Monday 30 January 2017

প্রচ্ছদ নিবন্ধ -২ 
...........................................................................................................................
শীতলস্মৃতি
অনিন্দিতা মণ্ডল
 যারা দক্ষিণ বঙ্গের এই জনাকীর্ণ শহরের অলিতে গলিতে প্রথম নিঃশ্বাস নিয়েছি , এবং হয়ত শেষ নিঃশ্বাস ও নেবো , তাদের কাছে শীত একটা উৎসব । না , শহরে প্রথম তুষারপাত জাতীয় ঘটনা ঘটেনা বটে , তবে যেটুকু শীত আসে তা আমরা উদযাপন করি ষোল আনা । কতই বা নামে পারদ ? দশের নীচে তো নয়ই , অধুনা তাও হয়না । বসন্তের আমেজ মাখানো একটা শীত শীত ভাব । কি কষ্ট কি কষ্ট ! তোরঙ্গ দেরাজ থেকে রঙবেরঙের শীতপোশাক , মাফলার টুপি বের করা হয়না । দশবছর আগে মাসতুতো দিদির শ্বাশুড়ী যে দারুণ সাদা ধবধবে কার্ডিগানটা বুনে দিয়েছিলেন, এবছর তার সঙ্গে ম্যাচ করে একটা শিফন কিনেছিলাম । সঙ্গে মুক্তোর গয়না । শীতের বিয়েবাড়ির আগাম ফ্যাশান । সে গুড়ে বালি । এ তো রীতিমত গরম ! কার্ডিগান পরে কে ? তবুও অভ্যাসের ফলে ছাতে যাই । দিনের প্রথম নরম রোদ্দুর বের হলেই বাক্স টেনে ছাতে এনে ফেলি । ডালা খুলে দিই । ভেতর থেকে উঁকি দেয় আমার আদুরে শীতবস্ত্র । অবিশ্যি বাই ল আমি এখন এক মফস্বলের বাসিন্দে । কলকাতা থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাতীরবর্তী এক মফস্বল । এখানে বসত ঘন হলেও কলকাতার মত বাড়েনি । নানা অসুবিধেতে জীবনযাত্রা আর সরল হয়না । ফলে এখান থেকেই মানুষের ঢল নামে দেশের সব শহরে । এখানে অপেক্ষাকৃত ভাবে শীত তাই প্রবল । কলকাতার মতন ঘাম প্যাচপ্যাচে শীত নয় মোটেই । কালীপুজোর পরপরই আমরা গায়ে দেবার জন্য বিছানায় কাঁথা রাখি । আর সত্যি সত্যি শীত টের পাই অঘ্রানের নবান্নের ঘ্রাণে । নবান্নের দিন সকালে ঠাকুরদালান থেকে প্রসাদ বয়ে এনে দেয় সুখোদা । কাঁচা দুধ , নতুন গুড় , কড়াইশুঁটি, গোবিন্দভোগ চাল , মূলো , আদা , কমলালেবু , আপেল , বেদানা , কিশমিশ দিয়ে তৈরি আমাদের নিজস্ব ফ্রুট ডেজার্ট । কি অপরূপ স্বাদ আর সুবাস ! বিশবছর আগে আমার শ্বাশুড়ীমা , আমি ভালোবাসতুম বলে বিশেষ করে , বাড়িতে নিজের হাতে আমাকে তৈরি করে দিতেন এই ডেজার্ট । প্রসাদ তো কণিকামাত্র । এখন অবশ্য প্রসাদেই কুলিয়ে যায় । কারণ ও বস্তুটির স্বর্গীয় আস্বাদ গ্রহণে পরিবারের বাকি সদস্যরা অসমর্থ । আর দ্বিতীয় যে কারণ তা হলো এমন শীত আর পড়েনা নবান্নে যে শীতসুবাসিত নলেন গুড় ডেজার্ট এর স্বাদ বাড়াবে ।
