Monday 30 January 2017

বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
গন্তব্য
প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করেছে সুনীল । সাতটা বেজে গেছে । সবাই এসেও গেছে । ওর জন্যই গাড়ি ছাড়া যাচ্ছেনা । এর মধ্যেই সুনীলকে ফোন করে চরম খিস্তি মেরেছে সৌমিক । তাতে অবশ্য সুনীল কিছু মনে করেনি । উল্টে ব্যবহার করেছে আরও জোরালো খিস্তি । সেই কলেজ লাইফ থেকেই সৌমিককে দেখে আসছে সুনীল । জানে পাল্টা খিস্তি না দিয়ে সৌমিককে থামানো চাপ আছে । কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা স্টেশনের যে জায়গায় সরকারী গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে এসে পৌঁছয় সুনীল ।
---হ্যাঁ এটাই । জাইলো গাড়ি বিয়ারিং নাম্বার ০৮১২ । এমনটাই কথা হয়েছিল কাল রাতে । ওদের হোয়্যাটস অ্যাপ এর ‘খেলো’ গ্রুপে । আনিরুল সেরকমই লিখেছিল । আনিরুল গাড়ি অ্যারেঞ্জ করার দায়িত্বে আছে । ‘খেলো’ দের ভাষায় অবশ্য ও সি -গাড়ি ।  সুনীল গাড়ির কাছে পৌঁছতেই দরজাটা খুলে দিয়ে ধারের জায়গাটা সুনীলের জন্য রেখে মাঝে সরে যায় জীবন । জীবন এদের মধ্যে সবচাইতে আঁতেল । জনসংযোগের ব্যাপারটা দায়িত্ব নিয়ে দেখতে গিয়ে ঘেঁটে ফেলে বারবার । তবু ছাড়েনা ।  জীবনের মিষ্টি ব্যবহার আর প্রাণোচ্ছলতার জন্য এরা সবাই ওকে খুব প্যাম্পারও করে ।
---‘অলরেডি ৭ টা ১৫ । এবার গাড়িটা না ছাড়লে সালানপুরে পৌঁছাবার আগেই গ্রামসভা শুরু হয়ে যাবে।’ ---পিছনের সিট থেকে চিৎকার করে বিপ্লব । ---সুনীলরা সাতজন আসলে সামাজিক নিরীক্ষা শাখায় কাজ করে । একশো দিনের কাজ , ইন্দিরা আবাস যোজনা প্রভৃতি কেন্দ্রীয় সরকারী স্কিমের সামাজিক নিরীক্ষা বা সোশ্যাল অডিট ফেসিলিটেট করাই ওদের মূল কাজ । সেই উদ্দেশ্যেই আজ ওরা সালানপুর উন্নয়ন ব্লকের বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতে সামাজিক নিরীক্ষা সংক্রান্ত গ্রামসভায় অংশ নিতে যাচ্ছে । ওদের কাজ বলতে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে কিছু সম্পদ কর্মী আছে তাদেরকে দিয়ে পুরো প্রসেসটা ঠিকঠাক ফেসিলিটেট করানো এবং অ্যাকচুয়াল ফিল্ড লেভেল রিপোর্ট তুলে আনতে ওই সম্পদ কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা । আনিরুলের ভাষায় অবশ্য বার খাইয়ে কাজ হাসিল করে নেওয়া ।
 বিজয় আর সুন্দর সিগারেট শেষ করেই সোজা উঠে পড়ে পিছনের সিটে । মোবাইলে চোখ রাখে সৌমিক । ৭ টা ২০ । সালানপুর উন্নয়ন ব্লকের উদ্দেশ্যে ওদের যাত্রা শুরু হয় । পিছনের সিটে সুন্দর , বিজয় আর বিপ্লব । মাঝের সিটে সুনীল , জীবন আর সৌমিক । ড্রাইভারের পাশের সিট টা রাখা আছে আনিরুলের জন্য । আনিরুল গলসিতে উঠবে ।
---‘আজ এতগুলো গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রামসভা ঠিকঠাক কভার করা যাবে তো ?’ ---যথারীতি আত্মবিশ্বাসের অভাব জীবনের গলায় ।
