
তারপর থেকে খুব সাবধানে, ওর পিঠ জড়িয়ে, শক্ত করে হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতুম।
হ্যাঁ, এভাবেই বসন্ত এলো-
কোকিলের ডাক আর এক অজানা ভয় নিয়ে;
প্রিয়জনের হারিয়ে যাবার ভয় ।
তখন বসন্তে একটা হাওয়া দিত।
বেশ টের পেতুম,
সকালবেলার মন ভালো করা হাওয়াটা
বিকেল হলেই কেমন পালটে গিয়ে মন-খারাপ-করা হাওয়া হয়ে যেত।
নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালে কাঁচা আমের গন্ধ, আরো কী কী সব গন্ধ পেতুম ।
গুন গুন করে গান আসত-"আজি এই গন্ধবিধুর সমীরনে"।
মনের মধ্যে, আকাশে, বাতাসে, গাছের পাতায় , ঘাসে কি যে এক আন্দোলন শুরু হত
সে কী, সে যে কী কিছু বুঝে ওঠার আগেই
আবার সুর এসে পড়তো- এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী।
আর সত্যি সত্যি নদীর জল ছলছল করে উঠত।
দুএকটি ঝরা পাতা উড়ে এসে ছুঁয়ে দিয়ে যেত।
নদীর ওপার থেকে মনকেমনের বাঁশীর সুর ভেসে ভেসে আসতো।
আমি মনে করার চেষ্টা করতুম- কোথায় যেন যেতে হবে
কোথায় যেন যাবার আছে...
সেদিন প্রথম রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে দেখলুম, চাঁদের আলোয় বন্যা এসেছে।
থইথই চাঁদের আলো আমার বিছানা জুড়ে।
সেই আলোয় হাত বুলাচ্ছেন আমার পরমাসুন্দরী মা।
তার দুইগাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মুক্তোর মত চোখের জল।
তিনি গাইছেন- নিবিড় অমা-তিমির হতে বাহির হল জোয়ার স্রোতে
শুক্লরাতে চাঁদের তরনী...
সেদিন রাত্রে আমার সুখ আর দুঃখ মিলেমিশে গেল
আমার আলো আর আলো রইল না
অন্ধকার অন্ধকার রইল না
যা রইল, তা নিটোল এক ছবি
সে ছবির ক্যানভাস রবিঠাকুর
আর রঙ আমার মা...
তুলি হাতে আজও এঁকে চলেছি
যেদিন সম্পূর্ণ হবে, সেদিনই আমার শেষ বসন্ত।



বসন্ত বিষয়ক গদ্য .................................................................................................................................................................................


বসন্ত

-নীপবীথি ভৌমিক




    বসন্ত ছেঁয়ে গেছে চারিদিকে।দিগন্তে দিগন্তে ফুলেদের আগুন খেলা! সৌভাগ্য বশতঃ শান্তিনিকেতনের আশ্রম ক্যাম্পাসেই আমার বাসস্থান।আকাশে বাতাসে জাগরিত এই বসন্ত বেলায় কি আর মন চায় ঘরে বন্দি থাকতে।বেড়িয়ে পড়া উদ্দেশ্য হীন ঠিকানায়।কানে ভেসে আসছে সঙ্গীত ভবনের ছাত্র ছাত্রীদের দ্বারা পরিবেশিত বসন্ত সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত নৃত্যনাট্য “তাসের দেশ”র রিহার্সাল। “আমরা চিত্র  অতি বিচিত্র / অতি বিশুদ্ধ,  অতি পবিত্র…”
     সত্যিই তো,কতটাই বা জানি আমরা এই বিপুলা পৃথিবীর? আজ  তাই এই বিচিত্র চিত্রের আহ্বানে রাঙা পথের রাঙাধুলোর নেশায় ঘরকে করেছিলাম কিছুটা সময়ের জন্য পর।
     মাঝে মাঝে এভাবেই হারাতে ইচ্ছা করে ভীষণ।জানতে ইচ্ছা করে প্রকৃতির উদার্ত আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা অসংখ্য রঙের বাহার,ফুলের মায়াবী আঘ্রাণ,কিংবা ধুলোর পথে মাটিরঙের রহস্য।কতই না জানার আছে আমাদের,কতোই রহস্যাবৃত্তে আবদ্ধ করে রেখেছে প্রকৃতি আমাদের!কত পথ ই আছে জীবনের এই দীর্ঘ পথ চলার পায়ে পায়ে,কত জানা হয়ে অজানার সত্য হাতের স্পর্শে মিশে থাকি আমরা,আবার কখনও বা অযুত অজানার সাগরেই নিজেকে করি সমর্পণ।তাইতো “জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান”।আর তাইতো “বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান”।
    চলেছিলাম এভাবেই বসন্তের বাহার ধুনে আন্দোলিত হয়ে। পথে পথে আম্রমুকুল বালিকার আসা যাওয়ার  হাওয়ার বাতাস আর আশ্রম থেকে সান্ধ্য বাতাসের পাখায় ভর করে ভেসে আসা সুর বলে যায় বারবার কানে কানে “আজি দক্ষিণপবনে দোলা লাগিল বনে বনে।“ হ্যাঁ,সত্যিই দোলা লেগেছিল হৃদয়ের কোণে।আর কেনই বা লাগবে না? পলাশের এমন অপরূপ মনলোভী সৌন্দর্য দেখে! কেউ কি পারে সত্যিই এমন করে চোখ ফিরিয়ে রাখতে? প্রাণচ্ছাসের বসন্ত রঙ মেখে আজ  তো সেই ঋতুরাজের প্রেম !
  “কুঞ্জবনের অঞ্জলি যে ছাপিয়ে পড়ে” তার রূপ মাধুরীর আগুন ধারায়,তাইতো “পলাশ ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে,/বেণুর শাখা তালে মাতাল পাতার নাচে।।“ গাছে গাছে ,পথের বাঁকে বাঁকে তাই পলাশ বন্দনা আজ ।পলাশ আর বসন্তের মুগ্ধ চাঁদ রাত তাই পরস্পরে মেতে ওঠে সেই সুরের ধারাপাতে…
  “পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়/রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।/তোমার প্রজাপতির পাখা/আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন মাখা।/তোমার চাঁদের আলোয় মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান।“
    সত্যিই হয়তো তাই,শুধু এইটুকুই মনে হয় পলাশের চাওয়া বসন্তের কাছে।আর তাই তো এত রূপ যৌবনের উৎচ্ছলা,এত আগুন মায়ার রঙের মাধুরী,সবই যেন তার শুধু একদিনের জন্য।দোলের আবীর সজ্জায় সজ্জিত অযুত প্রাণের আনন্দে মেতে ওঠা মানুষের জন্য। আর তারপর কে আর খবর রাখে আর ,তার মৃত্যু সংবাদ কাকেই বা শোকস্তব্ধ করে! কেউ কি রাখে আনন্দ উৎসব শেষে তার প্রিয় পলাশ আছে কি জীবন নিয়ে এই পুণ্যভূমির রাঙা ধুলোয়!
   রাখেনা,কেউ রাখে না,বরং কত পলাশ পিষ্ট হয়ে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যায় নীরবে। আর সান্ধ্য মঞ্চে আমরা গাই “ চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন…”হয়তো শুধু আবীর আর উৎসবেই তার স্থান,উৎসব শেষে তাই সে কদরহীন,শুধুই এক ফুল! আর মানুষ নিহত হলে তার বিচার হয়,ফুল নিহত হলে তার আবার বিচার কেন!
  “ ওই দেখো গোলাম অতিশয় মোলাম।
        নাহি কোনো অস্ত্র  খাকি-রাঙা বস্ত্র।
         নাহি লোভ,নাহি ক্ষোভ।
             নাহি লাফ,নাহি ঝাঁপ।
        যথারীতি জানি,সেই মতো মানি।
          কে তোমার শত্রু, কে তোমার মিত্র।
            কে তোমার টক্কা,কে তোমার ফক্কা।“
---হয়তো পলাশও তাই জানে! তবু, এটাও তো ঠিক পলাশ সাজে অঙ্গ সাজ ছাড়া বসন্ত কি আর মানে! তাই পলাশ ফুলে ঢাকুক অঙ্গ-শরীর,বেজে উঠুক গৃহবাসীদের দ্বার খোলার আহ্বান,শুধু এটাই যেন পারি আমরা সবাই আরো আরো বেশি করে পলাশ ফোটাতে, শিমূল,কৃষ্ণচূড়ায় লাগুক আগুন,জ্বলে উঠুক দিগ্‌ দিগন্ত ফুলের আগুনে।
বসন্ত বিষয়ক গদ্য .................................................................................................................................................................................


॥ বসন্ত বিলাস॥
বৈশাখী রায় চৌধুরী




কিছু মুক্তভার কালো ধোঁয়া, পরস্পর ছুঁয়ে দেওয়া লোহার পাতের মাঝে একটুকরো জায়গা করে নিলেই তো গড়ে ওঠে সম্পর্ক। এগিয়ে চলে গড়িয়ে চলে আবহমান ও আগামী। যেটুকু মুক্তভার অন্ধকার সেটুকুই কালো ধোঁয়া তা উড়ে যায়। সত্যিই একদিন সব উড়ে যায় সমস্ত জেদ, অহংকারআগুন, চিতাভস্ম।  
                              রেললাইনের উপর এসে পড়ে আলোভোর, শালিকসকাল। স্টেশনে স্টেশনে সমারোহ,  পলাশমুকুল, বুনোগন্ধ, ছড়ানো বিটনুন । সেজে ওঠে সবাই সাজি আমিও।    
                          বসন্ত সারিতে এই সাজটুকু খুব প্রয়োজন। চেতনার নৈঋত বিকেল,  চিত্তশুদ্ধি। হে বসন্ত সাজিয়ে দাও আমায় চিরনতুন পুরনো আমি, এঁকে দাও গাঢ় শেডে ঠোঁটের কোণে সেই  প্রিয় সিনেমার সংলাপ, অংশবিশেষ  ''অ্যাডজাস্টমেন্ট মানে হেরে যাওয়া নয় একপ্রকার জিতে যাওয়াও ''।
                           এটুকু আগলেই হেঁটে যাবো সমস্ত ফোকাস, ক্যামেরা, বসন্ত ঘেরা আলোবৃত্তের বাইরে জীবনের শেষ শেষতম জয়ের উদ্দেশ্যে।
বসন্ত বিষয়ক গদ্য .................................................................................................................................................................................


বসন্ত পুরাণ
শুভদীপ ঘোষ




আমি একটু দুঃখবিলাসী। হুম বরাবরই। পাওয়া কষ্টে আবার মজে যেতে আমার বেশ লাগে। কেন লাগে তার যথার্থ ব্যাখা আমার কাছেও নেই। সদ্য থার্টি ক্লাবে মেম্বার হওয়া এই ছেলের জীবনে তো ঘটনা কম নেই আর। চারিপাশে বসন্তপোনা দেখে আমার একটা দোল খেলার কথা মনে পরছে। হ্যাঁ একটাই, কারণ বাকি পেরোনো দোলের থেকে ওটা একটু আলাদা। সালটা ২০০৮, আমি তখন মাস্টার্স করছি। সেকেন্ড সেমিস্টারের ক্লাস চলছে। গোলাপবাগ চত্তরে রোজ আনাগোনা। এমনিও ওই সময়টা কৃষ্ণসায়র পার্কের পাশ দিয়ে গেলে আমাদের মতো ছেলেপুলেদের রেগুলার প্রেম পেত।
দোলে এমনই দুদিন ছুটি। আর যারা নিপাট বর্ধমানবাসী তাদের আর একটা গর্বের জায়গা তারা সাধারণ দোলের পরদিন আলাদা করে দোল খেলে। তো দুদিন ছূটির পর ক্লাস যাই। আমাদের থিওরি পার্টটা টিফিনের আগে হতো, টিফিনের পর প্র্যাক্টিকাল। যথারীতি প্র্যাক্টিকাল চলছে। যদ্দূর মনে পড়ছে ব্রায়োফাইটের প্র্যাক্টিকাল। ও হ্যাঁ বলা হয়নি আমার মাস্টার্সের বিষয় হল বটানি। ক্লাস শেষ হতে হতে বিকেল প্রায় গড়িয়ে যায়। মোটামুটি পাঁচটা তো রোজই বাজে। আমাদের ক্লাস শেষ। আমি প্র্যাক্টিকাল বক্স গোচ্ছাছি। টেবিলে পরে থাকা জিনিষপত্তর এক জায়গায় করে দিচ্ছি। ঠিক এমন সময় বুঝলাম আমাদের ইয়া বড়ো দোতলার প্র্যাক্টিকাল রুমটার একদম শুরুর দরজার দিকে আমাদের বেশ কিছু বন্ধু বান্ধবী রঙ খেলা শুরু করে দিয়েছে। না ঠিক রঙ বলব না ওই আবির খেলা। এই অকাল দোলে অনেকেই বেশ আপত্তি জানায়। কেউ দৌড়ে নিচে পালাতে যায়, ধাওয়া করে একমুঠো আবির। আমি আবার বরাবরই যেচে রঙ মাখার পক্ষপাতী। এতে দেখেছি যে ধেয়ে আসে তার উতসাহ এক্কেবারে চুপসে যায় এবং মারাত্মক ভদ্রভাবে রং মাখায়। তো আমিও সামিল হই আবির খেলায়। রঙিন হতে শুরু হয় টেবিল,টুল। আবির ছিটে লাগে মনে। পিছন থেকে কানে আসে 'আয় শুভ তোকে একটু রঙ লাগাই'। এমনিও আপত্তি নেই তারওপর চেনা গলা। ঘুরে দাঁড়াই। আলতো হাতটা আমায় অল্প আবির দেয়। সামান্য চোখ তোলে আমার পানে। আমিও আলতো করে কিছুটা আবির ওর হাত থেকে নিয়েই ওর গাল ছুঁই। ও চোখ বোজে। মুহুর্তের বয়স কত আর এক কিংবা দেড় মিনিট। কি জানি তারপর বেশ কিছুক্ষণ দুজনা আর কোনো কথা বলিনি। বলতে পারিনি আর কি। কি কেন কিজন্য এগুলো বরং একটু অন্য কোথাও বৃষ্টি হয়ে ঝরুক। আজ ন নটা বছর পেরিয়েছে। ক্যালেন্ডার বলেছে দোলও পেরিয়েছে ওই কটাই। তবু ওই মুঠো আবিরটা এখন লেগে আছে আগের মতোই ।
বসন্ত বিষয়ক গদ্য .................................................................................................................................................................................




"ছেঁড়া বসন্ত"
- মুনমুন সিংহ




"আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে" - বসন্ত দিনে এই লাইনটাই আমার একমাত্র উদযাপিত উৎসব, বাকিটা তো তোর পায়ের রেখা ধরে হেঁটে চলে গেছে নিরুদ্দেশের পথে । জলছাপ আর জন্মদাগ দুটোই বাধ্য, নির্ভুল চিহ্ন । বসন্তের রাতে মুক্তি বলতে আমি বুঝি তোর সঙ্গ, নির্ভেজাল সঙ্গী হয়ে যতরাত আমার ভিতরের বৃত্তকে ঘিরে ছিলি সেইসব রাত আমার বেঁচে থাকার দিন যুগিয়েছে প্রতিদিন । শত শত তুই-হীন রাতে আমি আজও তোর ছায়া আঁকড়ে ধরি বসন্ত-প্রতীক ।
তোকে ছাড়া বসন্ত আর গ্রীষ্ম আপাত অন্তরবিহীন আমার অন্তঃপুরে, নিঃস্ব আমার প্রেমজন্ম । আমি তো এককালে জানতাম, পাহাড় ঘেরা তুই, উপত্যকা একমাত্র আমিই । রঙ দিয়ে নাকি তোকে বাধা যায় ? তবে কোন্ সমীকরণে আমার ফ্যাকাসে আকাশে তুই অনায়াস আগন্তুক বসন্ত-প্রতীক ?
জানিস, বসন্তে প্রকৃতি সাজে, নতুন রূপ পায় জীবাশ্ম শরীর । তোর সাজানো রূপ আমার দৃষ্টি অগোচর বন্দি যাপনে । ধোঁয়াটে লাগে সবটাই, মেঘের কাছে তবু এক আশ্চর্য মোহে বারবার তোর ঠিকানা জানতে চাই, হারিয়ে যাই জানিস, হয়তো হেরে যাই । শিকরের সাথে সবুজ পাতার যে অমোঘ টান, কোনো এক বসন্ত সকালে আমার মনের সাথে তোর স্পর্শের কি সেই টান ছিলোনা ? যদি টান ছিলোই, কি নিয়মে বোহেমিয়ান বসন্তকে ছেড়ে গেলি ? তোর-আমার একসাথে যাপিত বসন্ত উৎসব গুলো শুধুই ছেঁড়া বসন্তে পরিণত বসন্ত-প্রতীক !
বসন্ত বিষয়ক গদ্য .................................................................................................................................................................................


