Friday 10 March 2017

বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
শিক্ষা
অভিজিৎ মান্না


ঢং - ঢং - ঢং..... ছুটির ঘন্টা বাজার সাথে, সাথেই তুলিকা ব্যাগ নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে ক্লাস-টুর ক্লাসরুম থেকে। হাত গলিয়ে পিঠে ব্যাগটা নিতে নিতে পড়িমরি করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে দৌড়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বেরিয়ে পরে রাস্তায়। কিন্তু, এসে হতাশ হয়। 'তার বাবা এখনো তাকে নিতে আসেনি-! কিন্তু কেন-? স্কুল কি আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে-! নাকি সে ভুল করে ছুটির আগেই নেমে এসেছে-!' ভাবতে থাকে তুলিকা। 'বাবা তো রোজই আগে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করে-!'
হৈ-হৈ করে তার বন্ধুদের নেমে আসতে দেখে বুঝতে পারে সে কোনো ভুল করেনি-- 'সত্যিই স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। তাছাড়া অনেকেরই বাবা-মা এসে গেছে ; শুধু আমার বাবাই আসতে দেরি করছে-! ধুত ভাল্লাগেনা-!' --- ছোট্ট তুলিকা বুকের গভীরে বহু অভিমান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে বাবার জন্যে। ঘাড় ঘুরিয়ে, ঘুরিয়ে দেখতে থাকে এদিকওদিক........
সেই রোজকার ফুচকাওয়ালা-টা আজও দাঁড়িয়ে আছে ; তার কয়েকজন বন্ধু ও তাদের মা মিলে ফুচকা খাচ্ছে। আইসক্রিমওয়ালা-টা আইসক্রিম দিচ্ছে আর ঘণ্টি বাজিয়েই চলেছে। রাস্তার ওপারে পার্ক-টায় প্রতিদিনকার মতো আজও সেই বুড়োদাদু আর ঠাকুমা হাত ধরে একটা বড়-পাথরের উপর পাশাপাশি বসে আছে।  কি যেন গুজগুজ করছে তারা, 'ধুত-! রোজেরই তো করে-!'
এদিকওদিক তাকাতে, তাকাতে তুলিকার নজর আটকে গেল এক কিশোরীর দিকে। একে আগে কোনদিন দেখেনি সে। ঠিক তারই সমবয়সী একটা মেয়ে। যেন ঠিক তার মতোই কতকটা মুখের আদল-!  তবে, মেয়েটার গায়ে নোংরা ছেঁড়া জামা। সমস্ত শরীর, মুখ ধূল-বালিতে মাখা। মাথায় জট-পাকানো রুক্ষ লালচে চুল। মেয়েটাকে দেখে তুলিকার কচি মনে হাজার ভাবনার উদয় ঘটে--- 'মেয়েটাকি কোনদিন স্নান করেনা-! মাথায় শ্যাম্পু মাখেনা-! এমা ছেঁড়া জামা পরেছে কেন-?  মেয়েটার কি সাজতে ভালো লাগেনা-! ওকে কি কেউ সাজিয়েও দেয়না-! মেয়েটার বাবা-মা মেয়েটাকে বকেনা কেন-? কানমলা দেয়না কেন-? মেয়েটার বাবা-মা খুব বাজে খুব খারাপ।' 
তুলিকা লক্ষ্য করে মেয়েটা তার বন্ধুদের বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে হাত পেতে কি যেন বলছে; কিন্তু, সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, পিছু ফিরে দাঁড়াচ্ছে। তাকে দেখে তুলিকার খুব কষ্ট হয়, বুকের ভিতরটা কিরাম যেন করে ওঠে তার। 'কেন তার সাথে কেউ কথা বলতে চাইছে না-! কেন সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে-! ওর বুঝি কোনো বন্ধু নেই-! ও মনে হয় খুব বিপদে পরেছে, তাই বুঝি সবাইকে কিছু বলতে চাইছে।' তুলিকার মনে উপকার করার বাঞ্চা জেগে ওঠে, সে এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে........
ঠিক তখনি তুলিকাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেড-মাষ্টার পরেশ বাবু স্কুলের গেট পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন। ছেঁড়া-বস্ত্র পরা মেয়েটি এগিয়ে যায় পরেশ বাবুর দিকে--- পিছনদিক থেকে ডান হাত-টা টেনে ধরে। পরেশ মাষ্টার বেশ অবাক ও বিরক্তিমাখা মুখে পিছু ফিরে চায়।  মেয়েটি করুণ কণ্ঠে বলে ওঠে-- "বাবু, দুটো পয়সা দিন-না বাবু। তিনদিন কিছু খাইনি বাবু। বড় খিদে পেয়েছে বাবু। দিননা বাবু। দিননা।" পণ্ডিত-মশাই যেন তৎক্ষণাৎ ক্ষেপে উঠেন--  "এই হাত ছাড়, ছাড় বলছি। যা এখান থেকে। বিদায় হ।"
"দিননা বাবু দিননা। দুটো পয়সা দিননা। বড় খিদে পেয়েছে।" মেয়েটি কিছুতেই হাত ছাড়তে চায়না, আরো জোরে চেপে ধরে।
ভদ্রলোক তার হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। অবশেষে চোখেমুখে একরাশ ঘৃণা এনে ভদ্রলোক হাত ছিনিয়ে নিয়ে একটা জোর ধাক্কায়  ঠেলে ফেলে দেয় সেই অসহায় অনাথ কিশোরীকে।