---পাশ থেকে গর্জে ওঠে সুনীল । ---‘তোর এই এক দোষ জীবন । তোর সবই ভালো । শুধু আত্মবিশ্বাসটা তলানীতে।’---পিছনের সিট থেকে বিপ্লব বলে ওঠে –‘ এত ভয় পাস কেন বলতো ? সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে । আমরা পারিনা এমন কাজ পৃথিবীতে নেই।’
--- ‘সম্পদ কর্মী হিসেবে যাদের নির্বাচন করা হয়েছে আর সুনীল যাদের টিমলিডার বেছেছে না , গড়গড় করে কাজ এগোবে।’ ---সংযোজন করে সুন্দর । ---‘তুই একদম চিন্তা করিসনা জীবন । সম্পদ কর্মীদের প্রশিক্ষণ যেমন ফাটাফাটি হয়েছিল সামাজিক নিরীক্ষাও সেরকমই হয়ে যাবে । তুই বরং যেতে যেতে তোর নতুন গল্পের প্লট টা ভেবে নে।’---জীবনের স্বপ্ন সে বিরাট লেখক হবে । লেখক হিসেবে সাফল্য বলতে রয়েছে লিটল ম্যাগাজিনে কিছু প্রকাশিত লেখা । সেগুলো নিয়েই জীবনকে উৎসাহ দেয় এরা । এদের উৎসাহটা ঠিক পুরোপুরি উৎসাহ না বার খাওয়ানো সেটা আজও বুঝে উঠতে পারেনি জীবন ।
---‘হ্যাঁ বল । হ্যাঁ হ্যাঁ এই ঢুকে গেছি গলসি । আর দু’ মিনিট।’---আনিরুলের ফোনটা কেটে দিয়ে সৌমিকের মাথায় এক চাঁটি দেয় বিজয় ।
---‘ শালা বিপ্লবের চকচকে টাকটা ছেড়ে আমার মাথায় চাঁটি মারছিস কেন ? ’--- সহজাত ভঙ্গিমায় খিস্তি সহযোগে ঝাঁজিয়ে ওঠে সৌমিক । ---বিপ্লবের এই তিরিশ বছর বয়সেই মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে । খুব সম্ভবত পেটের গণ্ডগোলের জন্য । বাইরের খাবার মোটেই খায়না বিপ্লব । এদের মধ্যে সবচেয়ে হাইজেনিক বিপ্লবই ।
---গলসি এসে গেছে । সিগারেটের শেষাংশ বুটের তলায় পিষে দিয়ে গাড়ির দরজা টেনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পরে আনিরুল । একশো কুড়ির ও বেশি স্পীডে গাড়িটা ছুটেই চলেছে  ন্যাশনাল হাইওয়ের উপর দিয়ে । বিজয় ড্রাইভারকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে পানাগড়টা যাহোক করে তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতেই হবে । ওখানে আটকে গেলেই বিপদ ।
---‘ পেপারটা মুখস্থ হয়ে গেছে রে এবার রাখ।’---আনিরুলের উদ্দেশ্যে খোঁচা দেয় সুনীল । আনিরুল আসলে পলিটিক্যাল নিউজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে । এদের মধ্যে নেতাসুলভ অ্যাটিটিউড একমাত্র আনিরুলেরই রয়েছে । সৌমিক যতই সেটা নিয়ে ঠাট্টা করুক না কেন ফিল্ড লেভেলে কোনও সমস্যা হলে আনিরুলই সামলে দেয় । এইসব সমস্যা এলেই জীবন হাত তুলে দেয় । মুখে বলে , পলিটিক্যাল জনসংযোগের ব্যাপারটা আনিরুল তুই দেখে নে । প্রশাসনিক লেভেলে জনসংযোগের ব্যাপারটা আমি দেখে নেবো । প্রশাসনিক ব্যাপারগুলো সত্যিই খুব ভালো সামলাতে পারে জীবন । বিজয় বলে , জীবন তোর মুখটার মধ্যেই একটা সারল্য আছে যার জন্য প্রশাসনের কর্তা ব্যাক্তিরা খুব বিশ্বাস করে । ---সুন্দর আবার পুরো ব্যাপারটা ভীষণ সাজিয়ে উপস্থাপন করে সবসময় । বলে , জীবন তুই আসলে মালা গাঁথার সুতোটা যেটা না থাকলে মালাটা গাঁথায় যাবেনা । তুই না থাকলে আমাদের সামাজিক নিরীক্ষা শাখা কে আর একসূত্রে বেঁধে রাখা যাবেনা ।