নির্জন বসন্ত দুপুর

রুমকি রায় দত্ত







মাঝে মাঝে শরীরে, মনে বিরহ মাখতে ভীষণ ভালো লাগে!...তাই প্রতীক্ষা করি বসন্ত দিনের। দুপুরে দোতলার জানালা দিয়ে যখন সোনাঝুরি বনের দিকে দেখি,দৃষ্টি হারায় সীমান্ত পেরিয়ে দূর অসীমে অনন্ত কোনো শূন্য লোকে। তখন ঝাঁকে ঝাঁকে বিরহ উড়ে এসে জড়িয়ে ধরে আমায়। বিরহ জাগে ঝরে পরা পাতার দিকে তাকিয়ে।...শুকনো পাতার স্তুপ সরিয়ে খুঁজি সৃষ্টির বীজ। ঝরা পাতা যেতে যেতে বলে যায়..... ‘পুরাতনে দাও বিদায়, নবীনের তরে’। “আমি কান পেতে রই’... শুনি নির্জন বসন্ত দুপুরের বিরহকথা। আমি চোখ তুলে দেখি সৃষ্টিকে। গাছে গাছে হালকা সবুজ আবির রঙের কচি পাতা মাথা নাড়ে, স্বপ্ন দেখায় আগামীর। লাল,নীল,হলুদ, গোলাপি বাহারি ফুলের হাসিতে স্নান করে ঋতুরাজ। কচি পাতার ফাঁকে ফাঁকে লুকানো পাখির গানে তখন মুখরিত আকাশ – বাতাস  জানিয়া যায় “আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে”। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি নেড়া গাছটার ফাঁকে ঘুমে ঢলে পড়ছে ক্লান্ত সূর্য। দিগন্তে তখন মুঠো মুঠো আবির। আকাশ জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে বসন্ত সঙ্গীত “ রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে”।
বার্ণিক এর কবিতা ১ –



বর্ণ-সঙ্গম
 চয়ন ভৌমিক




নিশ্চিত বৃন্দাবনেরই হবে সেই ধুলো,
      রক্ত-পরাগ যার সমগ্র কণাতে।
রাধিকার ঘামের ঘ্রাণ ভরা মেঘ-বাতাস
অযথাই উড়িয়ে নিয়ে আসে সে ফাগ
মৌন শ্যামল-কিশোরের বজ্র মুঠিতে।
ঋতু ষড়যন্ত্রে চন্দ্রাতপ পূর্ণ ছিল তখন
আর আগুন মানে ছিল পলাশের পুষ্প-শিখা
 সেদিন তবে,কেনই বা এমন প্রতারণা?
কেনই বা এই রতিকলা ফাঁদ
সেই উদ্ভিন্ন যৌবনবতী ফাগুনের রাতে।
যে রঙ জমেছে মুঠো থেকে বুকের ভিতরে
সুঠাম হাত খুঁজেছে রাঙিয়ে দেওয়ার শরীর
সেখানে হোলি খেলা মানে এক নিমিত্ত দুপুর।
জানো? আসলে তো মন খোঁজে গভীরতর মন
ভ্রান্ত সমর্পণ চিনে নেয় গোলাপী পুকুর।
এ অবস্থায় রঙ তোলা স্নান?
   সেও যে কূট অভিনয়, কতিপয় মিথ্যে অজুহাতে।
হয়তো এসবেরও পরে তাই, হাজার বসন্ত ধরে ,
কুচমুগ্ধ গুলাল, জাদু-বাস্তব সহ ফিরে আসে, আবেশে
নদী জাগে পাথরের খাঁজে
মুরলীর নেশা জড়ানো মধুর প্রপাতে।।
বার্ণিক এর কবিতা ২ –




ক্ষুধার জমিন জড়িত
দীপ রায়

(১)
আর কত সাজানো নিচ্ছিদ্র পাহাড়া
টাটকা বারুদঝড়ে ছিটকে পড়ার সামিল ক্ষুধার জমিন
ক্ষুধা, সে কখনোই নয় কোনো সহজ টার্মিনোলজি
চোয়াল, সে শুধুই চোয়াল নয় ....ভাঙনপ্রেক্ষিত।
এই বায়ুমণ্ডলে ক্রমশই বেড়ে চলে দীর্ঘনিশ্বাসের ওজন
   সাথে মাটি খুঁড়ে ধেয়ে আসে প্রহসন
ক্ষুধার জমিন তার নামের সঠিক ব্যবহার করতে বদ্ধপরিকর
   তুমিও পলাতকা,
লিপিবদ্ধ হয় আঠালো বিশেষণ...
(২)
আর কত বেনামী সংযোজন
অনিচ্ছাসত্বেও একটু করে সরতে সরতে
   ঠাহর হয় মাঝে পাঁচ হাত তফাত
যে তফাতের ক্র্যাশগেটে জমানো বিপন্নতা গতি পেলেও
    আটকে যায় ভালোলাগার লিরিকগুছ
(৩)
আর কত কাকভেজা নৈঃশব্দ
বিপন্ন জমায়েতে স্মৃতিভ্রম
অস্ফুটে আওড়ানি... নিষিদ্ধ গনসঙ্গীত
পথ চেয়ে বসে একটি শূন্য নৌকা
তুমি কণ্ঠরোধ তবুও সিলেক্টিভ
শেষ সুযোগের হাতছানি আরও একবার
   ভুলে যাও বিকলাঙ্গ অভিযোগ
 বেজে উঠুক আঁচড়-আছাড়...
(৪)
আসলে আমরা সকলেই জানি বটমলাইন
কখনোই বলতে পারবেনা এই প্রথম এরকম...
এই অবাক হওয়া নয় কোনো তাল কেটে যাওয়া
তবু যখন টান পরে এলাস্টিক দাবানলে
চেনা পথ লাগে সংকীর্ণ আর সদ্য জন্মায় ভাবনাগাছ
  "কাল আমি সত্যি এই পথ দাপিয়েছিলাম ?"






বার্ণিকের কবিতা ৩-


উত্তর বসন্ত
ইমরাজ হাসান


ছোঁয়াচে রোগের মতো বসন্ত গাঁথে ত্রিশূল
আমার রক্তের সব আঁশটে ব্যর্থতা---
আমারই থাক। তুমি শুভ্রতা নিয়ে যাও।
আত্মসন্ধানে নিরুদ্দেশ খেয়ার মাঝি
ক্লান্তিতে নুয়ে পরা চৈত্রের মতো---
দহন করে। বহন করে আমাকে।
রাত্রির চোখে অদ্ভূত আগুন থাকে
তুমি শুধু চাঁদের চোখে চোখ রাখো।
প্রিয়তর যন্ত্রণার ফসিল ধুয়ে যায় কান্নায়
কালো ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকি---
বৃষ্টিতে ধুয়ে যাক পথচলা। পথ পরে থাক।
নগ্নতার ক্লেদে ভেসে যাওয়া মায়ের বুক আমার থাক,
তোমরা ফসলের পশরা সাজিয়ে বসো উল্লাসে!!




শেকড়
ইমরাজ হাসান





যে চিনছে আমাকে প্রেমিক বলে
সে জানেনা আমি সারারাত ধরে;
যন্ত্রণার নীল সেতু গড়ি।
একটা শেকড় পোঁতা ছিল কবে...
মনে নেই, বাবা-মায়ের জীবন্ত মুখ।
যে মেয়ে চুমু খাবে বলে ঠোঁট বাড়ায়
সেও জানেনা এই নির্বিকার শরীর;
অর্ধেক জীবন নিয়ে বেঁচে আছে।
অভিমানের রূপালি ফেনা মেখে সারাগায়ে
প্রিয় কুসুম গাছের নিচে, নতুন বসতি বসছে।
মনমরা নদী ফিরে ফিরে আসে ছবিতে
পাঁজরে যেন গুলি বিঁধে আছে যন্ত্রণার।
মন ভালোর সেতু রোজ গড়ে ওঠে
হটাৎ হাওয়ায় রোজই তা ভেঙে যায়।
বার্ণিক এর কবিতা ৪ –



প্রবালদ্বীপ থেকে বলছি
-পৌলমী দাম




আঁখি-নৌকার মাঝি! ভালোবাসো মাঝদরিয়ায়..
ভালোবাসতে বাসতে চল যাই উৎস সন্ধানে।
অনুরোধ নয়। প্রেমিকার কঠোর আদেশ।
যদি সত্যি ভালবাসো... ঘুরিয়ে দাও নদীর গতিপথ!
চাঁদের ছায়া ঝিলমিলিয়ে উঠুক জলকাঁচে।
আর নদী ফিরে যাক নিজের গোমুখ গুহায়!
সমুদ্রে তুফান তোলো অহরহ।
হ্রদে হ্রদে বাড়িয়ে দাও লবণাক্ততা।
জলপ্রপাতে জেগে উঠুক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি!
জলে জ্বলুক আগুন!
হ্যাঁ আমি জলকন্যা বলছি...
প্রমাণ কর তুমি পুরুষ নও।
প্রেমিক!
ভালোবাসো... ভালোবাসো... ভালোবাসো!
বার্ণিক এর কবিতা ৫–


।।ফাগুন রঙা।।
অনুক্তা ঘোষাল




আজ ফাগুনে খুশমেজাজী দুপুর হাসে চুল খুলে,
মন দরিয়া বাঁধছে টোড়ি ছন্দে আলোর মোম ঢেলে ।
মুখচোরা মেঘ নিখোঁজ ডেরায়
লাজুক ফাগের স্বপ্নে হারায়।
চোখের কোণে সবুজ হাসে, বাউল সুরে মত্ত দিল,
তাহের সামে যুগল বাঁধে, পাতায় প্রেমের রং সামিল ।
হলুদ ডানায় প্রেম পোহালি আলতো হেসে মুচকি বেশ,
ছন্দ মেখে আত্মহারা কাব্যে শুধুই রবির রেশ।
নীল রঙে আজ আলতা গুলে
হোক না বিকেল এই সকালে ।
উঠছে দুলে ছন্দে তালে আলতো হাসির হিন্দোলা
বসন্ত আজ বাঁধবে সুরে আবেগ ঢেলে মন খোলা ।
বার্ণিক এর কবিতা ৬ –


নির্মম বসন্ত।
----অচিন্ত্য রায়




দিনটা আগুন হয়ে ফাগুন ডাকে
পলাশ আর শিমুলের রঙ
মাটিতে গড়াগড়ি খায়…
তাই বুঝি বসন্তের রঙ গাঢ়
শোনানো তরয়ালের পাশে মৃত দেহ
নামহীন উলঙ্গ।
হোলির মানুষ ওরা…
খেলতে ভালোবাসে!
তাই বসন্ত আসে ফাগুন চোখে…
সমাজকে, অসহায়ত্বের রক্ত রঙে, রাঙিয়ে
লালে-লাল করে রাখে।



বার্ণিক এর কবিতা ৭

বসন্ত ভাবনা
---সুজিত মান্না





রাত্রির কোনো অধিকার নেই
পথচলতি দিনভাবনায় এক চুরমার ক্রোধে
অন্ধের মতো জ্বলে উঠতে
তবুও দিন বদলায়
রঙ বেরঙের নৃত্যের তালে এপাড়া থেকে ওপাড়ায়
বেজে ওঠে বসন্ত উৎসবের গান
যে মেয়েটি কেরোসিনের গন্ধে শশুরের ঘরে জ্বলে গেছে
রাজ্যের খারাপ চিন্তাগুলো ছাই হয়ে
উড়ে যেতে থাকলো কাগজে কাগজে
বসন্তের গান যে পাড়ায় অপরিচিত
থেকে যায় আজও
দৈনন্দিন হত্যা সেখানে কি বসন্ত হয়ে ওঠেনা একবারও

বসন্ত কিনারা
উপোসের দিনযাপনে রঙ মেশে না বসন্তের
তাই  ব্যাবসায়ীরা অন্য পাড়ায় রঙের ফেরি করে
আমাদের দিন চলে যায় ,ঘুমও আসে নিয়মিত
দিন থেকে রাত্রি, কোথাও রঙ বলে কিছু নেই
ও মাঝি, তোর বসন্তের অন্ধকারে "
আজো কি রোজ রোজ জোনাকিরা দেখা দেয়?
বার্ণিক এর কবিতা ৮ –




বসন্তের স্রোতে আবৃত্ত কবিতা
---পিন্টু পাল


(ক)
বসন্ত কড়া দিলে
প্রেমিকের সব না গুলো হ্যাঁ হয়ে যায়
এসো এসো কবি
পলাশ আর কবিতা নিয়ে খেলি...

(খ)
প্রেম মেখে মেখে
তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হয়
খোলা জানালা দিয়ে শব্দ খুঁজে
এসো এসো নূপুর পায়ে
একা একা কি বসন্ত ছোঁয়া যায়?
(গ)
আমি তো তোমার কাছেই এসেছি
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রস
তুমি কোনো গন্ধ অনুভব করছো না?
(ঘ )
এসো না একবার
চুপটি করে অগোছালো চোখে
সাথে লেগে থাকুক লাজুকতা ঠোঁটে ঠোঁটে
কবিতাও সঙ্গী খুঁজতে চাই বসন্ত এসে গেলে...
বার্ণিক এর কবিতা ৯
 –
বসন্তের আগমনে
---শ্যামল দত্ত



হোলির আবির রং চারিদিকে রামধনু জাগে স্মৃতির আকাশে
প্রেম জেগেছে আপন হরষে দাও ছড়িয়ে আগুন বাতাসে,
বাঁধ ভেঙেছে মন কথা কয়
হারিয়ে যাবার নেই কোন ভয়
তরঙ্গেতে নতুন ভাষা রইলো তোমার মুক্ত আকাশে।
বার্ণিক এর কবিতা ১০ –


আগত ফাগুন বাসনা আগুন
--- শৈলেন চৌনী




মাঝে মাঝে তো তবুও দেখা হয় কতদিন না দেখা কত-কত মুখ
এ ফাগুনের পর আরও ফাগুন এসে জ্বেলে যাবে বাসনার আগুন
হবে না দেখা তবুও প্রিয় কোনো মুখ
নির্জনের গর্জন কে শোনে বলো...
কে শোনে ডাক উত্তাল সমুদ্রমন্থনের...
জানি- যে জলে আজও আমার দুঃখজল মেশে
সে জলে এসে তুমি স্নান করে যাবে কত সহজে!
আর তোমার পদচ্ছাপ খুঁজে খুজেঁ চলে যাবো তোমার বসতির কাছাকাছি
কোনওদিন সেখানে গিয়ে যদি দেখি তুমি নেই
পৃথিবীর পথগুলো দেখা হয়ে যাবে আমার
যতদূর যাবে, নিয়েই তো যেতে হবে স্মৃতির অসুখ, অমারাত্রিদের পিপাসা
তবুও দেখবে- করতলে জমা হবে শূন্যতার নামে বাড়ন্ত অন্ধকার
যতবার মনে হবে ততবার...
বার্ণিক এর কবিতা –
ফিরে দেখা
তন্তু ঘোষ
পরকে আপন আর আপনকে পর করতে করতে- রক্তেও হয়তো লেগেছে দাগ! নয়তো এ বাঁধনে কিসের এ জোর? কেনই বা মনের চতুঃসীমে  মায়াপ্রপঞ্চ শরৎ শুভ্র হিমানীশ অবগাহ! পদাঙ্ক অনুসরণ করতে করতে- অতীতের জরাজীর্ণ, বেদাগ সময়টাকে কখন ফেলে এসেছি- সময়ের বিন’ভিক্ষার কপিশ ঝুলিতে;
এখন যাযাবর কৈশরের অনাদর ছেড়ে, সমাদরে বেড়ে উঠছি তোমার হস্তান্তরে।

বার্ণিক এর কবিতা ১২



বসন্ত
পারমিতা রায়



বসন্ত ফেরে বারবার-
আমি ফিরতে পারিনা,
তুমিও ফেরোনা।
পলাশ আগুনে চারধার
চোখ ফেরাতে পারিনা
মনও ফেরেনা।
মন জ্বলে জ্বলে ছারখার –
তুমি ফিরতে পারোনা,
আমিও ফিরিনা।
সম্পাদকীয় ২
.......................................................................................................................................


ঘড়ির কাঁটাটা টিক টিক চলতে চলতে জানিয়ে যায়, সময়টা বয়ে যায়। সময়টা বয়ে যেতে যেতে কেমন যেন বদলেও গেছে। সদ্য শীতের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বসন্ত। শীতটা ঠিক কবে এলো আর গেল বা কখন! কই টের পেলাম না তো!...আসলে ব্যস্ত জীবনের আড়ালে দিন,মাস,বছরের মত হারিয়ে গেছে। সকালে স্কুল থেকে ফিরে শীতের নরম রোদে বন্ধুদের সাথে খেলা। দুপুরে মা-ঠাকুমার মুখের রূপকথার গল্প, কল্পকাহিনির পক্ষীরাজ ঘোরা অথবা উলের কাঁটা হাতে, সেলাইয়ের সুতো হাতে আচারের বাটি নিয়ে হাল্কা রোদে পিঠ সেঁকা আর হরেক গল্প-আড্ডা। বন্দি আজ জীবন এল-ই-ডি স্ক্রিনে। বন্দি আজ জীবন, তথ্য ভান্ডারের ডিজিটাল পাতায়। বন্ধুকে আজ চিঠি লিখতে হয়না। কি হবে? লিখবো কি? রোজকার খবরের আপডেট তো আপলোড থাকেই “মুখবই” এর পাতায়। সব কাজ সেরে আজ আর মানুষের হাতে সময় কোথায় যে, দু’দন্ড কাটাবে সাহিত্যপাঠে!... কবিতা তবু ছোটো তো পড়া যায়। অতবড় গল্প, উপন্যাস পড়ার জন্য অনেক সময় দরকার। ট্রেনে বাসে একটু গান শুনবো না বই পড়বো বলুন তো...একটু এন্টারটেনমেন্টও তো দরকার... অত কাজের চাপ!
বাড়ি ফিরে চায়ের কাপ হাতে হোয়াটস্‌অ্যাপে বন্ধুদের খবর না নিলে সবাই অসামাজিক বলবে। রাতের ঘুমটাও তো পরিপূর্ণ না হলে চলবে না... তাই আপাতত অবসর জীবনের জন্য তোলা থাক সাহিত্যপাঠ। ......এ বড় অসময়! তবে কি গল্প, উপন্যাস সব হারিয়ে যাবে সময়ের চোরা স্রোতে?...... না, অন্তত যতদিন সাহিত্যপ্রেমি কিছু মানুষ ও ছোটো ছোটো পত্রিকা গুলো বেঁচে থাকবে, বেঁচে থাকবে গল্প, উপন্যাস সব। চলবে এই অস্তিত্বের লড়াই। এমনই এক সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বার্ণিকের এই বিশেষ গল্প সংখ্যা...। কলম ধরেছেন অনেক সাহিত্য যোদ্ধা। 
বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
অতীতের ভার
রূপক সান্যাল




 রিক্সাটা গুঞ্জবাড়ি চৌপথি থেকে ডানদিকে বাঁক নিতেই পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো নিখিলেশ। ক’দিন আগেই দীপঙ্কর ওর নতুন বাড়িতে চলে এসেছে। তাই বাড়িটা চেনেনা নিখিলেশ। দীপঙ্কর ব’লে দিয়েছিল, একটু এগিয়ে বাঁদিকে একটা গলির মাথায় প্রথম বাড়ি। কিন্তু আশেপাশে কোন গলি চোখে পড়ছে না নিখিলেশের।
 অনেক্ষণ রিং হবার পর ফোন ধরলো দীপঙ্কর। নিখিলেশ বললো,‘কী রে,তোর বাড়িটা কোথায়? এখানে কোন গলিই তো চোখে পড়েনা!’
 ‘শোন, তুই একটা কাজ কর। ডানদিকে লক্ষ্য রেখে এগো। দেখবি পাল ফার্মাসি ব’লে একটা বড় ওষুধের দোকান আছে। ওই দোকানের সামনে তুই দাঁড়া।নিশা তোকে রিসিভ করবে।’
 ‘নিশা কেন, তুই কোথায়?’
 ‘আমি একটু বাইরে আছি। ফিরতে হয়তো রাত হবে।’
 ‘বাইরে মানে? কোচবিহারের বাইরে?’
 হ্যাঁ, আমি এখন আলিপুরদুয়ারের কাছাকাছি আছি।’
 ‘বাঃ, সেটা আগে বলবি তো! আমি তবে আজ আসতাম না।’
 ‘ডিসিশানটা হয়েছে বেলা দু’টোর পর। তুই ততক্ষণে কোচবিহারে প্রায় পৌঁছে গেছিস। কী করবো ভাই, আমার তো আর তোর মতো সুখের চাকরি নয়!’
 ‘এতটা সময় আমি কী করবো একা একা?’
 ‘একা মানে! নিশা রয়েছে তো। কলেজের পুরোনো বান্ধবীর সাথে গল্প ক’রে কাটিয়ে দে। তুই তো একটা সময় ওকে খুব চাইতিস। দেখনা, পুরোনো প্রেমটা যদি আবার জেগে ওঠে! আমার তো প্রায় পাঁচ বছর হলো, এখন আর কিছু মনে করবো না।’
 ‘তোর মুখে কিছু আটকায় না রে! তাছাড়া আমি তো ...’
 ওষুধের দোকানটা এসে গিয়েছে। নিখিলেশ বললো,‘এখন রাখছি, পরে কথা হবে।’
 রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে নিখিলেশ দোকানটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো।

