Friday 10 March 2017

বার্ণিকের বিশেষ গদ্য ..............




যে রাতে তারা ফুটলেও জ্যোৎস্না ছিল না
-সেলিম মণ্ডল


বিষন্নতার একটা লম্বা ঘুমের পর বেজে ওঠে ফোন। আমার চিরপরিচিত অচেনা ফোন। কেন জানিনা সেই সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল এই ফোনটা আসবে। বলবে, ‘কোথায় আছিস? নন্দন আসতে পারবি?’
ফোনটা এলে আমার সমস্ত অভিমান, ব্যস্ততা নিমেষেই উবে যায়। আজও তাই কোনরকমে জামাপ্যান্ট পরে ডাউন নৈহাটি লোকাল করে তড়িঘড়ি গেলাম দমদম। তারপর মেট্রোতে রবীন্দ্রসদন। মুনাই অপেক্ষা করছে একাডেমী অফ ফাইন আর্টসের সামনে। প্রত্যেক বছরেই ‘ভাষা দিবস’ উপলক্ষ্যে এখানে অনুষ্ঠান হয়। হঠাৎ করেই আজ এসেছে।
পৌঁছে দেখি, মুনাই একা একটা চেয়ারে বসে আর তার পাশের চেয়ারটা খালি। হয়ত, আমার জন্যই ধরে রেখেছে। সেই হাসিমুখটা আজ কিছুটা ম্লান। তবে কেমন যেন চাপা আনন্দ ওর মধ্যে ইতঃস্তত করছে। কাছে এগোতেই কোমল স্বরে বললো, ‘বস্। এতো দেরী হল?’ কীভাবে বোঝাব, যে এই দেরিটা ন্যূনতম। খড়দা থেকে নন্দনে এর থেকে কম সময়ে আসা যায় না। অপেক্ষার সময় ঘড়ির কাঁটা যেভাবে ঘোরে মনে হয়, এই সময়টাতে একবার পৃথিবী পরিক্রমণও সম্ভব।
মুনাই নিজে থেকে ডেকেছে। দীর্ঘ এক বছর পর। হৃদপিন্ড ছাড়া একটা মানুষ কিভাবে একটা বছর বাঁচে, আমি তার বিশেষ উদাহরণ। এই মুহূর্তে আকাশ থেকে মহাকাশে আমার অস্তিত্বের পলাশ ফুটছে যেন। হঠাৎ ও বলল:
 -রুমে যেতে হবে। দিদা ডেকেছে।
-এখনই?
-হ্যাঁ।
-তবে তুই বললে দিদার সাথে কথা বলে ফিরে আসব। সারারাত অনুষ্ঠান চলবে। ‘ভাষাদিবস’ পালন। দেখবি?
-হ্যাঁ
জাস্ট, হ্যাঁ। এটা ছাড়া আমার উত্তর আর কিই বা হতে পারে? ওর সাথে ‘কবি সুভাষ’-এ নেমে রাতের ডিনার সারছি, ফোন এল তনয়ের।
-কখন ফিরবি?
-আজ ফিরতে নাও পারি।
-মানে??
-‘ভাষাদিবস’ উপলক্ষ্যে নন্দনে অনুষ্ঠান আছে, রাতে থাকব।
-আমি ঘরের চাবি ফেলে এসেছি। চলে আয়।
শালা, হারামি বলে কী ‘চলে আয়!’ এই মুহূর্তগুলোর জন্য একটা বছর রাত্রিগুলো কেটে ফালাফালা করে ফেলছি। কেমন যেন স্বার্থপরের মতো কথা। ওরই বা কী দোষ সঙ্গে যে মুনাই থাকবে সেটা তো জানে না।
ডিনার সেরে ভাবানীপুরে ওর রুমের সামনে দাঁড়ালাম। ও জাস্ট ভিতরে গিয়ে দিদার সাথে কথা বলবে আর বেরিয়ে আসবে।
পরদিন সকালে বাড়ি ফিরব। পড়ানো আছে। বইমেলাতে এত গ্যাপ দিয়েছি, নেহাত ভদ্রলোক বলে কিছু বলে না। তাছাড়া নিজেরও কিছু কাজ আছে। তনয়ও ফিরবে সাথে। মুনাই রুমে যাওয়ার ফাঁকে সেরে নিলাম কয়েকটা ফোন।
ইদানীং বাড়িতে একটু বেশিই চিন্তা করে। রবিবার সকালেই বাড়ি ফিরি। কেন দেরি হচ্ছে না জানালে হাজার চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে থাকবে। ‘মা, আগামীকাল দুপুরে বাড়ি ফিরছি না। সকালে একটু স্যারের কাছে যেতে হবে’। যেখানেই থাকিনা কেন, এই একটা ফোনই বয়স্ক বাবা-মা’কে যে কতটা স্বস্তি দেয় তা বলে বোঝানো যাবে না। দ্বিতীয় ফোন দিলাম ছাত্রীর মা’কে, ‘দিদি কালকে পূর্বাকে পড়াতে যাচ্ছি না, অন্যকোনো দিন পড়িয়ে দেব’। যাক, ‘ঠিক আছে’ বলে উনি রেখে দিলেন। কিন্তু এভাবে কামাই কোন অভিভাবকই বা ভালো চোখে দেখে? আমি মুনাইয়ের জন্য সমস্ত ভালো চোখে ধুলো দিতেও রাজি। এরপর করলাম শেষ ফোন, তনয়কে। ‘ভাই, তুই ডিরেক্ট রাজাবাজার থেকে এক্সাইড আয় না, আমার যাওয়াটা সমস্যা। একটু কষ্ট কর প্লীজ’। যাইহোক, আর কোনো কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেল। 