---‘যাক বাবা পানাগড় পেরিয়ে গেছি আর চিন্তা নেই ।’---অনাবিল হাসি ফুটে ওঠে সুনীলের ঠোঁটে । ওদের গাড়িটা দাঁড়িয়েছে পানাগড় দার্জিলিং মোড়ের কাছে নাগ হোটেলে ।
---কচুরী অর্ডার করে সুন্দর । জীবন আর সুনীল টয়লেট সেরে আসে । কচুরী শেষ করার আগেই বড় ভাঁড়ে চা-এর অর্ডার দেয় আনিরুল । চা-এ চুমুক দিতে দিতে উদাস দৃষ্টিতে ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে জীবন । মনে হয় সবাই কেমন যেন নেশার মতো ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে ।
---নাগ হোটেলের বিল মিটিয়ে দেয় সৌমিক । সৌমিক অফিসে ক্যাশিয়ারের কাজ সামলায় । ফাঁক পেলেই বিনা পয়সায় ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইস দিতে সিদ্ধহস্ত সৌমিক । এই বিষয়ে ওর যথেষ্টই সুনাম ।
---‘আবার সিগারেট ধরিয়েছিস । চল চল দেরি হয়ে যাবে ।’ ---তাড়া দেয় জীবন ।
---‘ দাঁড়া না । একটু আমেজ করে সিগারেটটাও টানতে দিবিনা নাকি । তুই গাড়িতে ওঠ । আমরা আসছি ।’---সুখটান দিতে দিতেই বলে সুন্দর ।
---জীবনের মতে সুন্দরের সব ভালো এই সিগারেটের নেশাটি ছাড়া । সুন্দর অবশ্য ওটাকে নেশা মনে করেনা । জ্ঞ্যানপাপীর মতো বলে , বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে কখনোই বলবো না সিগারেট টানলে মানুষের ক্ষতি হয়না । তবে নিশ্চিন্তে থাক যেদিন বুঝবো কষ্ট হচ্ছে সেদিন নিজেই ছেড়ে দেব বুঝলি । সুন্দর বরাবর ভীষণ ক্যাটেগরিক্যাল । এদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ছাত্র সুন্দরই । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এম এস সি । জোর গলায় বলে যাদবপুর থেকে আর কিছু শিখে আসি না আসি নেশা করার ব্যাপারটা যাদবপুর ক্যাম্পাস থেকেই শিখে এসেছি । নেশার ব্যাপারে ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী বিজয় । বিজয়ও রসায়নে এম এস সি ।
---‘ আসানসোল জুবিলী মোড় চলে এলো মনে হচ্ছে ।’--- চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞাসা করে বিপ্লব ।
---‘ যাক তোর ঘুম ভেঙেছে । কাল রাতে বৌদি কি তোকে ঘুমোতে দেয়নি ?’ ---হাসতে হাসতে বলে ওঠে সৌমিক । সৌমিকের মুখে আসলে কোনও কথায় আটকায় না । এরা কেউ সৌমিকের কথায় কিছু মনেও করেনা । বোধহয় কেউই কারও কথায় কিছু মনে করেনা । লোকে বলে কলিগদের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়না । কিন্তু এরা সব ভাবনা –চিন্তার ওপরে । বিজয় এদের সবাইকেই শুধু বলে , ‘তুই আমার ভাই রে !’ ---সৌভ্রাতৃত্ব বোধ পুরোপুরি বিদ্যমান এদের মধ্যে । --- এদের দেখে একবারও মনে হয়না যে কোনও অফিসিয়াল কাজে যাচ্ছে । মনে হয় বন্ধুরা মিলে হইহই করে পিকনিকে যাচ্ছে । এদের সঙ্গে ড্রাইভারও অভ্যস্ত হয়ে গেছে ।