 ‘তুই তাহলে এতদিনে বিয়ে করছিস?’
 ‘হুঁ, কেন, ঠিক করছি না?’
 ‘বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক ক’রে, কার্ড-টার্ড ছাপিয়ে এখন বলছিস, ঠিক করছিস কিনা? আশ্চর্য! নিশ্চই ঠিক করছিস। ... কেনরে, এখনো সন্দেহ আছে নাকি?’
 ‘না না, তা না।’
 ঘন সবুজ রঙের একটা স্লিভলেস চুড়িদার পরে আছে নিশা। চুলগুলো এলোমেলো। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। থেকে থেকে মেঘের ডাক আর বিদ্যুতের আলো। দূর থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাকের আওয়াজ। ঘরের ভেতরে কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে। সব মিলিয়ে একটা মায়াবী পরিবেশ।
 টি-পট থেকে কাপে চা ঢালে নিশা। নিখিলেশ তাকিয়ে দেখে তার আঙুলের নড়াচড়া। নিশার ওপরের ঠোঁটের বাঁদিকে ছোট একটা কালো তিল। আর দু’টো বড় বড় চোখ।এই দুইয়ের সমন্বয়ে সে পেয়েছে এক সম্মোহনী রূপ। গায়ের রঙ একটু কালো বলেই হয়তো ওর নাম রেখেছিল নিশা। কিন্তু এই মেয়েকে দেখে প্রেমে পড়েনি এমন ছেলে বোধহয় কলেজে একজনও ছিল না। এমন কী প্রফেসরদেরও কেউ কেউ....
 নিখিলেশের আরষ্ঠ লাগে। যতই কলেজের বান্ধবী হোক, এখন তো সে অন্য একজনের বউ। তাও আবার এতদিন বাদে দেখা। এরকম একলা একটা ঘরে নিশার সামনে ব’সে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে যেন কলেজের দিনগুলোতে ফিরে যায়। নিশা যখন তার চোখের দিকে তাকায় তখন নিখিলেশের সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসে।নিখিলেশ অবাক হয়ে ভাবে, নিশার প্রতি তার দুর্বলতা কী তাহলে এখনো পুরোপুরি কাটেনি!মনে মনে সে যেন কামনা করে – এই সময় আরো দীর্ঘায়িত হোক।
 বুকের ওপর ওড়নাটা একটু টেনে নিয়ে নিশা বললো,‘তুই নাকি আমায় খুব ভালোবাসতিস? কোনদিন বলিসনিতো!’
 নিখিলেশ মেঝের দিকে তাকিয়ে বললো,‘বললে কী হতো?’
 ‘কিছু হতো না, ... তবুও’
 নিশা যেন একটু উদাস হয়ে যায়। বলে,‘সত্যি, তখন যেন একটা অন্য জগতে থাকতাম। যেন সবসময় একটা ঘরের মধ্যে চলাফেরা করতাম।’
 তারপর যেন বাস্তবে ফিরে এসে বলে,‘থাক, সেসব পুরোনো কথা। এখন তোর বউ-এর কথা বল।’
 নিখিলেশ হেসে বললো,‘এখনো বিয়েই করিনি, বউ এলো কোথ্থেকে!’
 ‘সে কী রে! এখনো সন্দেহ আছে নাকি?’
 নিখিলেশের আরোষ্ঠতা যায় না। তার কথাগুলো তার নিজের কানেই বোকা বোকা লাগেছে। কথা বলার সময় নিশার বড় বড় চোখ দুটো যেন নাচতে থাকে। নিখিলেশের যেন ভেতর পর্যন্ত দেখতে পায় সে। নিখিলেশ জামার বোতাম নিয়ে খেলা করে, আঙুল কচলাতে থাকে। মাঝে মাঝে নাকের ঘাম মোছে আর নিজেকে একটু সহজ করার চেষ্টা করে।
 নিশা জিজ্ঞেস করে,‘কী নাম রে তোর বউ’এর, মানে হবু বউ’এর?’
 ‘লাবনী।’
 ‘বাড়ি থেকে ঠিক করেছে?’
 ‘নাঃ, নিজেই।’
 নিশা প্রায় লাফ দিয়ে ব’লে উঠলো,‘তাই নাকি! তুই তাহলে অনেক বড় হয়ে গেছিস, বল। আমি ভাবতাম তোর দ্বারা কখনো প্রেম হবে না।’
 তারপর আবার একটু উদাস ভাবে বললো,‘তোমার হলো শুরু,আমার হলো সারা। তাই না রে?’
 নিখিলেশ যেন দীর্ঘশ্বাস গোপন ক’রে বললো,‘তা নয় রে, নিশা। একে প্রেম বলেনা। এ হলো একরকম গুছিয়ে নেওয়া।লাবনী’কে আমি বিয়ে করছি, ওকে ভালবেসে নয়। করছি একটা সংসার দাঁড় করাবার জন্য। সেটা মানিসিক দিক দিয়ে কতটা শান্তির হবে জানিনা, তবে আর্থিক দিক থেকে সবল হবে।’
 তারপর উঠে জানলার কাছে গিয়ে বললো,‘সেইসব দিনের মতো উদ্দামতা আর নেই। শুধু ভবিষ্যৎ আর নিজেদের সুখ-সুবিধের জন্য...’
 বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। ঘরের ভেতর একটা একটা ক’রে মুহূর্তগুলো কেটে যাচ্ছে। ভালো লাগছে নিখিলেশের। নিশা তার কোন এককালের স্বপ্নের নারী। যদিও আজ ও অন্যের বউ। নিখিলেশের হবু বউ লাবনী– সেও তো অসুন্দর নয়। হয়তো নিশার চেয়েও বেশি সুন্দরী সে। হয়তো নিশার চেয়েও গুণী। তবুও ভালো লাগছে নিখিলেশের। কে জানে কেন। সে মনে মনে চাইছে, দীপঙ্কর আরো দেরি ক’রে ফিরুক।


 বারান্দা দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। এই সিঁড়ির নিচ দিয়ে চলে গেছে আরো কয়েকটা সিঁড়ি। সেটা বেয়ে নামলে একটা ছোট ঘর। ঘরটার অর্ধেকটাই মাটির নিচে। ছোট একটা দরজা, সেটা বন্ধ। ভেতর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে। নিশা দরজায় টোকা দিয়ে বললো,‘নীলিমা, দরজাটা খোল।’
 দরজাটা খুলে গেল। গোঙানির শব্দটা আরো স্পষ্ট আর তীব্র হলো। ঘরের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার। নীলিমা মেয়েটি একটা আলো জ্বাললো। ঘরে ঢুকে নিখিলেশ যে দৃশ্যটা দেখলো, তাতে তার চোখদুটো আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এলো।
 ঘরের ডানদিকে একটা ছোট বিছানা। তাতে ব’সে আছে সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা। মাথার চুল দিয়ে মুখটা ঢাকা। সেই চুলের ফাঁক দিয়ে দুটো বিস্ফারিত চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হাতদু’টো খাটের পায়ের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা। কথা বলতে গেলে জিভটা প্রায় পুরোটাই বেরিয়ে আসে। কথার একটাবর্ণও বোঝা যায় না। নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসছে সেই গোঙানির শব্দ।
 নিশা নীলিমাকে বললো,‘চুলটা বেঁধে দিসনি কেন এখনো?’ তারপর নিখিলেশের দিকে চেয়ে বললো,‘আয় নিখিলেশ, এই যে আমার মা।’
 ঘোর কাটিয়ে নিখিলেশ বললো,‘তোর মা! এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে ওঁর?’
 নিশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,‘জানিনা রে, কেউ বলতে পারেনা।’
 ‘কতদিন হলো?’
 ‘প্রায় সাড়ে তিন বছর। আমার তো আর কোন ভাই-বোন নেই, মা’কে আর রাখবো কোথায়?’
 ‘উনি কী ভায়োলেণ্ট হয়ে যান? মানে, হাত বাঁধা কেন?’
 ‘না, তা হয় না। তবে ছাড়া পেলে বাইরে চলে যেতে চায়। একবার তো প্রায় তিন দিন কোন খোঁজ খবর পাই নি। নইলে নিজের মা’কে শেকলে বেঁধে রাখার যন্ত্রনা কী কম!’
 ছোট একটা টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো। নীলিমা সেটা তুলে নিয়ে বাইরে চলে গেল। মুখটা হাতের তালু দিয়ে আড়াল করে ফিসফিস ক’রে কথা বলতে লাগলো। মনে হলো খুব গোপন কথা।
 নিখিলেশ ধীরে ধীরে নিশার মায়ের কাছে এগিয়ে গেল। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললো,‘আমি নিখিলেশ, নিশার বন্ধু। আমরা কলেজে একসাথে পড়তাম।’
 চোখদুটো বড় বড় হয়ে উঠলো ওঁর। বোধহয় একটু হাসবার চেষ্টা করলেন। কিছু একটা বলতেও চাইলেন বোধহয়। কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। বরং মুখের মধ্যে অবশিষ্ট খানকয়েক দাঁত আর জিভ এমন ভাবে প্রকটিত হলো যে, সমগ্র মুখমণ্ডল এক অশরীরী প্রেতের মত দেখতে লাগলো। হাতদু’টো তুলে আশীর্বাদ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেকলে টান পড়ায় হতাশভাবে আবার বিছানায় নামিয়ে রাখলেন।

 রাত প্রায় সাড়েআটটা। দীপঙ্করের কোন খবর নেই। নিশা কয়েকবার ওকে ফোন করার চেষ্টা করেও ধরতে পারলো না। কেবলই উত্তর আসছে –‘আউট অব রিচ।’
 ওরা আবার আগের ঘরটাতে এসে বসলো। ঘরের পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। দু’জনেই চুপচাপ। নিখিলেশ একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে লাগলো অলসভাবে। কিন্তু বারবারই সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে নিশার মা’কে।
 নিখিলেশ প্রথম কথা বললো,‘ওঁর চিকিত্‍সা করাচ্ছিস কোথায়?’
 নিশা একটা ফুলদানীতে রাখা ফুলগুলো গুছিয়ে রাখছিল। বললো,‘ভারতবর্ষের কোন জায়গা বাকি নেই। শুধু বিদেশেই যাওয়াহয়নি।’
 ‘বিদেশে যাওয়া যায় না? তোদের তো সামর্থ আছে।’
 ‘সমর্থের প্রশ্ন নয় রে। আসলে এই অসুখের কোন চিকিত্‍সা নেই। অনেক হয়েছে, আর টানাটানি করতে চাইনা। তাছাড়া বিদেশে নিয়ে যাবে কে?’
 ‘কেন,তোরাই নিয়ে যাবি! তুই আর দীপঙ্কর। হয়তো দু’একজন লোক সঙ্গে লাগবে।’
 নিশা যেন অবাক হলো। তার অবাক হওয়ার তলায় দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা চাপ পড়লেও নিখিলেশের দৃষ্টি এড়ালো না।
 নিশা বললো,‘দিপু! ও তো এখন আর মায়ের কাছেই যায় না। ও নাকি ভয় পায়। আমার মা’কে ওর বিভৎস্য কিছু একটা মনে হয়। আমি যদি আজ বলি, তাহলে ও আজই কোন হোমে-টোমে রেখে আসবে। শুধু পারেনা আমার জন্য।’
 নিখিলেশ চুপ করে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না। নিশা হঠাৎ উঠে এসে নিখিলেশের সামনে হাঁটু গেড়ে ব’সে পড়লো। মুখটা তুলে ব্যাকুলভাবে বলতে লাগলো,‘তুই আমার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখতো নিখিলেশ, আমার মুখেও কী মায়ের ওই রোগের ছায়া দেখতে পাস?’
 ‘তার মানে?’
 ‘দিপু তো তাই বলে। আর একটু বয়েস হলে আমিও নাকি মায়ের মতোই হয়ে যাব।’
 ‘কিন্তু কেন? এরকম ভাবার কারণ কী?’
 ‘সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করিস।’
 নিশা উঠে গিয়ে আবার সোফায় ব’সে পড়ে। ওর চোখদু’টো ভিজে উঠেছে। নিখিলেশ প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করার জন্য বললো,‘ওই নীলিমা মেয়েটি কে?’
 নিশা একটু ধরা গলায় বললো,‘ও আমার বোন হয়। দূর সম্পর্কের মামাতো বোন।’
 ‘তোর মায়ের দেখাসোনা করে?’
 ‘হ্যাঁ। ও আগে একটা বেসরকারী নার্সিংহোমে কাজ করতো। ওষুধ-পত্রের ব্যপারে ধারনা আছে। ইনজেকশানটাও দিতে পারে। ওরও তো বাবা-মা কেউ নেই। তাই আমার কাছেই এনে রেখেছি। তাছাড়া দু’জন আয়াও আসে দু’বেলা। পরিষ্কার-টোরিষ্কার তারাই করে। শুধু খাবারটা আমাকে খাইয়ে দিতে হয়। মা আমার হাতে ছাড়া কিছুতেই খাবে না।’
 নিখিলেশ একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে খুব। নিখিলেশ একটু ইতস্ততঃ করে বললো,‘তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো/’
 ‘বল।’
 ‘তোদের প্রায় পাঁচ বছর হলো বিয়ে হয়েছে, অথচ এখনো কোন ...’
 নিশা বুঝতে পারে। সে বলে,‘দু’বার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।’ তারপর একটু থেমে আবার বলে,‘আর এখন তো দিপু আমাকে এ্যাভয়েড করেই চলে।’
 নিখিলেশ আর এগোয় না। ভাবে,এপ্রসঙ্গ এখানে থেমে যাওয়াই ভালো। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। ব্যাঙগুলো ডেকেই চলেছে। ভরা শ্রাবণ মাস। খুব কাছেই একটা বাজ পড়লো। সেই শব্দে দু’জনেই চমকে উঠলো। দু’জনেই তাকালো পরস্পরের দিকে।
 নিশার হঠাৎ কী হলো কে জানে। সে জানালার কাছে উঠে এসে নিখিলেশের হাত দু’টো চেপে ধরে বললো,‘তুই একসময় আমাকে খুব ভালোবাসতিস, নিখিলেশ। আজও কী বাসিস?’
 নিখিলেশ কিছুই বলতে পারলো না। তার বিমূঢ়তা কাটছে না। নিশাও ব্যাকুল হয়ে ওঠে। খুব জোরে শ্বাস পড়ছে তার। সে নিখিলেশকে আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে বললো,‘চলনা, আমরা কোথাও চলে যাই। এখানে আমার আর কিছু নেই। আর লাবনীর সাথে তোর তো ভালোবাসার সম্পর্ক নয়। তবে আর অসুবিধে কী?যাবি?’
 এই প্রথম নিশার স্পর্শ পেলো নিখিলেশ। সেই কবেকার পুরোনো রাতজাগা আকাঙ্খা তার। কিন্তু এভাবে তো চায়নি সে। পরক্ষণেই তার মনে হয়, নিশা কী তাকে পরীক্ষা করছে? সতর্ক হয় নিখিলেশ। কিন্তু বুঝতে পারে, সেই ষোল বছর আগের অনুভুতি একেবারে মরে যায়নি এখনো। কলেজে পড়ার সময় কখনো ছুঁয়ে দেখেনি ওকে। আজ বুঝলো, ওর হাত দু’টো কত নরম। তখনও কী এমনই ছিল? নিখিলেশ জানে না।
 দীপঙ্কর নিশাকে অনেক ছুঁয়েছে-ছেনেছে, সেই বিয়ের অনেক আগে থেকেই। হয়তো নিশার শরীরের ঘ্রাণ ওর ইন্দ্রীয়ের ভেতর আর কোন ঢেউ তোলে না এখন। কিন্তু নিখিলেশের শরীর কাঁপতে থাকে। চেষ্টা ক’রেও সে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারলো না।
 নিখিলেশ এখন নিশাকে বলতেই পারে,‘কেন যাব?তোর সাথে গিয়ে আমার কী লাভ? তুই এখন অন্যের বউ। এতদিন তো আসিসনি আমার কাছে! আমি মুখে প্রকাশ করিনি বটে, কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই কী বোঝা যায় নি? আজকে ধাক্কা খেয়ে মনে পড়ছে আমার কথা?’
 নিখিলেশের মনের ভেতরে উপর্যুপরি ঢেউ তুলে যায় নিশা আর লাবনীর মুখ। একটা আর একটার ওপর। মুখদু’টো যেন পরস্পর লড়াইতে নেমেছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংযত ক’রে বলে,‘আর তোর মা! ওঁর কী হবে?’
 এবার ঝপ্ ক’রে নিখিলেশের হাত দু’টো ছেড়ে দেয় নিশা। সোফাতে ব’সে পড়ে বলে,‘কী মোক্ষম অজুহাতটাই না দিলি তুই। একবার হ্যাঁ বলতে পারলি না? না হয় মিছিমিছিই বলতিস!’