তুলিকা ছুটে যায়। তাকে তোলে। গা,হাত ঝেড়ে দেয় তার। তারপর পরেশ বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে-- "স্যর, এটা আপনি কি করলেন-! এমা আপনি জানেননা, কাউকে কোনদিন কষ্ট দিতে নেই-! কাউকে কষ্ট দিলে নিজেকেও কষ্ট পেতে হয়। আমাদের বাংলা টিচার কমলা দি-ভাই একথা বলেছে, আপনি শিখে নেবেন।"
পরেশ স্যরের মাথায় এবার যেন খুনচড়ে যায়। তুলিকার দিকে রক্তবর্ণ চোখে কটমট করে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বলে ওঠেন-- "এই তুই জানিস তুই কার সাথে কথা বলছিস-? বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না-?"
"আমি ভুল কি বললাম স্যর-? যেটা টিচার শিখিয়েছে সেটাই তো বললাম স্যর-! আপনি বোধয় শেখেননি, দি-ভাইকে বলে দেবো আপনাকে শিখিয়ে দিতে।"
"অসভ্য, ছোটলোক, অশিক্ষিত, নিকৃষ্ট কোথাকার; ছোট হয়ে বড়, বড় কথা।" -- বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে ওঠে পরেশ বাবু। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তুলিকাকে কষে একটা চড় মারার জন্য হাত তোলেন ভদ্রলোক। ছোট্ট তুলিকা তার দোষ খুঁজে না-পেয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে কাঁদোকাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু প্রায় শেষ মুহূর্তে হেড-স্যরের হাত ধরে ফেলেন তুলিকার বাবা সুকুমার বাবু। সুকুমার বাবু কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন, তার কন্যা ও স্যরের সমস্ত কথাই তিনি শুনেছেন। তাই হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন-- "তা আমার মেয়ে কি কারণে মার খাচ্ছে জানতে পারি কি মাস্টারমশাই-?"
"ও এই অশিক্ষিত-টা তাহলে আপনার মেয়ে, কি ভালো শিক্ষা দিয়েছেন মেয়েকে-! ছিছিঃ ছিঃ-!"
"সত্যিই ভালো শিক্ষা দিয়েছি। আমি গর্বিত যে ও আমার মেয়ে। তবে কি জানেন-তো আমি ওকে এই স্কুল ছাড়িয়ে দেবো; যে স্কুলের শিক্ষকই মূর্খ, সেই স্কুলের শিক্ষা আমি আমার মেয়েকে নিতে দেবো-না। আপনার স্কুলের বিদ্যার্থীরা আপনার শিক্ষাই পাবে কি-না।"
"আপনার সাহস তো কম নয়-! আপনি হেড-মাস্টারের সাথে এইভাবে কথা বলছেন-!"
সুকুমার বাবু ঠোটের কোণে মৃদু হেসে বললেন-- "হেড-মাস্টার আপনার পাণ্ডিত্য দেখে আমি সত্যিই অবাক-! আপনি সত্যিই মূর্খ। উচিত কথা বলতে সাহসের দরকার হয় বলে তো আমি জানিনা-! শুধু কয়েকটা ডিগ্রী থাকলেই যে শিক্ষিত হওয়া যায়না, এর দৃষ্টান্ত তো আপনি নিজেই। আপনি বিজ্ঞ মানুষ, আপনার অনেক সুখ্যাতি আছে; কিন্তু আপনি কতটা অজ্ঞ তা-কি আপনি জানেন-? আপনি কোনো নামকরা স্কুলের হেড-মাস্টার হতে পারেন, তবে আমার মেয়ে অপনার থেকে শতগুণ বেশি শিক্ষিত।" -- এর প্রতিবাক্য কি হবে সেটা পরেশ বাবুকে ভাববার সময় না-দিয়েই সুকুমার বাবু রাস্তার অপর-প্রান্তে তর্জনীনির্দেশ করে আবার বললেন-- "ঐ দেখুন শিক্ষা কাকে বলে-- শিক্ষা, একেবারে খাঁটি শিক্ষা। এই শিক্ষা পয়সা দিয়ে কেনা যায়না, তাই এই শিক্ষার কোনো ডিগ্রী-ও হয়না।"
পরেশ বাবু এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখেন-- তুলিকা তার ব্যাগের উপরের চেনটা খুলে হাতের-তালুতে সমস্ত খুচরো-পয়সা জড়ো করে চলেছে। তার চোখ উজ্জ্বল, সমস্ত মুখ জুড়ে খুশি ছড়িয়ে আছে। আর সেই নাম না-জানা অভাগী মেয়েটা একটার পর একটা ফুচকা মুখে পুরছে।  তুলিকার শিক্ষা যেন এক সার্থক রূপ পেয়েছে। 
সুকুমার বাবু এগিয়ে যান তার তনয়ার দিকে। হেড-স্যর পরেশ বাবু একভাবে তাকিয়ে থাকে তুলিকা আর অভাগীর দিকে। ঠিক তখনই যেন কোনো গাছের মগডাল থেকে ডেকে ওঠে এক নাম না-জানা পাখি। যেন তার কানে কানে বলে যায়-- "যে শিক্ষা মানুষের দুঃখ, কষ্ট মুছেই না দিতে পারলো, সে শিক্ষা কেমন শিক্ষা হেড-মাস্টার-?  তুমি শিক্ষিত হও হেড-মাস্টার, তুমি শিক্ষিত হও। তোমায় যে অনেক-কে শিক্ষা দান করতে হবে। তোমার উপর যে অনেক ভার। তোমার হাতেই দাঁড়িয়ে আছে কালকের ভবিষ্যৎ।  শিক্ষিত হও হেড-মাস্টার, তুমি শিক্ষিত হও।"
 [ গল্পটি কাল্পনিক ]

No comments:

Post a Comment