 ‘দারুন গ্রামসভা হল কি বলিস তোরা ?’ ---সবার উদ্দেশ্যেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে জলের বোতলটা থেকে ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল গলার ভেতরে চালান করে বিজয় । ---‘আমার ওখানে তো খুব অর্গানাইজড হয়েছে গ্রামসভা । সম্পদ কর্মীরা খুব ভালো প্রতিবেদন পাঠ করেছে । প্রধান সাহেবও ভীষণ ভালো উত্তর দিয়েছেন সবকিছুর । খুব এফেক্টিভ ।’
---‘ আসলে গ্রামসভায় বলার পরিবেশ তৈরি করাটাই বড় কথা । আমার ওখানেও আলোচনার মাধ্যমে কিছু বিষয় উঠে এলো । একশো দিনের কাজ সংক্রান্ত । খুব ভালো সমাধান সূত্রও উঠে এলো ।’---সংযোজন করলো আনিরুল ।
---ইতি উতি চাইছে সুন্দর । সিগারেট ধরাতে চাইছে কিন্তু সন্ধ্যা নেমে গেছে বলে গাড়ি থামাতে বলতে পারছেনা । বিজয় হঠাত বলে উঠলো , দুর্গাপুর পেরোলে একবার দাঁড়াবে ভাই । ইঞ্জিনে ধোঁয়া দিতে হবে । তারপরই গলা ছেড়ে গান ধরলো বিজয় –‘যেতে যেতে পথে হলো দেরি...’ ---বিজয় একসময় ব্যান্ডে ড্রাম বাজিয়েছে । গানের প্রতি ওর অদ্ভুৎ নেশা । গানের গলাটিও চমৎকার ।
 কর্পোরেট চাকরি ভালো না সরকারী চাকরি এটা নিয়ে এবার বকবক শুরু করেছে সৌমিক । সঙ্গে পেয়েছে জীবন আর সুনীলকে ।
---‘কর্পোরেট চাকরিতে প্রচুর টাকা রোজগার করা যায় কিন্তু খরচ করার সময় পাওয়া যায়না । ফ্যামিলি বলে কিছু থাকেনা কর্পোরেটে , অফিসটাকেই বাড়ি বানিয়ে ফেলতে হয় । মানে নিজের কিউবিকল এর গণ্ডির মধ্যেই এক টুকরো স্বাধীন সংসার ।’--- এই ব্যাপারে বরাবর ভীষণ স্ট্রং ওপিনিয়ন সুনীলের । মোটা বেতনের কর্পোরেট জব ছেড়ে সে সরকারী চাকরি জয়েন করেছে । এই বিষয়ে অন্তত সুনীলকে ঘাঁটাবার ধৃষ্টতা এরা কেউ দেখায়না ।
 জানালার ধারে বসে চুপচাপ মোবাইলটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে সৌমিক । মুডটা কোনও কারনে অফ হয়েছে মনে হচ্ছে ।
---‘কিরে সৌমিক হঠাত গুম মেরে গেলি কেন ?’ ---ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে কড়া ভঙ্গিতে প্রশ্নটা ছুঁড়লো আনিরুল ।
---‘ না , আসলে একটা বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল আজ । বাড়ি পৌঁছতেই তো রাত হয়ে যাবে । আর বিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবেনা । তোরা তো জানিস আমি খেতে খুব ভালোবাসি । খাওয়া মিস হবে বলেই মুড অফ ।’ --- সৌমিকের গলায় গভীর হতাশা ।
---পিছন থেকে হঠাত নস্ট্যালজিক হয়ে পড়ে বিজয় । ---‘ খাওয়া নিয়ে বলতেই মনে পড়ে গেল – কলেজ হোস্টেল থেকে কত বিয়ে বাড়িতে যে খেয়েছি তার কোনও ইয়ত্তা নেই । বিয়ের দিন থাকলেই রাতে মিল অফ করে দিতাম । দুই –তিনজন মিলে গিয়ে সাঁটিয়ে দিতাম । কোনোদিন কোনও প্রবলেম হয়নি ।’
---‘ তাহলে আজও হয়ে যাক । পানাগড় পেরিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর কোনও বিয়ে বাড়ি পেলেই ঢুকে পড়বো সবাই মিলে । ডান ?’ ---সুনীলের গলায় তখন কলেজ লাইফের উন্মাদনা ।---সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো ডান ।