 ঘড়িতে ঠিক সাড়ে ন’টা বাজে। একটু আগে নীলিমা এসে ডেকে নিয়ে গেছে নিশাকে। ওর মায়ের খাবার সময় হয়ে গেছে। নিখিলেশ টেবিলের ওপর থেকে ম্যাগাজিনটা টেনে নিল।
 নীলিমাকে এবার স্পষ্ট করে দেখলো নিখিলেশ। বয়স বেশি নয়। হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি প’রে আছে। চোখে-মুখে রূপচর্চার স্পষ্ট ছাপ। রুগীর দেখাশোনা করার পর রূপচর্চার এত সময় পায় মেয়েটা? হাতে সেই মোবাইলটা। দেখেই বোঝা যায়, বেশ দামী। এত দামী মোবাইল কে দিয়েছে ওকে? নিশা? হতে পারে। সব মিলে মেয়েটাকে মোটেই ঠিকঠাক মনে হলো না নিখিলেশের। কোথাও যেন একটা গণ্ডগোল রয়েছে। নিখিলেশ ঠিক বুঝতে পারে না।
 মা’কে খাইয়ে এসে নিশা বললো,‘তুইও খেয়ে নে, নিখিলেশ। সারাদিন জার্নি করেছিস, খেয়ে শুয়ে পড়। দিপু কখন আসবে ঠিক নেই।’
 নিখিলেশ যেন এমনটাই চাইছিল। সত্যিই তার ঘুম পেয়েছে খুব। শরীর যেন আর চলছে না। নিশার কথায় কোন আপত্তি না ক’রে সে খেয়ে নিল। তারপর বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
 ঘুম যখন ভাঙলো, নিখিলেশ ঘড়িতে দেখলোসওয়া তিনটে। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে সে বারান্দায় দাঁড়াল। দক্ষিণ খোলা বারান্দা। এখন বৃষ্টি নেই। তবে ঝড়ো বাতাসটা আছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এখনো। সেই আলোয় চারদিক দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মুহূর্তের জন্য।
 নিখিলেশকে উপরের ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়াতেই একঝলক ঠান্ডা বাতাস লাগলো তার চোখেমুখে। শরীরটা যেন চনমনে হয়ে উঠলো। এখন আর ঘুম পাচ্ছে না।
 নিখিলেশ দেখতে পায় বাড়ির ভেতরে একটা ছোট্ট বাগান। নিচের ঘর থেকে সেই বাগানটা দেখা যায় না। বিদ্যুতের আলোয় সে দেখতে পায়, বাগানে একটা গাছের নিচে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। আবার সব অন্ধকার। এমনি ক’রে কয়েকবার লক্ষ্য করার পর ও বুঝতে পারে, ওরা একজোড়া নারী-পুরুষ। মনে হচ্ছে যেন পরস্পরকে আলিঙ্গনে ব্যস্ত ওরা। মেয়েটির আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে। হালকা নীল রঙের শাড়ির আঁচল। নিখিলেশের মাথার ভেতরে ধক্ করে জ্বলে উঠলো নীলিমার ছবি। হ্যাঁ, ও তো নীলিমাই। আর সঙ্গের পুরুষটি? দীপঙ্করকে চিনতে অসুবিধে হয়না নিখিলেশের। কিন্তু ও ফিরলো কখন?
 নিখিলেশ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। চোখের সামনে দেখেও তার যেন বিশ্বাস হয় না। এই কী সেই দীপঙ্কর! যে কিনা নিশাকে বাদ দিয়ে একটা দিনও কাটানোর কথা কল্পনা করতে পারতো না। সারা কলেজ যাদের প্রেমকে ঈর্ষা করতো। নিশা কী দীপঙ্করের এই নতুন সম্পর্কের কথা জানে? হয়তো জানে। তাই বোধহয় সব ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল নিখিলেশের সাথে।
 নিখিলেশের মনে  হলো এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়। কিন্তু এ বাড়িতে কী আর কোন ঘর নেই? এভাবে খোলা বাগানের মধ্যে...!
নিখিলেশের একবার মনে হলো, নিচে গিয়ে নিশাকে ডেকে আনে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—‘এই দেখনিশা, তোর প্রানের পুরুষ! যার জন্য তুই দিন-রাত বিভোর হয়ে ছিলি! আমাদের কারুর দিকে ফিরেও তাকাসনি কোনদিন।’
 কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে হলো— নাঃ, তা হয় না। এমনিতেই নিশা ভেতরে ভেতরে চুরমার হয়ে আছে। ওকে আর দুঃখ দিয়ে কাজ নেই। তাছাড়া সে তো এসব করতে আসেও নি।
 ভোর হ’তে সামান্যই বাকি। নিখিলেশ তৈরি হয়ে নিলো। সে এখানে এসেছিল তার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে। কিন্তু সেই কাজটাই করা হয়নি। দীপঙ্করের সাথে তার তো দেখাই হলো না। নিখিলেশ এসেছে জেনেও সে একবার এলো না তার কাছে! এতো বদলে গেছে ও?
 নিচে নেমে নিশার ঘরের সামনে একটু দাঁড়ালো নিখিলেশ। তারপর ব্যাগ থেকে তার বিয়ের কার্ডটা বের ক’রে বন্ধ দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। ওর হঠাৎ মনে প’ড়ে গেলো, নিশা আর দীপজ্ঙ্করের বিয়ের কার্ড পেয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে অঝোরে কেঁদেছিল সে। আজ কী নিশাও তেমনই ...?
 নিখিলেশ বাইরে বেরিয়ে এলো। এখনো ভালো করে আলো ফোটেনি। তবু পথ দেখা যায়। দু’চারজন লোক এই শেষ রাতেই হাঁটতে বেরিয়েছে। ওরা ঘুমায় কতটুকু?
 রিক্সা এখনো পথে নামেনি। নিখিলেশ জোরে পা চালায়। প্রথম বাসটা ধরার চেষ্টা করতে হবে। সে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চায় না। তার স্বপ্নের অতীত এখন পাথরের মত ভারী। একে আর বহন করতে পারছে না সে।
বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................

মান্যবর
অনিন্দিতা মণ্ডল



আজ ও সেই ছোট্ট ছেলেটা ঘাটে এসেছে। কতইবা বয়স! চার পাঁচ বছরের শিশু হবে। একদল ছেলের সঙ্গে সেও এসেছে। রোজই আসে। ছেলের দল আসে মহাচার্যের স্নানের সময়। বিক্রমশিলা মহাবিহারের একেবারে শীর্ষ প্রকোষ্ঠ থেকে একটি সিঁড়ি গুপ্তপথে সোজা নেমে এসেছে জাণ্হবী তীরে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন তিনি। মহাপুরুষের শিশুর মত মন! এই বালকের দল আসে ভিক্ষা নিতে। বিহারের আচার্যদের দেওয়া দান গ্রহন করে ফিরে যায় ঘরে। গৃহস্থ বৌদ্ধ এইভাবে দিন শুরু করে। অন্য যারা আছেন তাঁরা এ নিয়ে খুব একটা সময় ব্যয় করেন না। কিন্তু দীপঙ্কর এদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। খেলা করেন এদের সঙ্গে। বালকের দল একসঙ্গে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। তিনিও তাদের সঙ্গে জুড়ে দেন সাঁতারের প্রতিযোগিতা। শিশুর কলহাস্যে মেতে ওঠে গঙ্গার জল। আর সেই শব্দ ছাপিয়ে শোনা যায় দীপঙ্করের ভারী অথচ শিশুসুলভ হাসির শব্দ। বিহারের নবীন শ্রমনের দল কখনও এদিক পানে এলে সেই হাসি খেলার শব্দে দাঁড়িয়ে পড়ে। অবাক হয়ে দ্যাখে আচার্যের অদ্ভুত শিশুসুলভ আচরণ। কখনও তাদেরও ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে এক চিলতে হাসি। তবে এই মহাপণ্ডিতকে যতটা ভয় ও সমীহ করতে হবে বলে দ্বারপণ্ডিত বলে দিয়েছিলেন, ততটা সত্যি নয়! ইনি তো তাদের চেয়েও সরল! অধ্যাপনায় কি করেই বা বজ্রকঠিন হবেন! যে শিশুটি দীপঙ্করের কাছ ঘেঁসে এসে দাঁড়ায় কিন্তু মুখে কিছু বলেনা তাকে তিনি বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন। চোখ দুটিতে কি মায়া! দীপঙ্কর চান যে সে একবার বলুক – অতীশ কিছু দাও। কিন্তু সে বলেনা। অন্যদের সঙ্গে সেদিন গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেও। হঠাৎ দীপঙ্কর দেখলেন একি! শিশুটি তো সাঁতার জানেনা! ভেসে যাচ্ছে স্রোতে। ছেলের দল হয়ত তাকে লক্ষ্যই করেনি। বা হয়ত তাকে জলে ঝাঁপাতে বারণ করেছিল। সে শোনেনি। ক্ষিপ্রগতিতে সাঁতার কেটে এসে তিনি শিশুটিকে রক্ষা করেছিলেন। জল থেকে তুলে এনে যখন ঘাটে বসিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কেন সে সাঁতার না জেনে জলে ঝাঁপ দিয়েছে, সে কোনও উত্তর করেনি। ছেলের দল থেকে একজন বলেছিল ছেলেটি কথা বলতে পারেনা। সে মূক। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন আচার্য। এত সুন্দর শিশুটি মূক! কে বলতে পারে জন্মান্তর রহস্য! সেই থেকে এর ওপর এক বিশেষ স্নেহ জন্মেছে তাঁর। ঘাটে এসে খোঁজেন তাকে। নিয়ে যান গঙ্গায়। তাকে বুকের ওপর নিয়ে চিত সাঁতার কাটেন। শিখিয়ে দিতে চেষ্টা করেন সাঁতার। তারপর যখন দান শেষে উঠে আসেন ঘাট ছেড়ে বিহারের সোপানে, তখন ছেলের দল চিৎকার করে – ভালা হো ও নাথ অতীশ। তিনি হাসতে হাসতে উঠে যান।
 কিছুকাল পূর্বেও তিব্বতের রাজা একদল শ্রমণকে পাঠিয়েছিলেন বিক্রমশিলায়। উদ্দেশ্য দীপঙ্করকে তিব্বতে আসতে রাজি করানো। তিব্বতে ধর্ম নাশ হতে চলেছে। রাজা তার পুনরুদ্ধার চান। কিন্তু দ্বারপণ্ডিত রত্নাকর শান্তি প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন দীপঙ্করকে। ভারতবর্ষ এক ভীষণ সঙ্কটের মুখে। এসময়ে দেশত্যাগ ভারতভূমিকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার মত। তাই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই রাজপ্রেরিত দলকে। মাঝে মাঝে দীপঙ্কর চিন্তা করেন। সেই অশোক রাজার সময় থেকে বৌদ্ধধর্ম নানা শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত। রাজানুগ্রহে স্থবিরবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলেন তখন। কিন্তু বুদ্ধের স্বভুমিতে ও বঙ্গ মগধে মহাসাঙ্ঘিক মহাযানজ্ঞানীদেরই প্রভাব। আর এখন তো শতধাবিভক্ত ধর্ম! এ কেমন ধর্মের কথা ভেবেছিলেন তথাগত! দীপঙ্করও তো লোকোত্তরবাদী। তিনিও তো বিশ্বাস করেন তথাগতের অলৌকিক অস্তিত্ব জগতকে শান্তির পথে, করুণার পথে, মৈত্রীর পথে নিয়ে যাবে। তবে কেন এই ধর্মসংকট? ব্যাথিত হয়ে পোড়েন এইসব চিন্তায়। কত শত পণ্ডিত নিজের নিজের মত নিজের নিজের দর্শন প্রচারে ব্যাস্ত। কেউ ভাবেননা সমন্বয়ের কথা। এসব সময়ে তাঁর চিদাকাশে ভেসে ওঠে অবলোকিতেশ্বরের মুখ। পরম করুণায় চোখ দুটি মেলে তিনি বসে আছেন। জগতের একটি মানুষও যতক্ষণ নির্বাণলাভ করতে বাকি থাকবে ততক্ষণ তিনি নির্বাণ নেবেননা। কই তিনি তো হীনযানপন্থীদেরকে জগতের বাইরে রাখছেননা? যে সঙ্কটের কথা পালরাজা আলোচনা করেন রত্নাকর শান্তির সঙ্গে সেই রাজনৈতিক সঙ্কটের চেয়ে এই ধর্মের সংকট কি বেশি ভয়াবহ নয়? তিনি তাঁর এই প্রজ্ঞা নিয়ে এই শুদ্ধ দর্শন নিয়ে তবে কতটুকু অগ্রসর হতে পারলেন করুণার পথে? গভীর চিন্তায় ডুবে যখন বসে থাকেন তিনি তখন সেই ধ্যানমগ্ন আচার্যের কাছে কেউ ঘেঁষতে পারেনা। দূর থেকে তাকে দেখে প্রণাম জানায় ছাত্রের দল।
তিব্বতের সেই রাজা পরলোকে। আবার এসেছেন তিব্বতী রাজদুত। এবার প্রেরন করেছেন পূর্ববর্তী রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র। অধিক সতর্কতার কারণে দীপঙ্কর তাই বিহারময় জারি করেছেন এক নির্দেশ। দুতেদের কাছে তাঁর কোনও চিত্র নেই। তাই তাঁকে চিণ্হিত করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। কেউ যেন তাঁকে চিনিয়ে না দেন। এই লুকোচুরি খেলায় কিন্তু সহস্র সহস্র ছাত্র ও শিক্ষকের দল মহা উৎসাহে যোগ দিয়েছেন। তিব্বতী রাজদূতেরা ঘুরছেন সারা বিহারে। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সে উত্তর দিচ্ছে – অতীশ এখন সুবর্ণদ্বীপে। ধর্মকীর্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন। কেউ বা বলছে, অতীশ এখন জলন্ধরে। কনিস্করাজার সেই গোপন কুঠুরি খুঁজতে গেছেন। যেখানে মহাযানধর্মকে তামার পাতে খোদাই করে তোরঙে ভরে রাখা আছে। একলক্ষ মন্ত্র! কম কথা! দূতের দল অপেক্ষমান। না, তাঁরা এত সহজে হাল ছাড়বেননা। মজার কথা হল, অতীশ তাঁদের চোখের সামনেই দিনে দশবার ঘোরাঘুরি করছেন। তাঁরা ধরতে পারছেননা।
    একদিন প্রাতঃকালে প্রধান দূত বেড়িয়েছেন বিহারের বাইরে। এদিকপানে বড় কোলাহল। মানুষের ভিড়। নির্জনে বসে একটু ভাববেন কি করে দীপঙ্করের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে তা সম্ভব নয়। অজস্র মানুষ, বিপণি, শ্রমণছাত্রের বিশাল দল রাজপথে অনর্গল চলেছে। একটু নির্জনতা খুঁজতে তিনি ঘুরে ঘুরে বিহারের পিছনে চলে এলেন। বাহ, কি অপূর্ব শোভা তো এই স্থানের! বিহারের গা ঘেঁসে চলেছে বিশাল নদী। ইতস্তত গুলঞ্চ অশ্বত্থ গাছ। নিবিড় ছায়ায় নির্জন ধ্যানাসন যেন প্রকৃতির নিজের নিয়মেই গড়ে উঠেছে। হঠাৎ শিশুর কলহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠল প্রাচীরের আর এক প্রান্ত। দূত চমক ভেঙে প্রাচীরের প্রান্তে এসে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন এক মধ্যবয়সী বলিষ্ঠ পুরুষ। কি তাঁর দেহকান্তি! একদল বালক তাঁকে ঘিরে। সকলেই যেন স্নান করে উঠেছেন। পুরুষটির কোলে একটি শিশু। তিনি দেখলেন পুরুষটি সকলকে ফল ও মিঠাই দিচ্ছেন। শিশুটির মুখে তুলে দিচ্ছেন ফল, মিষ্টির টুকরো। তারপর আস্তে আস্তে তাকে নামিয়ে দিলেন মাটিতে। এবার তিনি সিঁড়িতে উঠছেন। পিছনে ছেলের দল চিৎকার করছে – ভালা হো ও নাথ অতীশ। চমকে উঠলেন দূত। এই দীপঙ্করশ্রী জ্ঞান অতীশ! তাঁর চোখের সামনে অসংখ্য বার আসছেন! অথচ একটি কাকপক্ষীও বলছেনা যে তিনিই দীপঙ্কর!
  সেদিন সন্ধ্যায় বিহারের শীর্ষ প্রাঙ্গণে সভা বসেছে। রাজদূত নিবেদন করছেন তিব্বতে ধর্মের ভয়াবহ অবস্থা। আশার কথা একটাই। রাজা নিজে এই দুর্দশা কাটাবার জন্যে সচেষ্ট হয়েছেন। রাজার অনুগ্রহে এ কাজ অসম্ভব নয়। দীপঙ্কর তাঁকে ভারতবর্ষের আসন্ন দুর্দশার কথা ব্যক্ত করলেন। জানালেন তিনিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিকরে নিজের দেশকে এই বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে যাবেন! দূত হাসলেন – আপনি রাজপুত্র। আপনার চিত্তে সেই স্বভাব এখনও প্রবল। তাই ধর্মরক্ষা নয়, স্বদেশকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষাই আপনার কাছে ধর্ম হয়েছে আচার্য! দীপঙ্করের চমক ভাঙল। তাই তো! তিনি তো রাজধর্ম পালন করছেন! তাঁর তো শুধু স্বজাতিপ্রীতিই পরিলক্ষিত হচ্ছে! জগতের কল্যাণ কামনায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন কই!
 রত্নাকর শান্তির চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক রাত্রির মধ্যযামে দীপঙ্কর বিহার ত্যাগ করলেন। সঙ্গে রইলেন তিব্বতের দূতদল। নৌকো যখন গঙ্গায় ভাসতে শুরু করেছে একবার ফিরে তাকালেন পিছনে। সেই শিশুমুখটি একবার মানসে ভেসে উঠল। প্রধান দূত কি জানি কি বুঝলেন। বললেন – মান্যবর জগতে আপনি স্বাগত!
বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
ইমোশন
------- প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ



কাল রাতে ডক্টর সেনগুপ্ত ফাইনাল চেকাপ করে গেছেন । শোভনা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ । দুর্বলতা যেটুকু আছে সেটা ধীরে ধীরে কেটে যাবে । ইউরিন ইনফেকশন থেকে ধুম জ্বর এসেছিল শোভনার । অভিজাত প্রাইভেট হসপিটালের ব্যাক্তিগত কেবিনে , দুইদিনে মোট ছয় বোতল স্যালাইন টেনে শোভনা এখন বেশ চাঙ্গা । হবে নাই বা কেন । ওর মতো এলিট ক্যাটেগরির ট্রিটমেন্ট ক’জনই বা পায় ! ওর মতো বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার বরই বা ক’জনের কপালে থাকে । সানন্দা’র পাতা ওলটাতে ওলটাতে সুদিপকে টেক্সট করে শোভনা । শোভনা জানে সুদিপের আজ ইমপরট্যান্ট মিটিং । তবুও টেক্সটটা করে । সুদিপ শোভনার জন্য এলিট ক্যাটেগরির ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা করলেও খুশি হয়নি শোভনা । সে এসময় বরকে একটু কাছে চেয়েছিল । নিভৃতে । অন্তত চেয়েছিল আজ সুদিপ ওকে এখান থেকে বাড়ি নিয়ে যাক । এইসময় সুদিপের সঙ্গ না পেলেও শোভনা নার্সের সঙ্গ পেয়েছে সারাক্ষণ । মাঝরাত অব্দি জেগে থেকে শোভনার সঙ্গে গল্প করেছে নার্স । ঠিক সময়ে এগিয়ে দিয়েছে ওষুধ । সারাক্ষণ বকিয়েছে শোভনা তবুও বিরক্তি গ্রাস করেনি নার্সকে ।
 আপনি আজ বাড়ি যাবেন ম্যাডাম ---হরলিক্সের গ্লাসটা শোভনার দিকে এগিয়ে দেয় নার্স ।  ডক্টর সেনগুপ্ত কাল রাতেই রিলিজ করে দিয়ে গেছেন । ---নার্সের হাত থেকে হরলিক্সের গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দেয় শোভনা । ---আপনি না থাকলে বোধহয় এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা হত না আমার । আপনি যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন ! সত্যি আপনি ভীষণ মানবিক । কথা বলতে বলতে শোভনা খেয়াল করে নার্স কেমন যেন অন্যমনস্ক ।
 আমি তাহলে মানবিক হতে পেরেছি ম্যাডাম – শোভনা কিছু বোঝবার আগেই প্রশ্নটা শোভনার দিকে ছুঁড়ে দেয় নার্স ।
---আপনি তো মানবিক বটেই । মানবিক না হলে কেউ নার্স হতে পারে ।
---আমি অপরাধী ছিলাম ম্যাডাম । আমি ডে কেয়ার সেন্টারে বাচ্ছাদের দেখাশুনো করতাম । বাচ্ছার বাবা – মা আমাদের কাছে বিশ্বাস করে বাচ্ছাকে রেখে যেত আর আমি সারাদিন বাচ্ছাদের উপর অত্যাচার করতাম । বাচ্ছাদের মারধোর করতাম । আমার খুব রাগ হতো ওদের দেখে । খুব হিংসে করতাম ওই নিষ্পাপ শিশুগুলোকে । ---হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে নার্স । ওর কান্না যেন অমানবিক থেকে মানবিক হয়ে ওঠার পরিচায়ক । অন্ধকার থেকে আলো খোঁজবার অঙ্গিকার ।
--- আপনার চোখের জলই বলে দিচ্ছে আপনি মানবিক হতে পেরেছেন । নিজেকে শুধরে নিতে পেরেছেন এটাই বা ক’জন পারে বলুন তো । কান্না থামান । আমায় হাসি মুখে বিদায় দিতে হবে তো ।
---জানেন ম্যাডাম যার জন্য আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম সে মানুষটা আমায় ছেড়ে চলে গেছে । শুধু বলে গেছে ‘যেদিন তুমি সত্যিকারের মানবিক হবে দেখবে আমি ঠিক তোমার কাছে পৌঁছে গেছি’ । ---বলুন না ম্যাডাম আমি সত্যিকারের মানবিক হয়েছি কিনা ?
---শোভনা ভালবাসার যন্ত্রণা বোঝে । শোভনা এটাও জানে প্রকৃত ভালবাসা যে কোনও অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পারে । কিন্তু নার্সকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা পায় না শোভনা । --- এমন সময়েই শোভনার কেবিনে প্রবেশ করে একজন শুভ্রকান্তি যুবক । ওয়েল ড্রেসড । হাতে একটা ফুলের তোরা । তোরাটার মধ্যেই একটা কার্ড ঝোলানো যাতে বড় বড় করে লেখা ‘গেট ওয়েল সুন’ ।
---দিস ইজ ফর ইউ ম্যাডাম । মিস্টার সন্দিপ রায় হ্যাজ সেন্ট দিস ফর ইউ । স্যারের কড়া নির্দেশ ছিল সকাল দশটার মধ্যে ম্যাডামের কাছে সারপ্রাইজ পৌঁছনো চাই । তাই নিজেই চলে এলাম । কোনও স্টাফকে পাঠালে স্যারের ইমোশনটা গুরুত্ব না ও পেতে পারতো । - এক নাগাড়েই বলে চলল যুবক । ক্যুরিয়ার কোম্পানির মালিক।
---বরের সারপ্রাইজে মন গলেছে শোভনার । আফটারঅল সন্দিপের ইমোশন গুলো ভীষণ চেনা শোভনার । নিজে আসতে পারে নি কিন্তু ঠিক পাঠিয়ে দিয়েছে অনুভূতি । সন্দিপকে টেক্সট করতে গিয়ে কেবিনের কোণে চোখ যায় শোভনার । দাঁড়িয়ে আছে নার্স । যুবকটির দিকে চেয়ে আছে অপলক । কথা বলার ক্ষমতাও যেন অবশিষ্ট নেই । শোভনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে যুবকটি । তার চোখেমুখে একটা অহংকার পরিলক্ষিত হচ্ছে ।  বোধহয় ইমোশন কে ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে পৌঁছে দেওয়ার অহংকার ।

বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
বিষাক্ত হাসি
রাণা পাণ্ডা



হাসি হলো মনের অবস্থা প্রকাশের একটা মাধ্যম।মানুষকে প্রাণখুলে হাসতে দেখলে সহজেই বোঝা যায় মানুষটি অত্যন্ত আনন্দিত।কথায় আছে মানুষের হাসিই কিন্তু বলে দেয় মানুষটির মন কেমন।তবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ন্যাকা হাসির প্রচলন হয়েছে।সেই সমস্ত হাসি দেখে মানুষের মন বোঝা তো দুর-অস্ত ঠিককরে এটাই বোঝা যায় না সে হাসার চেষ্টা করছে না হাসছে।কিছু-কিছু মানুষের হাসির আওয়াজ এতো বেশি যে পাশের বাড়ির লোকজনও শুনতে পায়।বিভিন্ন মানুষের হাসির ভঙ্গি বিভিন্নরকম।বর্তমান যুগে হাসির অভিনয় করতে করতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে কেউ যদি প্রাণখোলা হাসিও হাসে তবুও সন্দেহ থেকে যায় সে সত্যি সত্যি হাসছে তো নাকি হাসার চেষ্টা করছে।
হাসি আমাদের জীবনে একটি অপরিহার্য জিনিস।মুচকি হাসি নামক হাসিটির গুরুত্বও নেহাত কম নয়।এই হাসি দেখে মানুষকে আনন্দিত মনে হলেও সেই আনন্দ কিন্তু অন্য প্রকারের আনন্দ।মানুষের মনের ভিতরে পুলকি না জাগলে সাধারণত এই হাসি আসে না।মানুষের দুঃখ-কষ্ট চিরকালই থাকে, কিন্তু এই দুঃখের মধ্যেও হাসিই সাময়িক আনন্দ দান করে।একটু বাড়িয়ে বললে সাময়িক সুখ দান করে।আবার এই হাসিই মানুষের দুর্ভোগের কারন হয়।দুর্বলকে ব্যঙ্গ করার ক্ষেত্রে কিন্তু এই হাসিই দায়ি।প্রেমের ক্ষেত্রেও কিন্তু এই হাসির অবদান নেহাত কম নয়।কথায় আছে- হাসি তো ফ্যাসি।কিছু কিছু মেয়ের হাসি দেখেই তো ছেলেরা প্রেমে পড়ে যায়।
এছাড়া ভয়ের হাসিও তো নেহাত কম নেই।এই ধরুন বদমায়েশদের হাসি,সর্বোপরি ভূতের হাসি- সে তো ভয়ংকর মশাই!
      হাসি নিয়ে দীর্ঘ একটি বক্তৃতা দেওয়ার পর অমলেশ বাবু চুপ করলেন।তারপর ডায়েরিটা বন্ধ করে ব্যাগে পুরতে পুরতে পাশের শীটে বসা অনিলবাবুকে বললেন- বুঝলেন মশাই,আমার দেখা প্রায় সমস্তরকমের হাসিই আমি নোটবুকে লিখে রেখেছি।কথাটা শেষ করেই হি হি করে হেসে উঠলেন অমলেশ বাবু।
অমলেশ বাবু পেশায় একজন বাংলার শিক্ষক।সদ্যই লেখা-লেখির সাথে যুক্ত হয়েছেন।তাই তিনি চাইছেন হাসির ওপর একটা লেখা লিখতে।সেই জন্য যখনই তিনি নতুন রকমের হাসি দেখেন তখনই তা লিখে নেন তার ডায়েরিতে। অমলেশ বাবু বেশ হাসিখুশি মানুষ,কেউ কোনদিন তাকে দুঃখ পেতে দেখেনি।অমলেশ বাবুর মনে হয় বর্তমানে এই কর্মব্যস্ত জীবনে মানুষের হাসিটা ফিকে হয়ে গেছে।তিনি লক্ষ্য করেছেন এখন মানুষের হাসিটা কেমন যেন বিষন্ন।
 সেদিন গিন্নীর কি এক কথা শুনে অমলেশ বাবু হো হো করে হাসতে শুরু করে দিলেন।সেই হাসি যেন থামতেই চায় না।গিন্নী যতই হাসতে বারণ করেন ততোই যেন আরোও বেশী করে হাসি পায় তার।তিনি চাইলেও যেন সে হাসি থামাতে পারছেন না।শেষ অবধি হাসি যখন থামল পেটে ব্যাথা ধরে যাওয়ার অবস্থা।গিন্নী তো সটান বলে দিলেন- এই বয়সে এতো হাসি ভালো নয়,বলে দিলুম।
  অমলেশ বাবুর মনে হলো এ হাসি তো একেবারে অদ্ভূতূড়ে হাসি, পেটে ব্যথা ধরিয়ে দিল।
সাথে সাথেই অমলেশ বাবু তার ডায়েরি খুলে এই নতুন ধরনের হাসির কথা লিখে নিলেন।লিখলেন- এ হাসি এক ধরনের অদ্ভূতূড়ে হাসি,অলৌকিক ও বলা চলে।কখন যে আসে আর কখনেই বা চলে যায় তা নিজেও জানতে পারবেন না।কিন্তু যখন আসবে তখন পেটে ব্যথা ধরিয়েই যাবে।
অমলেশ বাবু শহরে থাকেন কিন্তু তার স্কুল গ্রামে।তাই ওনাকে নিয়মিত শহর থেকে যাতায়াত করতে হয়।তিনি রোজ বাসে করেই যাতায়াত করেন।গত পনেরো বছর ধরে তিনি এমনটাই করে আসছেন।গ্রামের মানুষেরা তাকে বড্ড ভালোবাসে।তাই গ্রীষ্মের ছুটি কিম্বা পুজোর ছুটিতে যখন স্কুলে যেতে পান না,তখন তার প্রাণটা যেন হাঁপিয়ে ওঠে।
শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হওয়ার পর প্রায় বেশ কয়েকবছর তিনি গ্রামেই স্কুলের কোয়ার্টারে থাকতেন।নিজের গ্রাম না হলেও গ্রামটাকে তিনি বড্ড বেশী ভালোবেসে ফেলেছিলেন।তাই যখন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে  আসতে হয়েছিল,তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।
গ্রীষ্মের দুপুর।চারিদিকে কোথাও তেমন লোকজন নেই।অমলেশ বাবু দাঁড়িয়ে আছেন অটো ধরার অপেক্ষায়।পুরো শরীর থেকে ঘাম ঝরছে-এক রকম বিস্রী পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছেন অমলেশ বাবু।তার জামা ঘামে এক্কেবারে  ভিজে গেছে।এমন সময় একটা অটো এসে দাঁড়ালো অমলেশ বাবুর সামনে। খালি অটো পেয়ে তিনি সাথে সাথেই উঠে পড়লেন।এতোক্ষণে অমলেশ বাবু স্বস্তীর নিশ্বাস ছাড়লেন।
কিছুদুর যাওয়ার পরেই অটোটাতে তিনজন মহিলা উঠলেন।দেখেশুনে বেশ ধনী ঘরের বলেই মনে হল অমলেশ বাবুর।কিছুক্ষণ গল্প করার পর ওই তিন মহিলা মুচকি মুচকি করে হাসতে লাগলেন।অমলেশ বাবু বুঝতে চেষ্টা করলেন ঠিক কি কারণে ওরা হাসছেন। বেশ কিছুক্ষন পর অমলেশ বাবু খেয়াল করলেন,ওই তিন মহিলা তাঁকে দেখেই হাসাহাসি করছেন। তাদের চাউনি দেখে এটা স্পষ্ট।অমলেশ বাবুর পুরো জামাটাই ঘামে ভিজে গেছে-সম্ভবত এটা নিয়েই ওই তিন মহিলা হাসাহাসি করছেন।
যে মানুষটা অন্য কাউকে হাসতে দেখে খুশি হয়,সেই মানুষটা আজ হাসতে দেখে বিরক্ত হচ্ছে।অমলেশ বাবু বেশীক্ষণ হাসিটাকে সহ্য করতে পারলেন না।তার মনটা যেন বিষিয়ে উঠল।সেই হাসি তার পিত্তি জালিয়ে দিচ্ছে। এ হাসি ভয়ংকর-মুহূর্তের মধ্যেই এই হাসি মানুষের মধ্যে ক্রোধ সঞ্চার করে।অমলেশ বাবু নিজের মনকে শক্ত করলেন,তারপর তার ডায়েরিটা খুলে লিখতে শুরু করলেন- এই হাসিকে ঠিক হাসি বলা চলে না।এ হাসি মানুষের মধ্যে ক্রোধের  সঞ্চার করে।এ হাসি বিষাক্ত।।বিষাক্ত হাসি।
শেষটায় ওই তিন মহিলার দিকে তাকিয়ে মুচকি  হাসতে হাসতে অমলেশ বাবু লিখলেন- হাসি স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক।কিন্তু বিষাক্ত হাসি-একেবারেই নয়।
বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
শিক্ষা
অভিজিৎ মান্না


ঢং - ঢং - ঢং..... ছুটির ঘন্টা বাজার সাথে, সাথেই তুলিকা ব্যাগ নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে ক্লাস-টুর ক্লাসরুম থেকে। হাত গলিয়ে পিঠে ব্যাগটা নিতে নিতে পড়িমরি করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে দৌড়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বেরিয়ে পরে রাস্তায়। কিন্তু, এসে হতাশ হয়। 'তার বাবা এখনো তাকে নিতে আসেনি-! কিন্তু কেন-? স্কুল কি আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে-! নাকি সে ভুল করে ছুটির আগেই নেমে এসেছে-!' ভাবতে থাকে তুলিকা। 'বাবা তো রোজই আগে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করে-!'
হৈ-হৈ করে তার বন্ধুদের নেমে আসতে দেখে বুঝতে পারে সে কোনো ভুল করেনি-- 'সত্যিই স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। তাছাড়া অনেকেরই বাবা-মা এসে গেছে ; শুধু আমার বাবাই আসতে দেরি করছে-! ধুত ভাল্লাগেনা-!' --- ছোট্ট তুলিকা বুকের গভীরে বহু অভিমান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে বাবার জন্যে। ঘাড় ঘুরিয়ে, ঘুরিয়ে দেখতে থাকে এদিকওদিক........
সেই রোজকার ফুচকাওয়ালা-টা আজও দাঁড়িয়ে আছে ; তার কয়েকজন বন্ধু ও তাদের মা মিলে ফুচকা খাচ্ছে। আইসক্রিমওয়ালা-টা আইসক্রিম দিচ্ছে আর ঘণ্টি বাজিয়েই চলেছে। রাস্তার ওপারে পার্ক-টায় প্রতিদিনকার মতো আজও সেই বুড়োদাদু আর ঠাকুমা হাত ধরে একটা বড়-পাথরের উপর পাশাপাশি বসে আছে।  কি যেন গুজগুজ করছে তারা, 'ধুত-! রোজেরই তো করে-!'
এদিকওদিক তাকাতে, তাকাতে তুলিকার নজর আটকে গেল এক কিশোরীর দিকে। একে আগে কোনদিন দেখেনি সে। ঠিক তারই সমবয়সী একটা মেয়ে। যেন ঠিক তার মতোই কতকটা মুখের আদল-!  তবে, মেয়েটার গায়ে নোংরা ছেঁড়া জামা। সমস্ত শরীর, মুখ ধূল-বালিতে মাখা। মাথায় জট-পাকানো রুক্ষ লালচে চুল। মেয়েটাকে দেখে তুলিকার কচি মনে হাজার ভাবনার উদয় ঘটে--- 'মেয়েটাকি কোনদিন স্নান করেনা-! মাথায় শ্যাম্পু মাখেনা-! এমা ছেঁড়া জামা পরেছে কেন-?  মেয়েটার কি সাজতে ভালো লাগেনা-! ওকে কি কেউ সাজিয়েও দেয়না-! মেয়েটার বাবা-মা মেয়েটাকে বকেনা কেন-? কানমলা দেয়না কেন-? মেয়েটার বাবা-মা খুব বাজে খুব খারাপ।' 
তুলিকা লক্ষ্য করে মেয়েটা তার বন্ধুদের বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে হাত পেতে কি যেন বলছে; কিন্তু, সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, পিছু ফিরে দাঁড়াচ্ছে। তাকে দেখে তুলিকার খুব কষ্ট হয়, বুকের ভিতরটা কিরাম যেন করে ওঠে তার। 'কেন তার সাথে কেউ কথা বলতে চাইছে না-! কেন সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে-! ওর বুঝি কোনো বন্ধু নেই-! ও মনে হয় খুব বিপদে পরেছে, তাই বুঝি সবাইকে কিছু বলতে চাইছে।' তুলিকার মনে উপকার করার বাঞ্চা জেগে ওঠে, সে এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে........
ঠিক তখনি তুলিকাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেড-মাষ্টার পরেশ বাবু স্কুলের গেট পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন। ছেঁড়া-বস্ত্র পরা মেয়েটি এগিয়ে যায় পরেশ বাবুর দিকে--- পিছনদিক থেকে ডান হাত-টা টেনে ধরে। পরেশ মাষ্টার বেশ অবাক ও বিরক্তিমাখা মুখে পিছু ফিরে চায়।  মেয়েটি করুণ কণ্ঠে বলে ওঠে-- "বাবু, দুটো পয়সা দিন-না বাবু। তিনদিন কিছু খাইনি বাবু। বড় খিদে পেয়েছে বাবু। দিননা বাবু। দিননা।" পণ্ডিত-মশাই যেন তৎক্ষণাৎ ক্ষেপে উঠেন--  "এই হাত ছাড়, ছাড় বলছি। যা এখান থেকে। বিদায় হ।"
"দিননা বাবু দিননা। দুটো পয়সা দিননা। বড় খিদে পেয়েছে।" মেয়েটি কিছুতেই হাত ছাড়তে চায়না, আরো জোরে চেপে ধরে।
ভদ্রলোক তার হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। অবশেষে চোখেমুখে একরাশ ঘৃণা এনে ভদ্রলোক হাত ছিনিয়ে নিয়ে একটা জোর ধাক্কায়  ঠেলে ফেলে দেয় সেই অসহায় অনাথ কিশোরীকে।
তুলিকা ছুটে যায়। তাকে তোলে। গা,হাত ঝেড়ে দেয় তার। তারপর পরেশ বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে-- "স্যর, এটা আপনি কি করলেন-! এমা আপনি জানেননা, কাউকে কোনদিন কষ্ট দিতে নেই-! কাউকে কষ্ট দিলে নিজেকেও কষ্ট পেতে হয়। আমাদের বাংলা টিচার কমলা দি-ভাই একথা বলেছে, আপনি শিখে নেবেন।"
পরেশ স্যরের মাথায় এবার যেন খুনচড়ে যায়। তুলিকার দিকে রক্তবর্ণ চোখে কটমট করে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বলে ওঠেন-- "এই তুই জানিস তুই কার সাথে কথা বলছিস-? বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না-?"
"আমি ভুল কি বললাম স্যর-? যেটা টিচার শিখিয়েছে সেটাই তো বললাম স্যর-! আপনি বোধয় শেখেননি, দি-ভাইকে বলে দেবো আপনাকে শিখিয়ে দিতে।"
"অসভ্য, ছোটলোক, অশিক্ষিত, নিকৃষ্ট কোথাকার; ছোট হয়ে বড়, বড় কথা।" -- বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে ওঠে পরেশ বাবু। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তুলিকাকে কষে একটা চড় মারার জন্য হাত তোলেন ভদ্রলোক। ছোট্ট তুলিকা তার দোষ খুঁজে না-পেয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে কাঁদোকাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু প্রায় শেষ মুহূর্তে হেড-স্যরের হাত ধরে ফেলেন তুলিকার বাবা সুকুমার বাবু। সুকুমার বাবু কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন, তার কন্যা ও স্যরের সমস্ত কথাই তিনি শুনেছেন। তাই হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন-- "তা আমার মেয়ে কি কারণে মার খাচ্ছে জানতে পারি কি মাস্টারমশাই-?"
"ও এই অশিক্ষিত-টা তাহলে আপনার মেয়ে, কি ভালো শিক্ষা দিয়েছেন মেয়েকে-! ছিছিঃ ছিঃ-!"
"সত্যিই ভালো শিক্ষা দিয়েছি। আমি গর্বিত যে ও আমার মেয়ে। তবে কি জানেন-তো আমি ওকে এই স্কুল ছাড়িয়ে দেবো; যে স্কুলের শিক্ষকই মূর্খ, সেই স্কুলের শিক্ষা আমি আমার মেয়েকে নিতে দেবো-না। আপনার স্কুলের বিদ্যার্থীরা আপনার শিক্ষাই পাবে কি-না।"
"আপনার সাহস তো কম নয়-! আপনি হেড-মাস্টারের সাথে এইভাবে কথা বলছেন-!"
সুকুমার বাবু ঠোটের কোণে মৃদু হেসে বললেন-- "হেড-মাস্টার আপনার পাণ্ডিত্য দেখে আমি সত্যিই অবাক-! আপনি সত্যিই মূর্খ। উচিত কথা বলতে সাহসের দরকার হয় বলে তো আমি জানিনা-! শুধু কয়েকটা ডিগ্রী থাকলেই যে শিক্ষিত হওয়া যায়না, এর দৃষ্টান্ত তো আপনি নিজেই। আপনি বিজ্ঞ মানুষ, আপনার অনেক সুখ্যাতি আছে; কিন্তু আপনি কতটা অজ্ঞ তা-কি আপনি জানেন-? আপনি কোনো নামকরা স্কুলের হেড-মাস্টার হতে পারেন, তবে আমার মেয়ে অপনার থেকে শতগুণ বেশি শিক্ষিত।" -- এর প্রতিবাক্য কি হবে সেটা পরেশ বাবুকে ভাববার সময় না-দিয়েই সুকুমার বাবু রাস্তার অপর-প্রান্তে তর্জনীনির্দেশ করে আবার বললেন-- "ঐ দেখুন শিক্ষা কাকে বলে-- শিক্ষা, একেবারে খাঁটি শিক্ষা। এই শিক্ষা পয়সা দিয়ে কেনা যায়না, তাই এই শিক্ষার কোনো ডিগ্রী-ও হয়না।"
পরেশ বাবু এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখেন-- তুলিকা তার ব্যাগের উপরের চেনটা খুলে হাতের-তালুতে সমস্ত খুচরো-পয়সা জড়ো করে চলেছে। তার চোখ উজ্জ্বল, সমস্ত মুখ জুড়ে খুশি ছড়িয়ে আছে। আর সেই নাম না-জানা অভাগী মেয়েটা একটার পর একটা ফুচকা মুখে পুরছে।  তুলিকার শিক্ষা যেন এক সার্থক রূপ পেয়েছে। 
সুকুমার বাবু এগিয়ে যান তার তনয়ার দিকে। হেড-স্যর পরেশ বাবু একভাবে তাকিয়ে থাকে তুলিকা আর অভাগীর দিকে। ঠিক তখনই যেন কোনো গাছের মগডাল থেকে ডেকে ওঠে এক নাম না-জানা পাখি। যেন তার কানে কানে বলে যায়-- "যে শিক্ষা মানুষের দুঃখ, কষ্ট মুছেই না দিতে পারলো, সে শিক্ষা কেমন শিক্ষা হেড-মাস্টার-?  তুমি শিক্ষিত হও হেড-মাস্টার, তুমি শিক্ষিত হও। তোমায় যে অনেক-কে শিক্ষা দান করতে হবে। তোমার উপর যে অনেক ভার। তোমার হাতেই দাঁড়িয়ে আছে কালকের ভবিষ্যৎ।  শিক্ষিত হও হেড-মাস্টার, তুমি শিক্ষিত হও।"
 [ গল্পটি কাল্পনিক ]
বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
প্রনয় স্মৃতি
সুমন কান্তি দাস।।