      তখন তখন আমরা শীতকালে ছাত থেকে মোটেই নামতে চাইতুম না । রুটিনটা মোটামুটি এরকম ছিল - সকালে কাঁপতে কাঁপতে লেপের তলা থেকে উঠে বসে গায়ে সোয়েটার চাদর জড়ানো । ( আহা ! সাদা মোটা সুতির মশারীও তখন কত আরামদায়ক ছিল !) তারপর সাহস সঞ্চয় করে বিছানার বাইরে আসা । মুখ ধোবার জলে হাত ঠেকানো মাত্র তড়িত্ চমক । গরম চায়ের মত এমন অমৃত আর ছিলনা । জীবনদায়ী । ঘরের জানলা দিয়ে সামনে গঙ্গার দিকে তাকালে কেবল এপারের ঘাটটা দেখা যেত । সাদা কুয়াশার চাদরে ঢাকা গঙ্গার ওপার একেবারেই দৃষ্টির বাইরে । মনে হত যেন সাগরপার । আর গঙ্গার রং ও শীতে সাগরঘেঁষা । হালকা নীল ও ধূসরের মাঝামাঝি । জলের কাজকর্ম সেরে রান্নাঘরের দিকে ছুটতাম সকলে । আগুন পোহানোর স্নিগ্ধতার কি কোনও তুলনা হয় ? আর বেলা একটু গড়ালেই বাগান নয়ত ছাত আমাদের বৈঠকখানা । গান, গল্প,  লুডো খেলা , শুকনো কাপড় ভাঁজ করা , কমলালেবু খাওয়া , রোদ্দুরে দেওয়া লেপ কম্বল উল্টোনো , উলবোনা , - যেন নিত্যদিনের বনভোজন । ঠিক তিনটের পর রোদ্দুর ফিকে হতে শুরু করলেই ছাতজোড়া সংসার গুটোতে হত । আস্তে আস্তে নেমে আসতাম আমরা । কিন্তু সন্ধ্যে হলেই আমরা বিছানাআশ্রিত হয়ে পড়তাম । রাতের খাবার গরম করে পরিবেশন করা যেন ফাঁসির সাজার থেকেও বেশি দণ্ড মনে হত । তবু শীত চাইতাম আমরা । আমাদের এবাড়ির পাথরের মেঝেতে , গঙ্গামাটির গাঁথনির ত্রিশ ইঞ্চির দেওয়ালে শীত ঠাকুরানী বনেদী বাড়ির ঠাকুরঝির মত রয়ে যেতেন আরও কিছুকাল । সবচেয়ে মারাত্মক শীত পড়ত পৌষে । সংক্রান্তিতে । সাগরের এলোমেলো মরারোদের হাওয়া খড়খড়ি নড়িয়ে , ঘুলঘুলি দিয়ে , শার্সির ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ত শোবার ঘরের বিছানায় । রোদের অভাবে ঠান্ডা লেপের মধ্যে ওম তৈরি হতনা । হি হি করে কাঁপতুম সকলে । তবে এর চেয়েও কঠিন ছিল পৌষের লক্ষ্মীপূজোর দিন । কাকভোরে লক্ষ্মী পাতা নিয়ম । ভোরবেলার সেই স্নান যে কি বিভীষিকা ছিল ! তবে সারাদিন বেশ ঝরঝরে হয়ে থাকতাম সেদিন । এখন আর তেমন শীত পড়েনা । আর শীতের কষ্ট পোহাতে হয়না । বাড়ির লোকজন অবশ্য বলে উচ্চরক্তচাপহেতু আমি শীত বোধ করি কম ।