 ওদের কথা মতো বুদবুদের কাছে জাতীয় সড়কের পাশেই একটি বিয়ে বাড়ির সামনে গাড়িটা পার্ক করেছে ড্রাইভার । বিয়েবাড়ির চারদিক ঝলমলে আলোয় ভরে গেছে । কানে আসছে সানাইয়ের মিষ্টি সুর । দুটো একটা কার আর বাইক এসে দাঁড়াচ্ছে মাঝে মধ্যেই । ব্যস্ততা নিয়ে ইতি উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে বিয়েবাড়ির কর্মকর্তারা । ছয়-সাতজনের একটা দল বিয়েবাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সবাই মেয়ে । সবাই পরিপাটি করে শাড়ী পরেছে । সবাই চুলে ঝুলিয়েছে রজনীগন্ধার মালা । মনে হয় ওরাই অতিথি –অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার দায়িত্বে রয়েছে । সুনীলদের গাড়িটা যেখানে পার্ক করা হয়েছে সেখানে খানিকটা আলো - আঁধারি । সুন্দর আর বিজয় কোথায় খাওয়ানো হচ্ছে সেটা দেখে আসতে গেছে । ড্রাইভার সহ বাকি ছয়জন গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েই গল্প করছে । আনিরুলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে বিয়েবাড়ির গেটের দিকে । তাকিয়ে আছে অপলক । হয়তো সুন্দর আর বিজয়ের ফেরার অপেক্ষা করছে । জীবন কি রকম যেন একটা থ্রিল অনুভব করছে । আসলে ও আগে কোনোদিন এভাবে খেতে আসেনি । আজকের ব্যাপারটা ও পুরো অ্যাডভেঞ্চার হিসেবেই নিয়েছে ।
---‘চল চল । ব্যাচ উঠেছে । আর দেরি করা যাবেনা । অলরেডি ৮ টা ৫ ।’---সুন্দরের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই ওরা স্মার্টলি এগিয়ে যায় বিয়েবাড়ির গেটটার দিকে । জীবন খেয়াল করে সুসজ্জিত গেটটাতে আলো জ্বলছে আর নিভছে । বারবার লেখা ফুটে উঠছে সুমনা ওয়েডস সুব্রত ।
---খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে আসছে ওরা । সুনীল একটা লম্বা ঢেঁকুর তুলে বলে , খুব তৃপ্তি করে খেলাম ভাই । জানিসই তো আমি মাংস খেতে খুব ভালোবাসি । ---বিজয় বলে ওঠে , দারুণ রান্না হয়েছিলো চিকেনটা । এখনও মুখে লেগে আছে । ---মোবাইলে সময়টা দেখে নেয় সৌমিক । নটা বাজতে দশ । ‘ দুগগা দুগগা করে বেরিয়ে পড়ি চল তাহলে বর্ধমান স্টেশন থেকে দশটার কর্ড লাইন লোকাল টা পেয়ে যাব ।’---বেশ উত্তেজিত শোনায় সৌমিকের কন্ঠস্বর ।
---আনিরুল হঠাৎ খেয়াল করে খাবার জায়গার উল্টোদিকটাতে একটা জটলা তৈরি হয়েছে । ওইখানেই বরের বসার জায়গা রয়েছে । হঠাৎ  সানাইটা বন্ধ হয়ে যায় । সানাইটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই বোঝা যাচ্ছে চিৎকারটা । আওয়াজটা ভেসে আসছে বরের বসার জায়গাটার ওদিকটা থেকেই । মুহূর্তে পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেছে । ---‘ তোরা এখানেই একটু দাঁড়া , আমি আসছি ।’--- বলেই বরের বসার জায়গার দিকে এগিয়ে চলে আনিরুল । পিছু পিছু ওরা সবাই ।