""ভালোবাসা মানেনা বাঁধা
এতো দক্ষিনের হাওয়া,
লাগলে পরে গায়ে
মনে জাগে নেশার ফোঁয়ারা।""
অতঃপর আমি বিদ্যালয়ের একেবারে পুব দিকের দোতলার সায়েন্স রুমের বারান্দার
রোয়াকে বসলাম।তখন টিফিন চলছে।
এমন সময় বিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকে তিনতলায় পাম গাছের আড়ালে আমার দৃষ্টি
হঠাত্‍-ই থমকে গেলো।দেখলাম-
এক মেয়ে তার সহপাঠির সাথে গল্প করছে।তার কথার ভাষা আমার কানে না এলেও তার
নিষ্পাপ শরীরের ভাষা ঠিকই এসেছিল।আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম অপলক
দৃষ্টিতে।কেন জানিনা আমি আমার চোখটাকে ঐসময় অন্য দিকে মনোনিবেশ করতে
পারলাম না।মনে হয়েছিল যেন আমার শরীরের সমস্ত শক্তি চোখে এসে মিশেছে
শুধুমাত্র তারই দিকে দৃষ্টি দিতে। তখনই বোধহয় তার প্রতি আমার শরীরটা
দূর্বল হয়ে পড়েছিল।যেন একটা অন্য জগতে অন্য রূপে অন্য ধ্যানে
ছিলাম।হঠাত্‍ ই ঢং ঢং করে টিফিন শেষের বেল বেজে উঠলো।মনে হলো কে যেন
হিংসে করেই আগেভাগে বেল বাজিয়ে দিয়েছে।
      তারপর থেকেই আমার মনটা চনমনা হয়ে উঠলো,কিছুটা ভাবুক,কিছুটা
লাজুক।তাকে দেখলেই আমার শরীরের সমস্ত অঙ্গ ক্ষনিকের জন্য শিথিল হয়ে
যায়,চোখ অনাবিল তৃপ্তি অনুভব করে আর মন ফুরফুরে বাতাসের মতো চঞ্চল হয়ে
ওঠে।এভাবে ধীরে ধীরে আমার মনের ছোটো কুঠুরিতে তার প্রতি একটু একটু
ভালোবাসা জমা
হতে লাগলো।
তার প্রেমে পড়েছিল প্রথম আমার চোখ তারপর মন আর এখন আমার প্রতিটি অঙ্গ।
           আমার জীবনে প্রথম কাউকে ভালোবাসা এবং তাকে ঘিরে নানা পাগলামির
চরম সীমায় পৌছানোর সূত্রপাত হয় সেই মেয়েটিকে নিয়েই তখন আমি একাদশ
শ্রেনীতে পড়াশুনা করছি।সবে মাত্র
মাধ্যমিক পাশ করেছি আর সাথে সাথে ভালোবাসতেও শিখেছি।আমাদের এক শিক্ষক
বলেছিলেন--'মাধ্যমিক পাশ করার পর এই সময়টা একটু সাবধানে থাকো,কারন এই সময়
তোমরা যাকে দেখবে তাকেই ভালোলেগে যাবে।আগে নিজের ভবিষ্যত্‍ তৈরি করো।এইসব
পরে করার অনেক সময় পাবে।'
তিনি বলেছিলেন কারন তিনি জানতেন যে ,এই সময় অনেক ছাত্রছাত্রী পথ ভুল করে
তলিয়ে গেছে।তারও জীবনে এই সময়টা এসেছিল একদিন,তাই তার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তার এই কথাটি আজও স্মৃতিতে হিরকের মতো জ্বলজ্বল করছে, তবুও তার কথা আমি
রাখতে পারিনি।
শেষ অব্দি প্রেমেতেই পড়ে গেলাম।
             আমি মাধ্যমিক পর্যন্ত বেশ ভালোই ছিলাম বলতে গেলে।আমাদের
ক্লাসের সহপাঠি মেয়েদের থেকে দূরে দূরে থাকতাম।ক্লাসের হাতেগুনা
কয়েকটা মেয়ের নাম জানতাম।কোনো মেয়ের নাম জানার চেষ্টা বা ইচ্ছা কোনটাই
ছিল না।তখন কোনো মেয়ের পেছনে সময় নষ্ট করার মতো মানসিকতা আমার মাথাতেই
ছিল না।সেইসময় মেয়েদের সাথে কথা বলতেই ভয় করতো,প্রেম করা দূরেই কথা।
কিন্তু আজ কোনো সহপাঠি মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভয় করেনা তবে হ্যাঁ, লজ্জা
করে,ঐ মেয়েটির আভাস ই আমার জীবনকে পরিবর্তনের শিখরে তুলে দিয়েছে।
      যাকে ঘিরে পাগলামি সে আর কেউ না ,সে আমাদের ক্লাসেরই সহপাঠি।আর্টস
বিভাগের ছাত্রী।তার নাম "মোনু"।ভালোবেসে আমি নাম দেয়েছিলাম "ভাবনা"।
   একটা মেয়ের মধ্যে যতগুলি গুন থাকা দরকার,আমি তার মধ্যে তা দেখেছি।
বিশেষ করে তার চুল আমাকে তার প্রতি তীব্রভাবে আকৃষ্ট করতো।আমি হলফ করে
বলতে পারি,তার চুলের মতো অধিকারিনী আমাদের বিদ্যালয়ে কেউ ছিল না।তার
চোঁখ,তার মুখ আর হ্যাঁ তার নাক সবকিছুই প্রকৃতি যেন ধাপে ধাপে সাজিয়ে
রেখেছে।তার সৌন্দর্য যেন অবিনশ্বর।মনে হয় সে যেন এক সদ্যফোঁটা গোলাপ,তার
পাপড়ি মিলে বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে আমাকে ডাকছে তার সাথী হতে।
   তার মধ্যে ছিল এক আকাশ শুদ্ধতা,ভোরের নীরবতা,এক মেঘ অভিমান,এক পৃথিবী ভালোবাসা।
   সে যেন আমার শীতের ভোরে এক চিমটি রোদ।গরম দুপুরের শীতল ছাওয়া,শরতের
সন্ধ্যারাতে উচ্ছ্বসিত কাশফুল, বসন্তের  সুরের মালা,বর্ষার রাতের রিমঝিম
নীরবতা।
         তাকে আমি বহুদিন থেকেই জানতাম।কোনোদিন কথা বলিনি।কোনোদিন তাকে
নিয়ে ভাবিনি।কিন্তু সেইদিন,হ্যাঁ সেইদিন তাকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে নতুন
রূপে নতুন করে জানতে শিখি।
এই কথাটা আমার সহপাঠিদের কানে যেতেই তারা আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে
শুরু করে।আর বলে- "তুই এতোদিন ধরে তাকে দেখছিস সেই ফাইভ থেকে আর তোর এই
ইলেভেন এই ওকে ভালোলাগলো?"
   সেইসময় আমার সহপাঠীদের প্রশ্নে নির্বাক ছিলাম।আমি ওদের বলতে গিয়েও
বলতে পারলাম না যে "কখন,কেন,কিভাবে মানুষের মনে কাকে ঘিরে ভালোবাসা বাঁসা বাঁধবে তা
কেও জানে না"।।
বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
টিকটিকি
শুভঙ্কর দে



বর্ধমানে এম.এ. পড়বার জন্য একটা মেসে যখন থাকতে শুরু করি তখন বর্ধমানের সব কিছু অচেনা। আমি কাউকে তেমন একটা চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না। সারাদিনের পর সন্ধ্যা নামলে মেসে ফিরতাম। চেনা মুখ বলতে আমার রুমমেট। এভাবেই ছিল দিন যাপন । কিছুদিন পর আমাদের থাকার ছোট্ট আস্তানায় কারা এসে জুটলো, অনাহুতের মত দুটো টিকটিকি। সন্ধ্যে থেকেই তাদের হুটোপুটো শুরু হতো। প্রথম প্রথম ঠিকই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে দেখলাম ঘরের মধ্যে ধুলোর সঙ্গে পড়ে আছে কালো কালো টিকটিকির গু। মাথাটা গেল গরম হয়ে, রুমমেটকে বললাম " দ্যাখ শালা উদ্বাস্তু দুটোর কাজ, খাচ্ছে দাচ্ছে আর ঘরের মধ্যে সব সারছে"।শুরু হল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। যেমন করে হোক ব্যাটাদের ঘর থেকে বার করতেই হবে। একটাকে বার করি তো আর একটা যায় না, একজনের টানে  দু'দিন পর বেরিয়ে যাওয়া টিকটিকিটা এসে আবার হাজির হয়। বুঝলাম এ দু'জনে নিশ্চয় প্রেমিক প্রেমিকা। নয়তো এদের মধ্যে কোনোদিনও মারামারি করতে দেখলাম না, মাঝে মধ্যে অবশ্য রাগ-অভিমানের বোঝাপড়া দেখতে পাই-- একজন উত্তরকোণে তো অপরজন দক্ষিণ কোণে। তবে তাদের দৌলোতে ঘরের মধ্যে পোকার উপদ্রপ থেকে রেহায় পাওয়া গেছে। দিন যায় রাত যায়, মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভাঙে, যেমন করে ভেঙে পড়ে নদীর পার। এবারে শীতটা দু'দিন পড়ল বেশ জাকিয়ে। লক্ষ্য করতাম টিকটিকি দুটোর প্রাণ চঞ্চলতার নিস্তব্দতা। চুপটি করে দু'জনে দেয়ালের মধ্যে লেপটে থাকতো। খিদে পেলে দু'একটা পোকা মাকড় খেত, বাকি সময়টা দু'জনে পাশাপাশি নিশ্চুপ,নিশ্চল হয়ে সেঁটে থাকত দেয়ালে। শীত গেল, এল বসন্ত। প্রকৃতির বুকে সকলের মধ্যে একটা রোমাণ্টিক রোমাণ্টিক ভাব। প্রকৃতির কি লীলা!! শুধু মানুষ না, গাছ-গাছরা, পাখ-পাখালী সবাই মেতে ওঠে বসন্তের হাওয়ায়। আমাদের রুমের টিকটিকি দুটোও ব্যতিক্রম নয়। বেশ চলছিল তাদের জীবন। এমন সময় ঘটল একটা ঘটনা।
সন্ধ্যের সময় বসেছি পড়তে। তখন সময় ঘড়িতে আটটা কি সাড়ে আটটা। হাতে প্রবোধকুমার সান্যালের 'মহাপ্রস্থানের পথে' প্রবন্ধটি। এত ভালো গদ্য আর ভ্রমণের অমন চিত্র, পড়তে পড়তে আমিও লেখকের সঙ্গে হেঁটে চলেছি কেদারনাথের সুমুখে বরফাবৃত উৎরাই চড়াই বন্ধুর পথে। হঠাৎ ছন্দপতন। ঝুপ করে আওয়াজ। নানা এটা বই এর মধ্যে নয়। আমাদের মেসের রুমটায়। আমি সেদিন একা। শব্দটা শুনে চুপ করে বইটি বন্ধ করে বসে রইলাম। ঘোর যখন ভাঙলো বেড থেকে নেমে দেখলাম ওই টিকটিকি দুটোর একজন মুখ থুবরে পড়ে। বুঝলাম শিকারের ঝাপ। রাত সাড়ে দশটা। ডিনার শেষে ঘামছায় হাত মুছতে মুছতে ওদিকে গিয়ে দেখি এ কি কাণ্ডরে বাবা!এ টিকটিকি তখন থেকে এভাবেই পড়ে কেন? পায়ে করে নাড়িয়ে দেখলাম, না, এর তো নো শব্দ, নো চলনবলন। বুঝতে আর বাকি রইল না। মনে মনে বললাম এই রাতবিরিতে তোকে মরতে হল। হায় রে! এখন তোর সৎকার করি কী ভাবে? কোনো রকমে পায়ে করে ঠেলে ঠেলে দরজার কাছে নিয়ে গেলাম। এবার উপায়? বার করি কি করে? হাত দিয়ে তুলতেও গা করছে শিরশির। যতই হোক আমি তো মানুষ। ক্ষুদ্র প্রাণীকে ছুঁতে ঘিনঘিন তো করবেই। তবু নিরুপায়। হাত দিয়েই তুলতে হবে এ যে ভাগ্যের খেলা। নীচু হয়ে হাত দিয়ে তুলতে যাব এমন সময় মাথাটা গেল ঘুড়ে। চোখের সামনে একটা নিথর দেহ; মৃত্যু কত শান্ত অথচ ভয়ানক। আমার হাত কোনো মতেই টিকটিকিটাকে স্পর্শ করতে পারছে না। মৃত্যু বুঝি এরকই হয়? তখন সে এই জগতের সীমা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে কোনো এক অমর্ত্যলোকে। সে এখন মৃত্যুর অবয়ব ধরে আমার সামনে। এ যেন নবারুণের হারবাট। মাথার মধ্যে এরকম এবড়ো খেবড়ো নানান চিন্তা ভীড় করছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে শত শত শব্দ। যাদের ঠিক মতো ধরতে পারলে জন্ম দেওয়া যায় সাহিত্যের। হঠাৎ বাইরে মেসের মালিকের গলার আওয়াজে আমি জেগে উঠলাম। উনি দেখে বললেন "এক্ষুণি এটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসো, যত সব আবর্জনা।" সত্যি আবর্জনাই বটে। ফেলে দিয়ে এলাম পুকুরের জলে। পুকুর পারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। চারিদিকে চাঁদের আলোয় ছেয়ে গেছে, বসন্তের হাওয়া বয়ছে শিরশির করে, তিড়তিড় করে নড়ছে সমস্ত গাছের পাতা । শরীরে বসন্তের হাওয়া মেখে রুমে ঢুকলাম। চোখ গেল দেয়ালে। যাদের তাড়াবার জন্য একদিন যুদ্ধের আয়োজন করেছিলাম অথচ তারাই আমাদের সর্বকালীন সঙ্গী ছিল, আজ তাদের একজন নেই, অপরজন চুপটি করে দেয়ালে সেঁটে রয়েছে। ও কি জেনেছে ওর সঙ্গী চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল? ও কি শোকে বিহ্বল? হতেও পারে, ওরা তো মানুষ নয় যে শোকে চিৎকার করবে। ওর কষ্ট আজ শুধু ওর একার। জানলা খুলে শুয়ে পড়লাম। খুব সকালে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুমটা গেল ভেঙে। অব্যেশমত দেয়ালে তাকিয়ে দেখলাম  টিকটিকিটি নেই, ঘরের কোথাও নেই। এমনি করেই সবাই চলে যায় একদিন। বেড থেকে নেমে জানালার কাছে দাঁড়ালাম, চোখে পড়ল অদূরেই কাঠখোট্টা পলাশ গাছটা। দেখলাম গাছটা ছেয়ে গেছে পলাশ ফুলে।
বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................