        বহু আগে , চল্লিশ বছর তো হবেই , কলকাতা শহরেও কিঞ্চিদধিক শীত পড়ত । খেলে ফেরবার সময়ে দেখতাম ফুটপাতে জড় হয়ে গরীব গুর্বো মানুষ আগুন পোহাচ্ছেন । তখন শীত মানে দুপুরের ময়দান । শীত মানে চিড়িয়াখানা । শীত মানে নাহুমের কেক । শীত মানে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন । শীত মানে দিদির জন্মদিন । শীত মানে আমার জন্মদিন । এর সাথে শীত আমাদের জন্য আরও একটু বাড়তি আনন্দ বয়ে আনত । আমাদের মামারবাড়ি ছিল বিহারে । ছোটনাগপুরের এক অল্পখ্যাত রেলওয়ে জংশন , চক্রধরপুর । পাঁচ মামার মধ্যে দুই মামা রেলের চাকরিতে এখানেই পোস্টেড ছিলেন সারাজীবন । বড়মামার কোয়ার্টার বেশ লোভনীয় হলেও আমরা ঘাঁটি গাড়তাম ন’ মামার বাসাবাড়িতে । কারণ দিদিমা ওখানেই থাকেন । বেশির ভাগ রাতের গাড়িতেই আমরা যেতাম মামার বাড়ি ।                        
ভোর রাত্রে ট্রেন নামিয়ে দিত স্টেশনে । ঘুম জড়ানো চোখে ঠান্ডায় জমতে জমতে আমরা রিকশা চেপে যেতাম প্রেম নিবাসে । মামার বাড়ির পোশাকী নাম । তখনও অন্ধকার আকাশে । রিকশার হর্ণ শুনতে পেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে মামা এসে জাফরীর দরজা খুলে দাঁড়াত । আমরা ওই আধঘুমের মধ্যেই যথেষ্ট স্নেহ আদর সঞ্চয় করে ঢুকে পড়তাম লেপের তলায় । মায়িমা , মাসি , দিদিমার সদ্য ছেড়ে যাওয়া ওম্ ধরা লেপের তলায় । আবার ঘুমিয়ে পড়তাম আরামে । সকালে ঘুমচোখ খুলে নিজেরই বিশ্বাস হতোনা যে সত্যি সত্যি পৌঁছে গেছি মামার বাড়ি । সূর্য উঠলেই কিন্তু দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠত জায়গাটা । আমরা বাড়ির সামনের লম্বা ফালি ঘাসজমিতে খেলাধুলো করতাম । সামনে দিয়েই চলে গেছে চাইবাসা রোড । যার ডানদিকে চাইবাসা আর বাঁদিকে এতোয়ারি বাজার । ছোটবেলায় ওই রাস্তা , ওই গন্তব্য যেন কি রহস্যময় লাগত । ভিড়ে ঠাসা বাস দেখে মনে হত কোন সুদূরের যাত্রী এরা ! মামার বাড়ির পাশেই গায়ে গায়ে ছিল সরকার জেঠুদের বাড়ি । জেঠুর ছিল শিকারের নেশা । জেঠুর জিপে চড়ে এই শীতকালেই তো আমরা যেতাম টেবোপাহাড়ে । সেসব দিন শিকার করতনা জেঠু । জঙ্গলে জঙ্গলে ধুলো মেখে ঘুরে বেড়ানোই তখন আনন্দ ছিল আমাদের । একবার ফেরবার সময়ে জিপের পেছনে একদম ধারে বসেছি । জিপ ছুটছে । পিচরাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন ঘোর লেগে গেলো । গাড়ি থেকে একটু ঝুঁকে গেলাম আর ছিটকে পড়ে গেলাম । ঠোঁট কেটে গেলো । কেমন করে যেন ছোটবেলায় হাজার চোট পেলেও হাতপা ভাঙতনা । সেভাবে কেটেকুটেও যেতনা । ফেরবার পর দিদিমা বললেন - আর জঙ্গলে যেতে হবেনা । এই অবেলায় সারাদেহ ধুলোয় রাঙা করে ফিরলেন সব । দিদিমা খাঁটি সর্ষের তেল ঘষে ঘষে মাখিয়ে দিতেন গায়ে । চান করে সে কি আরাম ! অমন গন্ড গাঁয়ে কি করে আর নাহুমের কেক পাওয়া যাবে ! অগত্যা মামা একবার ওপরে বালি নীচে বালির খোলা করে উনুনের আঁচে কেক বানালো । কি যে স্বাদ তার ! আজও ভুলিনি । সেবছর পয়লা জানুয়ারি আমরা মামার বাড়িতে । দিদির জন্মদিন । সব পাঁচ সাতের খোকা খুকু আমরা । সকালবেলা মামা ভাবছে মাংস ভাত রান্না হবে আজ । মুশকিল হলো দিদিমা বামুনের ঘরের বিধবা । রাঁধবেন বাড়বেন কিন্তু অবেলায় স্নানও করবেন । হঠাত্ খেলতে খেলতে দেখি স্টেশনের দিক থেকে যে রাস্তাটা এসে মিশেছে চাইবাসা রোডে , তার মুখে বাবা দাঁড়িয়ে । রাস্তা পেরোলেই আমাদের হাতের নাগালে চলে আসবে । বাবার হাতে ঝুলছে দড়িবাঁধা একটা বাঁধাকপি । সবাই অবাক ! দিদি হতাশ । নাকিসুরে মাকে বলছে - ওঁমা দেঁখোনা ! বাবা কিঁ এনেছে । মা বিরক্ত । এই ভবঘুরে অসংসারী মানুষটাকে আর মানুষ করা গেলোনা । বাঁধাকপি ঝুলিয়ে এই ডবল উৎসবে কেউ শ্বশুরবাড়ি আসে । দিদির জন্মদিন আর নতুন বছর একসাথে । বাবা ততক্ষণে নাগালে চলে এসেছে । রহস্যময় হেসে মামার হাতে বাঁধাকপিটা দিতেই মামা একটু ঝুঁকে পড়ল । ওজনটা বুঝতে পারেনি মামা । অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল - এত ভারী কেন গো ? বাবা বলল - ওটা কেক । বাবির জন্মদিন তো আজ ! সব্বাই খুউব অবাক । এই বাঁধাকপি কপি নয় ? কেক ? সেই নাহুমের ? খুব মজা হলো সেদিন । মায়েরও মুখটা আলোকিত হয়ে উঠেছিল ।                       
 আজ কিছুকাল হলো পৌষ আমার কাছে তেমন সুখস্মৃতি বয়ে আনেনা । এরকমই এক পৌষের শীতে গিয়েছিলাম মামার বাড়ি । সেবছর ডিসেম্বরের একুশে চলে গেলেন দিদিমা । মামার বাড়ির সব মায়া যেন একাই নিয়ে চলে গেলেন । আর তারও পর , এরকমই এক তীব্র শীতের রাতে , পৌষের শেষে চলে গেলেন শ্বশুরমশাই । তাঁর শীতের ব্যবহারের নানান সরঞ্জাম পড়ে রইল খাট জুড়ে , ঘর জুড়ে , আর আমাদের চেতনা জুড়ে । আর এইতো সেদিন ! দার্জিলিং পাহাড়ে শেষ ডিসেম্বরের সোনাঝরা রোদ্দুরে শ্বেতাম্বর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঐশ্বরিক মহিমায় অনুভব করছি , হঠাত্ জানতে পারলাম জন্মদাতা চলে গেলেন ওই উচ্চতম শৃঙ্গেরও ওপরে । সেদিন ওই মহিমময়ের উপস্থিতিও আমার শোককে এতটুকু ঘোচাতে পারেনি । বয়স যত বাড়তে থাকছে পৌষমাস আর শীতকাল ততই মৃত্যুর তীব্রতা বহন করে আনছে । শীতের সুখময় স্মৃতি দ্রুত অপসৃয়মান । এখন তাই উষ্ণতা টুকুই চাই । আপনজনের , প্রিয়জনের সান্নিধ্যে , আলিঙ্গনের নিরাপত্তাজনিত উষ্ণতা । মৃত্যুর মতন হিমশীতল শীত আর চাইনা ।

No comments:

Post a Comment