---‘আর মাত্র আধ ঘন্টা পরেই লগ্ন । তুমি যদি আমার মেয়েটাকে বিয়ে না করো তাহলে মেয়েটা লগ্নভ্রষ্টা হবে বাবা । ওর আর বিয়ে হবেনা ।’--- বরের পা দুটো ধরেই  কাকুতি -মিনতি করছে মেয়ের বাবা । ---মুখটা বাঙলার পাঁচের মতো করে ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবী পরিহিত বর ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে আছে । ---মুহূর্তে ভিড় জমে গেছে ওখানে । বিভিন্ন লোক বিভিন্ন কথা বলছে । কে একজন বলে ওঠে , তখনই বলেছিলাম অনুপমদাকে । সমানে সমানে সম্পর্ক করাই ভালো । সাত লাখ টাকা নগদ , রয়্যাল এনফিল্ড গাড়ি , অল ফার্নিচার , দশ ভড়ি গহনা – তোমার পক্ষে জোগাড় করা অসম্ভব । শুনলোনা আমার কথা , হাই স্কুলের মাস্টার জামাই করবার জন্য ঝাঁপাতে গেল । তখন আমার কথা শুনলে আর এই বিপত্তি হতো না । চাষিবাসী ঘরেই বিয়ে হত না হয় । তবু তো মেয়েটা সংসার করতে পারতো । ---থরথর করে হাত দুটো কাঁপছে আনিরুলের । বাবা মারা যাওয়ার পর নিজের দায়িত্বেই বোনের বিয়ে দিয়েছে আনিরুল । এই সিচুয়েশনের অভিঘাতটা সবচাইতে বেশি বুঝতে পারছে আনিরুলই । ‘ বাঞ্চতকে কেলিয়েই দেবো আজ ।’--- উত্তেজনায় ফুটছে আনিরুল ।
--- ‘ কি লাভ মারধোর করে ! জোর করে বিয়ে দিয়েই বা কি লাভ ! মেয়েটা তো আর সুখী হবেনা।’--- জীবনের গলায় হতাশা । ---অফিসিয়াল কাজের দিক থেকে দেখতে গেলে জীবনরা একধরণের সমাজকর্মীই । কি লাভ ওইসব তকমা নিয়ে । সমাজের কোনও কাজেই তো আসেনা ওরা । জীবনের হতাশা বাড়তে শুরু করে ।
---ওরা খেয়াল করে ছেলের হাতটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে বরের বাবা । ---‘ যেখানে কথার কোনও দাম নেই সেখানে আমার ছেলের বিয়ে দেব না । বিশ পঞ্চাশ হাজার হয় বাকি রাখা যায় । তাই বলে তিন লাখ টাকা বাকি তে আমার ছেলের বিয়ে দেব না । ছেলে আমার হাই ইস্কুলের ইতিহাসের মাস্টার । ভালো পরিবারে আমার ছেলের বিয়ে দেব ।’--- গর্জন থামছেই না ছেলের বাবার । ---বরের মাথা থেকে শোলার মুকুটটা খুলে মাটিতে পড়ে যায় । বরের চোখে মুখে একটা উত্তেজনা ফুটে উঠছে । হয়তো বিয়ে না করে চলে যেতে মন চাইছে না । কিন্তু বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সৎসাহস বা মেরুদণ্ড কিছুই পরিলক্ষিত হচ্ছে না । মুখ দিয়ে কথা সরছে না হাই ইস্কুলের ইতিহাসের মাস্টারের ।
---বরযাত্রী সহ বর চলে গেছে । বরযাত্রীরা যাবার সময় নানান ধরণের ফুল দিয়ে সাজানো বিয়েবাড়ির গেটটা ভেঙে দিয়ে গেছে । সুনীল খেয়াল করেছে ফুল গুলো ছিঁড়ে ওরা জুতোর তলায় পিষে দিয়ে গেছে । সুনীলের মনে হচ্ছে শুধু ফুল নয় ওরা যেন পিষে দিয়ে গেল সভ্যতাকেই । গেটে আর আলোও জ্বলছে না । সুমনা ওয়েডস সুব্রত লেখাটাও আর ফুটে উঠছে না । অতিথি –অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার দায়িত্বে ছিল যে কিশোরীদের দল তারা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে । চুল থেকে রজনীগন্ধার মালা খুলে ফেলেছে ওরা ।