একটি সারস্বত কাহিনী
সৌরভ নায়ক




।।স্নিগ্ধা।।
সকালের রোদটা চোখে পড়তেই বিরক্তিতে বিছানাতেই মুখ সরিয়ে নিলো স্নিগ্ধা। মনে পড়লো কালই সেই সরস্বতী পূজা।  গত বছরের সরস্বতীপূজা থেকে এবারের বছর টাও ঘুরে এলো, কিন্তু এই একটা বছরে জীবন অনেকটাই বদলে গেছে স্নিগ্ধার।  গতবছর এই রকমই সরস্বতীপূজা ছিল। পূজোতে বেরিয়েছিল সে। তখনও জানত না একটু পরেই যা ঘটতে চলেছে তা তার জীবন টাই বদলে দেবে।
 এলাকার ত্রাস কানা দিলিপের ভাই ছোট্টু  ছিনে জোঁকের মত পিছনে পড়ে ছিল। রাতদিন ফলো করতো। হিন্দি ভিলেনের স্টাইলে হুমকি দিতো। তবে স্নিগ্ধা এতে বিশেষ বিচলিত হতো না।
           ওদের পাড়াতেই থাকতো তীর্থ। বরাবরের মুখচোরা লাজুক। আর্ট কলেজের ছাত্র। গত বারের সরস্বতীপূজার আগে সাহস করে স্নিগ্ধা কে এসে বলেছিল
-একটা কথা বলতাম,যদি কিছু মনে না করো
-কি বলো
-না মানে, বলছিলাম
-উফফ বলবে
- মানে আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। প্লিজ কিছু মনে কোরো না
মনে মনে খুব খুশী ও হাসি দুটোয় হচ্ছিল স্নিগ্ধার।  পাগল টা এতদিনে বলার সাহস পেলো তাহলে।
স্নিগ্ধা গম্ভীর হয়ে ছিল। তীর্থ বলে উঠল
-কি হলো, কিছু বললে না
-পরশু সকাল ১০ টায় ওমেন্স কলেজের সামনে দাঁড়িও।যা বলার তখন ই বলবো না হয়
শো রিলের থেকেও বেশী ঘটনা ঘটছে তারপর। একবুক তাজাবাতাস আর একমুখ হাসি নিয়ে পূজোর দিন বেরিয়েছিল। স্নিগ্ধা জানত একটা পাগল উদ্বিগ্ন হয়ে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। মায়ের শাড়ী তে সুন্দর করে সেজেছিল সে। কিন্তু গোধূলি মোড় পেরোতেই ছোট্টু পথ আটকে দাঁড়ায়
-আমার কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে
-এই নিয়ে কতবার তোমায় বলেছি ছোট্টু দা।আমি তোমাকে ভাল বাসিনা বাসিনা বাসিনা।কেন জ্বালাচ্ছো আমায়
ছোট্টু বোধহয় নেশাটেসা  করে ছিল। হিসহিসে গলায় বলে উঠলো
-তবে রে খানকি মাগি। বহুত দেমাগ না তোর। তোর রস আজ বের করছি।  এই বলে মুখে কি একটা ছুঁড়ে মারে।
তরল টা মুখে পড়তেই স্নিগ্ধার মুখে যেন একশ বিছে কামড়ে ধরে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওখানেই জ্ঞান হারায় সে।  অজ্ঞান হবার আগে কি একবার তীর্থকে দেখতে চেয়েছিল সে? কে জানে

।তীর্থ।
 সেদিন কলেজ গেটে বিকেল চারটে অব্দি দাঁড়িয়ে থেকেও স্নিগ্ধার দেখা পায়নি তীর্থ। ক্লাবে ফিরতেই মারাত্মক ঘটনাটা শুনলো। মোড়ের মাথায় স্নিগ্ধার ওপর অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছে কেউ।স্নিগ্ধা সিরিয়াস অবস্থায়icu তে ভর্তি। চোখের সামনে সমস্ত শহর যেন হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছিল সেদিন। আজও তীর্থ সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে বেরোতে পারেনি। প্রায় টানা ছমাস দিল্লী মুম্বাই এ চিকিৎসা চলে স্নিগ্ধার। বারবার প্লাস্টিক সারজারি। বাঁচার আশা খুব কম ছিল কিন্তু স্নিগ্ধা বেঁচে ফিরে। তীর্থ এরপর বারবার স্নিগ্ধার সাথে দেখা করতে গেছে। কিন্তু স্নিগ্ধা তাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে, কথা বলতে চায়নি। ওর মা ও বলেছে "বাবা তুমি এলেই মেয়েটার মুখে একটু হাসি ফোটে, আমি দেখেছি, তবু জানিনা কেন ও তোমার সাথে দেখা করতে চায় না
   একা সিগারেট ধরিয়ে এই সব পুরোনো কথা ভাবছিল তীর্থ। তার সব স্বপ্ন এভাবে শেষ হয়ে গেলো? পেছন থেকে সম্বিত ডাকলো
- কি রে কি ভাবছিস
-না কিছু না
-স্নিগ্ধা তাই না
-ধুৎ,
-যাই হোক, এবারের পাড়ার সরস্বতী ঠাকুর তুই গড়ছিস, তাই না। 
-হুম
-হয়ে গেছে
-কাল মণ্ডপেই দেখিস।আপাতত বাড়ি যাই
।স্নিগ্ধা।
তীর্থর জন্য বড্ড মন কেমন করে।  কিন্তু ও চায়না এই পোড়া মুখ নিয়ে তীর্থর সামনে দাঁড়াতে। তাই তীর্থ বারবার ছুটে এলেও বুকে পাথর রেখে তাকে ফিরিয়েছে, দরজায় খিল এঁটে কেঁদেছে। কাল সেই সরস্বতীপূজা। অভিশাপের একটি বছর পূর্ণ।  ভালো থেকো তীর্থ, আমকে ভুলে ভালো থেকো
সকালে ছোট বেলার বান্ধবী রিয়ার ধাক্কা তে ঘুম ভাঙ্গলো স্নিগ্ধার,  আগে খুব উঠে উপোষ করত। উত্তেজিত গলায় বলছে
-ওরে দেখ কি কান্ড হয়েছে
-কি হয়েছে?
-শিগগীর  প্যান্ডেলে চ
-কেন রে?
-আহ তুই চল তো। কোনো কথা শুনবো না
মুখে কাপড় ঢেকে স্নিগ্ধা ঘর থেকে বেরোয়।প্যাণ্ডেলে আসতেই দেখে সবাই হাঁ করে মুর্তির দিকে তাকিয়ে আছে।স্নিগ্ধা তাকাতেই চমকে ওঠে। কিন্তু একী!! সরস্বতীর মাটির  মুখে পোড়া পোড়া অ্যাসিডের ছাপ।দুচোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। কিন্তু মুখে এক আশাজনক হাসি।কেউ সেই হাসি দেখে আর কিছু বলতে পারছে ন।সবাই যেন পাথর হয়ে গেছে
।স্নিগ্ধা ও তীর্থ।
দূরে তীর্থ দাঁড়িয়ে ছিল। স্নিগ্ধা পিছন ফিরতেই ওকে দেখতে পেলো। একি তীর্থ কাঁদছে নাকি?
স্নিগ্ধা কাছে যেতেই চোখ মুছে স্মার্ট সাজলো তীর্থ
-কে কেমন আছো সি সি স্নিগ্ধা
-ভালো। ঠাকুর টা তুমি গড়েছো?
-হ্যাঁ মানে,কি বলবো, রাগ করেছো?
-পাগল একটা
-আর কিছু বলবে না
-কি বলবো
-যেটা আগের বছর বলার কথা ছিল
-না
-হুম
তীর্থ কথাটা শুনতেই চোখে সানগ্লাস টা চাপিয়ে নিয়ে চোখ ঢাকলো
পেছন ফিরে একটু এগোতেই স্নিগ্ধা ডাকলো
-শোনো
-হ্যাঁ কিছু বলছো
-আমি তোমাকে ভালবাসি তীর্থ
দুটো ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটলো। প্যান্ডেলে তখন কেউ বাজিয়েছে "তোমার কাছে এ বর মাগি, মরন হতে যেনো জাগি"

বার্ণিকের গল্প ..........