---ছাঁদনা তলায় বসে আছে কনে । গলার রজনীগন্ধার মালাটা ছিঁড়ে ফেলেছে । চোখের জলে কনের সাজ ধুয়ে মুছে গেছে একেবারে । মনে হচ্ছে যেন সবে বিয়ের দৃশ্যের শট দিয়ে ক্লান্ত । মেকাপ তুলতে পারলে বেঁচে যায় । মেয়ের মা মূর্ছা গেছে । ওদিকটাতে মেয়ের মা’র মুখে হাতে জলের ছিটে দিচ্ছে মেয়ের মাসি-পিসিরা । মেয়ের বাবা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে মনে হচ্ছে । কান্নার শক্তিও বোধহয় আর অবশিষ্ট নেই । পাশ থেকে একটা বিধবা বুড়ি চিৎকার করছে –‘ মেয়েটা লগ্নভ্রষ্টা হল গা । এমন অলক্ষুণে মেয়েমানুষ কে বাড়িতে রাখাও পাপ ।’---বিধবা বুড়িটার বিধান কেউ শুনছে বলে মনে হচ্ছে না । কোনও প্রতিবাদও ভেসে আসছে না কোনোদিক থেকেই ।
 জীবনকে সঙ্গে নিয়ে ছাঁদনা তলার দিকে এগিয়ে চলেছে সুন্দর । জীবন একটু কনফিউজড । তবে এই মুহূর্তে আত্মবিশ্বাসের কোনও খামতি নেই জীবনের । যে কোনও লেভেলের জনসংযোগ সে অবলীলায় করে দেবে যেন । ---বুক চিতিয়ে হাঁটছে সুন্দর । তার পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির সুঠাম চেহারার পাশে জীবনের ছোটোখাটো চেহারাটা বড্ড বেমানান লাগছে । সব কিছু মিলিয়ে জীবনের মনে হচ্ছে –‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন । ’---যাদবপুরের ক্যাম্পাস থেকে সুন্দর যে শুধুই নেশার ব্যাপারটা নিয়ে এসেছে তা বোধহয় নয় । মুখ থুবড়ে পড়া সভ্যতাকে স্বমহিমায় কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সেটাও সে শিখেছে যাদবপুরের ক্যাম্পাস থেকেই । এটাও এক ধরণের কলরব , যে কলরবে শব্দ হয়না । পাশে পাওয়া যায় অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষকে । সুন্দর আর জীবনের পিছু পিছুই এগিয়ে চলেছে সুনীলরা । সুনীল , বিজয় , বিপ্লব , আনিরুল , সৌমিক আর ড্রাইভার । সুন্দরের এই অ্যাটিটিউডটা এদের সবার কাছেই অপরিচিত । সুন্দরের চোখে মুখে একটা অদ্ভুত দ্যুতির প্রকাশ পাচ্ছে । ---আকাশে আজ অনেক তারা । সারা আকাশ জুড়ে তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে । বিয়েবাড়ির অধিকাংশ লাইট নিভে গেছে । আলো -আঁধারিতে আজ আকাশটাকে খুব নির্মল দেখাচ্ছে । ---সুন্দরের দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জীবন । সুন্দরকে এতটা আনপ্রেডিক্টেবল কখনও মনে হয়নি । একটু পিছনেই সুনীলরা । উত্তেজনায় যেন ফুটছে সবাই । ---আকাশের চাঁদটাকে আজ ভীষণ রকমের মায়াবি মনে হচ্ছে সুন্দরের । চাঁদটা যেন কনে -বউ সেজে সুন্দরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে । একটু পিছনেই ওরা সবাই । সুন্দর গন্তব্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত ওরাও থামবেনা মনে হয় । সুন্দরের বুকের পাশ দিয়ে একটা জোনাকির ঝাঁক পেরিয়ে যাচ্ছে । জোনাকি গুলো জ্বলছে –নিভছে , জ্বলছে –নিভছে । ওরা সবাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখছে -জোনাকি গুলোর জ্বলন্ত অবয়বে ফুটে উঠছে সুন্দর ওয়েডস সুমনা । দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে সুন্দর । গন্তব্যের দিকে ।

No comments:

Post a Comment