প্রবাহ
শুভঙ্কর চৌধুরী


তিতাস পর্ব
৯.১.২০১৭ , রাত প্রায় ২ টো
ছেলেটা এখনো ফোন করছে না কেন ? ফেসবুক টা বন্ধ করে  হঠাৎ মনে পড়ল তিতাসের। কাল থেকে ছেলেটা না ফেসবুক না হোয়াটসআপ কিছু তেই অন হয়নি। কোনও ফোনও করেনি। ছেলেটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে দিন দিন । এইসব উল্টো পাল্টা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে তা  নিজেও জানে না তিতাস। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তাখন প্রায় ৯ টা ছুঁই ছুঁই । আজ মা মেরেই ফেলবে আমায় । ধরপরিয়ে ঘুম থেকে উঠে  গেল তিতাস। কিন্তু ওর নিজের অবাক লাগলো একটু, মা এখনো কিছু বলছে না কেন ?
দোতলার নিজের ঘড় থেকে নিচে নেমে এসে দেখে মামা এসেছে সকালে,  মামি আর টুটুস কে নিয়ে। টুটুস হল ওর মামাতো ভাই । মহা খচ্চর পুচকে, পুরো টেপ রেকর্ডার। যাই হোক ভগবান এর অসীম কৃপা এই ভেবেই হাঁসতে  হাঁসতে সে নিজের সকালের খাবার টা খেতে বসেই আবার মনে পরে গেলো অরিত্রর কথা।
একটু বিরক্ত করি অরিত্র আর তিতাসের পরিচয় পর্ব টা সেরে নিই। অরিত্র হল আসানসোল এর ছেলে । উচ্চবিত্ত বাঙ্গালী পরিবার এ মানুষ। আসানসোলে স্কুলের পড়াশুনো শেষ করে  কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। আর তিতাস মানে তিতাস ফৌজদার হল সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত পড়িবারের মেয়ে । বেহালায় বাবা মা এর সাথে থাকে। গ্রামের বাড়ি মালদার হরিসচন্দ্রপুরে হলেও সে কোলকাতাতেই মানুষ । বেহালার একটি স্কুলে পড়া শেষ করে  এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজেই ভর্তি হয়েছে একি department এ । মানে ফিজিক্স নিয়ে । এবার গল্পে ফেরা যাক। 
তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট শেষ করে  ঘরে ফিরে দরজা খুলতেই সে দেখে খাটের তল থেকে ওল্ড মঙ্ক এর বোতল টা দাঁত বের করে  হাসছে। তাড়াতাড়ি সেটাকে নিজের ব্যাগের মধ্যে চালন দিয়েই ফোনে টা হাতে নিয়ে কল করল অরিত্র কে । নাহ অফ আসছে ফোনে। কিছুই বুঝতে পারছিলো না ও।
আজকাল অরিত্র এর সাথে কথা না হলে কলেজ এ ওর মুখ একবার না দেখলে তিতাসের কিছুতেই ভালো লাগে না আর। সে তো এই রকম ছিল না আগে কখনো ! মেয়ে হয়ে জন্মেছে আর ছেলেদের নজর এড়িয়ে যাবে এই রকম হয়নি কখনো । কিন্তু কারও জন্যে কোনও অনুভুতি আসেনি ওর মনে আগে। তাহলে এই রকম হচ্ছে কেন ? ধুর ফালতু ভাবনা এইসব বলে আবার সে কলেজের রুটিন টা দেখল । মেরেছে ১২ টা থেকে ক্লাস আর সে এখনো বাড়িতে। নাহ আজ আর চান টা হল না । বই নিয়ে কোনও রাকমে তৈরি  হয়ে সে বাড়ি থেকে বের হল।
কলেজে ঢুকতে গিয়ে শোভন এর সাথে দেখা । “ কিরে অরিত্রর কোনও খবর জানিস নাকি রে ? “ তিতাসে জিজ্ঞাসা করার আগেই শোভন ই জিজ্ঞাসা করে  ফেললো । “ আমি জানলে কি আর এখানে থাকতাম ? “ বিরক্ত হয়েই উত্তর টা দিলো তিতাস। আর কথা বাড়ালো না ওরা।
দুপুর ২.৩০ কলেজ ক্যান্টিন
-আজকের টপিক টা কিছু মাথায় ঢুকলো তোর ? ( রিয়ার কথায় চমকে উঠলো তিতাস)
-কি বলছিস ?
-বলছি আজকের...... এই তোর মনটা কথায় আছে রে ? সকাল থেকে দেখছি কেমন হয়ে আছিস। বলি ব্যাপার টা কি ? প্রেমে পড়লি নাকি ?
-বেফালতু বকিস না তো ! দে সিগারেট টা .. আগুন টা কি তোমার শ্বশুর দেবে ?
একটু চুপ থেকে আবার বলা শুরু করল তিতস
         -হ্যাঁ রে অরিত্রর কোনও খবর জানিস তুই ? কয়েক দিন ধরে কোনও পাত্তাই পাচ্ছি না ওর !
          -কেন তুই জানিস না ও বাড়ি গেছে ?
          -তোর আগে জানি সেটা, কিন্তু তার পর থেকে তো আর পাত্তাই নেই মালের!
          -এখন তবুও একটু শুধরেছিল ভেবেছিলাম । নাহ। ও শুধরনোর পাবলিক না।
          -এই রকম বলিস না রে !! ( নিজের অজান্তেই সুর নামিয়ে কথা টা বলল তিতাস )
          -কি ??????????? ( প্রায় অবাক হয়ে আকাশ থেকে পড়ল এমন করে  চিৎকার করে  বলল রিয়া)
          -না মানে আর কি ওই বলছিলাম যে!!!!  ছাড় , তো চল ক্লাস আছে ।
          -এই তুই ঠিক আছিস তো ? নাহ পড়াশুনোর কথা বলছিস তুই !
          -না পড়লে অরিত্র খুব রাগ করে ।
আর কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ল ওরা।
অরিত্র পর্ব
৭.১.২০১৭, সকাল ৯.৪৫
            -বাবু কখন আসছিস বাড়িতে ?
           -এই তো বেরবো এবার। তুমি কি এসে গেছো ?
           -হ্যাঁ তুই আয় না । একটু দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তোকে !
           -মা বলছি যে উকিলের সাথে কথা হয়েছে তোমার ?
           -তুই আয় বাড়িতে সব বলছি তোকে। কখন বেরবি রুম থেকে ?
           -এই তো বেরবো ।
           -বাসেই আসছিস তো ?
           -হুম। এবার বেরবো। রাখছি ।
ফোন টা কেটে নিজের ব্যাগ গোছাতে লাগলো আরিত্র। আজকাল আর সে কাউকে কিছু বলেনা। তার জীবনের যত অগোছালো সবকিছু সে নিজের মধ্যেই রাখতে চায় আজকাল।  আজ বাড়ি যেতে হবে ভেবেই গা গুলিয়ে আসছে তার। “বাড়ি” এই কথা টাই আজকাল তার কাছে হাস্যকর ব্যাথার মতন। ফোনে টা বাজছে,  দেখল তিতাস ফোন করেছে।
-হ্যালো বল ।
-কিরে আজ আসছিস তো?
-ভুলে গেছিস নির্ঘাত । আজ বাড়িতে যাচ্ছি তোকে বলেছিলাম তো !
-ইসস। ভুলে গেছিলাম রে । কবে ফিরবি ?
-আজকাল রত্রে একটু বেশীই খাচ্ছিস মনে হচ্ছে ।
-বেশী পিঁয়াজি না করে  বলনা ।
-দেখি কিছু কাজ আছে , কয়দিন লাগে দেখি। রাখছি বেরবো এখন।
কথা বলতে আর ভালো লাগছিলো না অরিত্রর । এখন সামনে এক অসমো সংগ্রাম আছে তার ।
বিকেল ৪.১০ , ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ড
বাস এর সিটে বসে ইয়ার প্লাগ টা কানে লাগালো অরিত্র । আর ভাবতে ভালো লাগছে না কিছু ওর। সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছে সে মা আর বাবার মধ্যে ঝামেলা । আর ভালো লাগছে না তার কিছুই। মোবাইল টা খুলে সে গান চালালো “I'm so tired of being here,Suppressed by all my childish fears And if you have to leave-I wish that you would just leave 'Cause your presence still lingers here And it won't leave me alone” . এটা ওর সবচেয়ে প্রিয় গান। ওর একার বেঁচে থাকার গান।
বাস চলতে শুরু করেছে। নবান্ন পার করলো সবে। গান শুনতে শুনতে আবার ও হারিয়ে গেলো নিজের মধ্যে। সেই ছোট্ট বেলায় দেখত বাবা প্রচুর মদ খেয়ে এসে মা কে মারছে । উচ্চবিত্ত পরিবার হওয়ায় বাইরের লোকে কিছুই টের পেত না। খালি দেখত ওর মা তবুও বাবা কে অক্লান্ত ভাবে ঠিক করতে চাইছে। এখন ওর বয়স ১৮, এত বড় হবার পরেও তার পরিবারের অবস্থা একি থেকে গেছে । ছোট্ট বেলাতেই ওর মা হয়তো বুঝতে পেরেছিল তাই আসানসোলে দাদুর কাছেই মানুষ হয়েছে ও। বাবা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি তে বড় পদে চাকরি করায় কখনো বাড়িতে থাকতেন না বেশী। মা ও থাকতো ওর সাথেই। বাবা যখনি আসত সারক্ষন মদে ডুবে থাকতো। অরিত্রর কিছুই ভালো লাগত না । স্কুলে দেখত সবার বাবা মা আসত তাদের কত্ত আদর করত, কত্ত ঘুরতে নিয়ে যেত কিন্তু অরিত্র বুঝেছিল তার  কপালে এইসব কিছু নেই । এই নিয়েই সে বড় হয়েছে । কোনও বন্ধু সে ইচ্ছে করেই করেনি কারন তাদের নিজের বাড়িতে সে কখনই আনতে পারত না । পড়াশুনো তে ভালই  সে, আর ইংরেজি মিডিয়াম এ পড়ার সুবাদে অনেক ছোট্ট বেলা থেকেই মেয়েদের মধ্যে সে ছিল অনেক বেশী চর্চার বিষয়। ভালবসা নামক খেলাটিতে সে ক্লাস ৯ থেকেই মেতে উঠেছিল। খানিকটা নিজের নির্জনতা দূর করার জন্যেই। কিন্তু ভালোবাসার ইনফ্যাচুয়েসনে সে অনেক শরীর পেয়েছে। ভালোবাসার জায়গা টা পায়নি আজও ।  আচ্ছা তার কি সুখে থাকার কোনও অধিকার নেই ? কেন সে বাবা মা এর ভালোবাসা পেল না ? তাহলে কেনই বা জন্ম দিলো ওকে তারা ? হঠাৎ বাসের ব্রেক এর জোরে সে নড়ে উঠলো । দেখল পানাগর এসেগেছে। এ.সি বাস এর সুবাদে বাইরের আওয়াজ কানে আসেনা। সে ভাবছে জীবন টাকে যদি সে একটা এ.সি ঘরে বন্ধ করে  রাখতে পারত , তাহলে সব কিছু থেকে সে দূরে একা বাঁচতে পারত নিজের মতন করে ।
নিচে নামলো । বাস এখানে থামবে কিছুক্ষন । নেমেই একটা সিগারেট ধরাল সে। হঠাৎ ফোন টা বেজে ওঠায় বিরক্ত হয়েই দেখল ।
-হ্যাঁ বলো !
-কতদূর ?
-পানাগর
-জল খেয়েছিস ?
-হুম
-খিদে পেলে কিছু খেয়েনিস ।
-আচ্ছা ।
-দাদুভাই তুই আমায় কিন্তু ভুল বুঝিস না । প্লিস
বুকের ভেতর টা কেমন করে  উঠল অরিত্রর। দাদুর মুখে এইরকম কথা সে কখনো শোনেনি
-এই ভাবে বোলো না দাদুন। আমি তোমায় না কাওকেই ভুল বুঝিনি ।
-আচ্ছা , তুই রাতে কি খাবি বল। আনিয়ে রাখতে হবে তো।
-আমি যাচ্ছি গিয়ে কথা বলছি। এখন রাখছি।
বাস ছেড়ে দিলো। সে আবার নিজের মধ্যে হারিয়ে গেলো। হঠাৎ একটা মেয়েলী গলায় তার হুঁশ ফিরলো ।
-hey Ari how are u ?
চোখ খুলে দেখলো সিল্ভিয়া দাড়িয়ে আছে সিট ধরে। দেখেই গা ঘিনঘিন করে  উঠলো অরিত্রর। অনিচ্ছা সত্যেও জবাব দিলো 
-hey !! m fine .
-so !! its been a long haan ?
-may be !
-you know what !
-what ?
-I think I steel love you.
নিজেই মুখ টা ঘুরিয়ে নিল বাইরের দিকে অরিত্র । আজকাল এই love কথাটা আর নিতে পারে না ও। তাছাড়া সিল্ভিয়া কেও ওর আর ভালো লাগছিলো না । ভাগ্য ভালো ওইটুকু বলেই থেমে গেলো সিল্ভিয়া। দিয়ে কিছুক্ষণ অরিত্রর দিকে তাকিয়ে থেকে সে কিছু বলছে না দেখে চলে গেলো ।
রাত ৯ টা , অরিত্রর বাড়ি
-বাবু তুই কিছু বুঝতে পারছিস ?
-কি ব্যাপারে বলতো ?
-এই যে তোর বাবা আর আমার এই ডিভোর্স এর কথা তার ব্যাপারে ?
-আমি আজ অবধি কিছু বলেছি তোমাদের ? যা করছ নিশ্চয়ই কিছু ভালো ভেবেই করছ।
-তবুও তোর একটা মতামত তো থাকেই।
-না ।
-না কেন ?
-কারন আমি দাদু কে চিনি , যিনি আমায় মানুষ করেছেন। তোমায় চিনি যিনি আমায় জন্ম দিয়েছো। বাবার উপাধি আমার আছে শুধু। আর কিছু তো নেই আমার ।
-এই ভাবে বলিস না বাবু। আমি কি তোকে কিছুই দিইনি বল ? আমি কি তোকে ভালবাসিনা ? ছেলে বেলা থেকে তুই তো সব ই দেখেছিস নিজের চোখে । আমার কিই বা করার ছিল বল ? তুই বল বাবু আমি কি করতে পারতাম ? তোর দাদু অসুস্থ, আমি একা তোকে মানুষ করছি তোর দাদু কে দেখছি, তোর বাবা কে আজ অবধি ঠিক করার চেষ্টা করে  গেলাম । জানিস তোর বাবার জন্যে কোনও কাজের মাসি থাকতে চাইত না বাড়িতে ? তা সত্যেও আমি সব কিছু সামলে তোকে আলাদা করে  মানুষ করেছি যাতে তোর বাবার কোনও ছায়া না লাগে তোর ওপর । এটা কি আমার কোনও দোষ ?
একদমে বলেগেলেন স্মিতা দেবী কথা গুলো । অরিত্র লক্ষ্য করল মা এর চোখে জল এসেছে। আগে এই জিনিস কখনো দেখেনি সে। আর যাই হোক তার মা এর চোখে জল দেখেনি কখনো সে।
-মা ! ও মা ! শোনো না , আমার না পায়েস খেতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। খাওয়াবে তুমি ?
আর কাঁদতে পারলেন না স্মিতা দেবী । জড়িয়ে ধরলেন অরিত্র কে । দিয়ে অনেক গুলো চুমু খেলেন অরিত্রর গালে আর কপালে। দাদু এতক্ষন দরজার আড়াল থেকে সব শুনছিলেন। এবার বাইরে বেরিয়ে এসে একটু আদোআদো গলা করে  বললেন
-মা রে বলছি কি পায়েসের ভাগ টা কি এই বুড়ো একটু পাবে ?
-অবশ্যই দাদুন। আমি আর তুমি । দাদু নাতি মিলে খাবো। মা কে একটুও দেব না কিন্তু ।
অনেক কষ্টের মাঝেও একটু হাসির গন্ধে সারা বাড়িটা কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠল আবার ।
কলেজ পর্ব-
১৯.১.২০১৭, দুপুর ১২টা
-এই অরিত্র আজ ক্লাসে এলনা কেন রে ? ( ফিস ফিস করে বলল রিমা  তিতাস কে )
-আমি কি ওর বিপ নাকি যে ওর সব খবর রাখব ? চুপচাপ ক্লাস টা করতে দে। লাস্ট প্রাক্টিক্যাল ক্লাসে আসবে ।
বিকেল ৩.২০ , প্রাক্টিক্যাল ল্যাব
-কোথায় ছিলি রে এতদিন ?
রিমার কথা শুনে ওর দিকে তাকালো অরিত্র।
-বাড়ি গেছিলাম । বলেছিলাম তো
-হ্যাঁ । তা বলেছিলেন কিন্তু তার সাথে এটাও বলা দরকার ছিল যে আপনি বাড়ি গিয়ে কারও সাথে কথা বলতে চান না । তাহলেই হত । বার বার ফোন করে নিজে দের আর ব্যাস্ত করতাম না আমরা।
এতক্ষন শুনছিল তিতাস সব কিছু। এবার বললো,
-দ্যাখ রিমা  যে মানুষ শুধু নিজের কথা ভাবে তাকে জ্ঞান দিতে নেই। its better not to talk abut it.
অরিত্রর বুঝতে বাকি থাকল না যে কথা টা তাকে বলা হল  । সেও কথা না বাড়িয়ে আবার কাজে মন দিলো ।
বিকেল ৫ টা, কলেজ ছুটি হবার পর
-কিরে কথা বলবি না আমার সাথে ?
-কে আপনি ?
-ওহ !!! বুঝেছি । দেখ তোকে আমার কিছু বলার আছে । যদি সময় হয় চল কথাও গিয়ে একটু বসে কথা বলি তোর সাথে ।
-পারমিসান চাইছিস ? না জানাচ্ছিস ?
-অনুরোধ করছি !!
-সময় নেই , বাড়ি যেতে হবে।
-তুই আবার কবে থেকে টাইম মতন বাড়ি যাওয়া শুরু করলি ?
-আমি কাউকে কৈফিয়ত দেবার জন্যে বাধ্য নই।
-আচ্ছা বুঝেছি। ঠিক আছে ।
অরিত্র আর কথা বাড়ালো না । ফিরে চলে যাচ্ছিল , হঠাৎ পেছন থেকে কলার ধরে একটা টান অনুভব করল জোরে তার পর নিমিষের মধ্যে গালে একটা জোরে চর পড়ল তার।
-তুই কি মানুষ ?
-এটা কেন করলি তুই ? আমার মা আজ অবধি আমার গায়ে হাত তোলেনি !
-বেশ করেছি মেরেছি । দরকার পড়লে তোকে আবার মারব । কিছু করার আছে তোর ? থাকলে করে নে ! এই তিতাস কাওকে ভয় পায় না ! তুই কে রে ? কে তুই ? কি জন্যে এত ভাবি আমি তোকে নিয়ে ? বেশ তো ছিলাম আমি আমার জীবনে । কেন এলি তুই ?
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ! ( অবাক হয়ে বললো অরিত্র, কিছুই ঢুকছিলো না ওর মাথায়)
-তা বুঝবি কেন ? আমি তো আর শরীর দিইনি তোকে ! তোরা পুরুষের জাত শালা সব কটা এক, সব কটা শরীর বুঝিস তোরা ! তুই ও তার ব্যাতিক্রম না ।
-দ্যাখ তিতাস আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না , আর কবে আমি তোর শরীর চাইলাম বলতে পারিস ? কোনদিন দেখেছি তোর দিকে সেইভাবে আমি ?
আশেপাশে কিছু লোক ফ্রি তে সিনেমা দেখছিল এতক্ষন। সেটা বুঝতে পেরে তিতাস হঠাৎ বলে উঠল “ এই যে দাদারা বৌদিরা এবার মুভি শেষ হয়েছে, আস্তে পারেন আপনারা “
-চল কোথায় যাবি বলছিলিস তুই !
-না থাক আজ।
-আবার খাবি ?
বলতেই কাজ হয়ে গেলো । অরিত্র জানে না কোন জাদুতে কাজ করল আজ । ওরা কলেজ স্কয়ারে বসল একটা বেঞ্চি তে।
-হুম বল কি বলবি বলছিলি তুই ।
-তুই আমার ব্যাপারে কতটুকু জানিস বল ?
-তুই একটা ছেলে ! যদিও সন্দেহ হয় তবুও । আমার সাথে পড়িস। প্রথম ভাবতাম এত হ্যান্ডসাম ছেলে নিশ্চয়ই অনেক সখী থাকবে আর আমাদের মতন বয় কাট মেয়ে দের পাত্তা দিবি না । কিন্তু পরে জানলাম তুই নেহাতই গোবর গণেশ ছাড়া আর কিছু না ।
-আর ?
-আর কিছু না । এত ভাটাচ্ছিস কেন বলত ? যা বলতে চাস সেটা সোজাসুজি বল না ?
-দ্যাখ আমি আজ তোকে কিছু কথা বলব , হয়তো এসব শুনে তুই আমার সাথে আর বন্ধুত্ব নাও রাখতে পারিস । কিন্তু আমার কথা শেষ না হওয়া অবধি তুই টুঁ শব্দ করবি না। জানিনা কেন তোকে এসব বলছি আমি । কিন্তু আমি জানি আমি যদি কাওকে এখন কিছু না বলি তাহলে আমার কাছে সুইসাইড করা ছাড়া আর কিছু পথ থাকবে না । আর নিজের কথা অন্যকে বলা মানে সহানুভূতি পাবার চেষ্টা , আমি সেটা করছি না , কিন্তু তোকে বলছি কারন আমি জানি তুই আমার কথা শুনবি।
এই বলে বলা শুরু করলো অরিত্র , তার ছোট্ট বেলার স্কুলের জীবন থেকে যৌবনের কাম অবধি , বাবা মা এর মারপিট, ডিভোর্স , দাদুর কাছে মানুষ হয়া সব বলল।
ঘড়িতে এখন ৭.৪৫ বাজে। তিতাস বলল “আর কিছু বলবি ?” “না” বলে মুখ নিচু করল আরিত্র। তিতাস উঠে দাঁড়াল। “অনেক রাত হয়ে যাবে আমার পৌছুতে এখন বেরই , পরে কথা হচ্ছে ।“ বলেই হাঁটা দিলো সে। অরিত্র এই প্রথম বার দেখল তিতাস এর শরীর দুলিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া কে। খোলা চুলের দুলুনি যেন অজান্তেই মাতাল করে দিচ্ছিল তাকে। অরিত্রও উঠে দাঁড়াল। এবার তাকেও যেতে হবে ।
রাত ২.৫০
আজ রাতে ৫ পেগ খেলো তিতাস তবুও নেশা হচ্ছে না তার। কানে শুধু অরিত্রর কথা গুলো ভাসছে । একটা ছেলে কি করে এত কষ্টে থেকেও হাঁসি মুখে চলতে পারে ? এই কয়মাসে একটুকো বুঝতেই দিলো না ?আজ তাহলে আমায় কেন বলল যে আমায় না বললে ওকে মরতেও হতে পারে ? নাহ এর একটা বিহিত করতেই হবে।
ভণিতা পর্ব
৩১.১.২০১৭ , তিতাসে বাড়ি
সেই দিন টার পরথেকে কিছুতেই ভালমতন কথা আর বলেনি অরিত্র তিতাসের সাথে । হুম আর ওকে দিয়েই কাজ চালিয়েছে বেশিরভাগ । কেন যে ছেলেটা এমন করছে ধুর!!!!!! বই টা ছুড়ে ফেলে দিলো বিছানার ওপর। হঠাৎ ফোনে এল । ওপাস থেকে রিমার গলা
-শোনো না বান্ধবী কাল কিন্তু ওই কাঞ্জিভরম টা পড়বি ।
-তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি ? এমনিতেই জীবনে আমি শাড়ী পরি না তার ওপর আবার এইসব আবদার ?
-যেটা বলছি সেটা কর। বেশী কথা বললে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম আমি ।
আর কথা বাড়ালো না তিতাস। শুধু ওকে বলে ফোনে টা রেখে দিলো।
১.২.২০১৭ কলেজের মাঠ
- আরিব্বাস এটা কাকে দেখছি ? ( শোভন জিগ্যেস করায় তার দিকে তাকাল তিতাস। দেখে শোভন আর রিমা  হাত ধরে আসছে । বুঝতে আর বাকি থাকে না বাকিটা )
-তলে তলে এইসব কবে হল ?
-(হাঁসতে হাঁসতে উত্তর দিলো রিমা) তোমার বিরহ পর্বে জানু । বলেই আবার হাঁসতে লাগলো সকলে।
-ওই দ্যাখ কে আসছে ।
শোভনের কথা শুনে সবাই পেছন দিকে তাকালো। দেখল অরিত্র একটা হলুদ পাঞ্জাবী   পরে কলেজে ঢুকছে। কি যেন হয়ে গেলো অরিত্র কে দেখে তিতাসের ও নিজেও বুঝতে পারল না । সোজা অরিত্রর কাছে এসে বলল
-দ্যাখ অরিত্র আমি অত নেকুপুসু মেয়ে নই সেটা তুই জানিস খুব ভালো করে !
-আবার শুরু করলি ?
-চুপ !!!!!!! আমি বলব আজ, আর তুই শুনবি। আমি অত নেকুপুসু মেয়ে নই। ভালোবাসা পেলাম না কেন এই বলে দেবদাসী হয়ে জীবন কাটাতে পারবনা । বস তোমায়  ভালোবাসি । এই বিয়ে করবি আমায় ?
-হুম ।
পরিণয় পর্ব-
১.২.২০২৩  অরিত্রর বাড়ি ।
আজ ওদের ফুলশয্যা । রাতে সব কিছু মিটিয়ে অরিত্র যখন ঘরে ঢুকল, দেখে তিতাস খাটে না বসে সোফায় বসে আছে ।
-কিরে ওখানে কি করছিস ?
-দ্যাখ একটা কথা আছে আমার !
-আবার ?
-এই শোন চুপচাপ।
-বল বল । হালকা হাঁসি পেলো আরিত্রর
-আমি কিন্তু তুমি করে বলতে পারব না তোকে।
-আর কিছু ?
-না আর কিছু না ।
কথা শেষ না হতেই অরিত্র জাপটে জড়িয়ে ধরল তিতাস কে ।
-এই কি করছিস কি ?
- For every action, there is an equal and opposite reaction.
বাকি টা নাহয় এবার তিতাস আর অরিত্রর ওপর ছাড়া যাক । ওরা এবার একটু সুখে আর শান্তিতে থাকুক। কামনা করুন অরিত্রর যেন হাত পা না ভাঙ্গে তিতাসের মারের চোটে ।
বার্ণিক এর অণুগল্প –
.......................................................................................................................................
অপঘাত
  ধরিত্রী গোস্বামী


তারাপদ মুহুরির নেশা ছিল মাছ ধরা। ছুটিছাটার দিনে ছিপ বঁড়শি নিয়ে দূরদূরান্তে যাওয়া ছাড়াও নিত্যদিন খিড়কির পুকুরে ফেলা থাকত একটা খাপলা জাল। কোর্টে বেরুবার আগে মুখে নিমের দাঁতনটি ঝুলিয়ে সে রোজ ঘাটে যেত সরেজমিনে কি মাছ পড়েছে দেখতে। পছন্দমত কিছু পেলে নিয়ে এসে ফেলে দিত রান্নাঘরের দোরগোড়ায়। ইচ্ছেটা পরিষ্কার, গরম গরম ভেজে দাও ভাতের সঙ্গে। 
সেবার ভরা বর্ষাকাল। পুকুরে জল টইটম্বুর। খাপলায় খলবল করছে মাছটা, কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না তারাপদ।   এদিকে বেলা গড়িয়ে যায়, কোর্টে বেরুতে হবে। “নিকুচি করেছে” বলে তারাপদ পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে ফিরে গেল বাড়ি। হাতের  চেটোয় বেশ কয়েকটা জায়গা রক্তাক্ত। ডেটলের শিশি থেকে তুলো ভিজিয়ে লাগিয়ে নিল ক্ষতস্থানে। রান্নাঘরের বারান্দায় খেতে বসেছে, গরম মুসুরির ডাল, পলতার বড়া আর আলু পোস্ত। ভাই উমাপদ উঠোনে বসে সাইকেলের চেনে তেল লাগাচ্ছিল। তাকে ডেকে বলল তারাপদ, “উমা, স্নানের সময় দেখিস ত, বড় একটা শোল বা মাগুর পড়েছে জালে, কিছুতেই ব্যাটাকে ধরতে পারলুম না, শালা দাঁড় ফুটিয়ে ফুটিয়ে হাতটা ঝালাপালা করে দিলে। এনে রাখিস, রাতে খাব ওটাকে।” সম্মতি-সূচক ঘাড় নাড়ে উমাপদ। দাদার মত তারও মাছ ধরার খুব নেশা।    
দুপুর দেড়টা নাগাদ উমাপদ গেল নাইতে। রোজই এরকম সময় যায়। তবে দাদার মত হাত ঢুকিয়ে জ্যান্ত মাছকে জব্দ না করে সে খাপলা জালটাকে টেনে তুলল পাড়ে। আর যা দেখল তাতে মাথা ঘুরে গেল বোঁ করে। মাছ কোথায়? প্রায় তিনহাত লম্বা কালো কুচকুচে এক কেউটে ফোঁসফোঁস করছে জালে আটকা পড়ে।
বাড়ির মেয়েদের কাউকে কিছু না জানিয়ে উমাপদ সাইকেল হাঁকিয়ে ছুটল সদরে। না জানি কি অনর্থ ঘটে গিয়েছে এতক্ষণে। সকালে দাদার হাতে লালচে সব কামড়ের দাগ দেখেছিল সে।  কোর্টে পৌঁছে সে যে দাদাকে আর জীবিত অবস্থায় পাবেনা  তা একরকম নিশ্চিত। কিন্তু দড়াম করে সাইকেলটা ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠেই এক্কেবারে তারাপদর মুখোমুখি পড়ে গেল সে। তারাপদ তখন সবে টিফিন সেরে বাইরে বেরিয়েছে একটা বিড়ি ধরাবে বলে। “কি রে উমা, হাঁপাতে হাঁপাতে এলি কেন? কার কি হল?” জানতে চায় বিস্মিত তারাপদ। ছেলেমানুষ উমা তার এতক্ষণের চাপা উৎকণ্ঠায় কেঁদে ফেলে, “দাদা কেমন করে বেঁচে আছিস? ওটা মাছ নয় রে, সাক্ষাৎ যম, একটা কেউটে রে দাদা!”
“কেউটে? সকালে আমাকে কেউটে সাপে কেটেচে? সর্বনাশ!” তৎক্ষণাৎ কোর্টের বারান্দাতেই ঝপ করে পড়ে মারা গেল তারাপদ মুহুরি।