ফিরে এলাম নন্দনে। অনুষ্ঠান চলছে। একের পর এক লালনগীতি, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত...পাশাপাশি বসে অথচ অনেকটা দূর দু’জনে। বইমেলাতে ‘মিউচুয়াল ব্রেকআপ’ করে নিয়েছি দু’জনে। আজ শুধুই বন্ধুত্বের অধিকার। ওর হাত আর আমার না। ও হাত আমি আর স্পর্শ করতে পারি না। আদুরে গলায় বলতে পারি না, ‘আঙুলগুলো একটু ফাটিয়ে দে না’। কোলাহল ভেঙে রাত গাঢ় হচ্ছে তার নিজস্ব নিয়মে। পৌনে দশটার দিকে ফোন এল তনয়ের। মুনাইকে বসিয়েই চাবিটা দিতে গেলাম। একা আছে। কাউকেই চেনে না। আমার যাওয়ার জন্য যে পাঁচ মিনিট লাগবে, এতক্ষনে মুনাই নিশ্চয় মঞ্চের সমস্ত আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে গভীর অন্ধকারে ডুবে যাবে। একাকীত্বের অন্ধকারে। তাই মাইক্রো সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে ফিরে এলাম।
গান চলছে। লোকসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি... সঙ্গে কবিতা পাঠও। রাত্রি যত বাড়ছে খিদে পাচ্ছে। কিন্তু দু’জনের কারো কাছেই খাবার নেই কিছু। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে খুটখাট চলছে দু’জনেরই। কেউ কাউকে বলতে পারছি না, ‘এগুলো আজকে না করলেই কি নয়?’। অধিকার বলে কি আর কিচ্ছু নেই একে অপরের প্রতি? এতটা সময় সেই কবে একসঙ্গে কেটেছে মনেই পড়ে না আজ। একবার হঠাৎ কেমন যেন অধিকার চেয়েই বসল মুনাই।
-তোর ফোনটা দেখি।
-কি করবি?
-হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের মেসেজ চেক?
-কেন করতে পারি না?
-তাহলে ইন্টারচেঞ্জ হোক।
-কেন? আমি চেয়েছি বলে তোকেও চায়তে হবে?
মুখটা ঈষৎ ভার নিয়ে ঘুরে বসল। এই মুখটা একটা সময় বড় বেশি দেখতে চাইতাম। কারণ, এই ভার মুখটা হালকা করার দায়িত্ব যে আমারই ছিল। ওর সমস্ত দায়িত্বই তো ছিল আমার... 
ঘড়িতে বারোটা ছুঁইছুঁই। সকলে উঠে দাঁড়ালাম। একাডেমী অফ ফাইন আর্টসের সামনে থেকে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি পর্যন্ত চলবে মশাল মিছিল। সারিবদ্ধভাবে হাতে মশাল নিয়ে শুরু হল হাঁটা আর কোরাসে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’। মিছিল শেষে ফুল দেবার জন্য আয়োজক এনামূলদা একে একে নাম ধরে ডাকছে। সেলিম-মোনালিসা ডাকতেই মনে হল বুকে কে যেন শিশির ধুয়ে দিল। এই শীতলতাটুকু কতদিন যে মুনাই সামনে থাকা অবস্থায় পাইনি!
পুনরায় আসন গ্রহণ করেছি। শুরু হল বাউলগান। মুনাই বামদিকে বসে। আর আমি ডানদিকে। স্বভাবতই ঘাড়টা বামদিকে ঝুঁকে। টানা থাকার ফলে যখন ঘাড়টা ব্যথা শুরু হল, ওকে বলেই ফেললাম-
-একটু ডানদিকে বসবি?
-কেন?
-ঘাড়টা ব্যথা করছে এভাবে ঘুরে থেকে।
ততক্ষণে মঞ্চে নাটক শুরু হয়েছে। রানাঘাটের একটা নতুন দল নাটকটা করছিল। দলটার নাম ‘সৃজক’ (সম্ভবত)। নাটকের নাম মনে নেই। খুব ভাল প্রদর্শন করল ছেলেগুলো। নাটকটার মূল বিষয় ছিল দূর্বলশ্রেণীর উপর সবলদের শোষণ। কীভাবে একজন লম্পট, অত্যাচারী লোক ভোটের টিকিট পেয়ে মন্ত্রী হয়ে ওঠে। নাটকটা দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল অনেক পুরোনো কথা। আমার আর মুনাইয়ের স্বপ্নের কথা। আমরাও একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতাম। যেখানে ধনী-গরীব, সবল-দূর্বল কেউ থাকবে না। কাউকেই কোন মাপকাঠিতে ফেলে আলাদা করা করা যাবে না। সবই আলো। সবাই আলো। আলোর কোন জাত নেই। ভালো-খারাপ নেই।
 মুনাইয়ের প্রজেক্টের কাজ চলছে। বারবার মেইল আর হোয়াটসঅ্যাপ খুলতে হচ্ছে। মাঝেমাঝে ভীষণ বিরক্ত লাগছে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। মাঝে একটা বছর কত ঝড়-ঝঞ্জা গেছে ওর উপর দিয়ে। তার কিছুটার জন্য আমিও তো দায়ী। মাঝেমাঝে আড়াল করে মেসেজ করে আবার আমাকে খ্যাপাচ্ছে ‘দ্যাখ, রাতে আমি অন্য কারো সাথে চ্যাট করছি’। সামনের ছেলেটাকে নিয়েও কখনও কখনও, ‘দ্যাখ, কেমন বারবার তাকাচ্ছে। হ্যান্ডসাম না?’। রাগ হলেও রাগের মধ্যে কেমন যেন ভিতরকার আনন্দ বেজে উঠছে বাউলের সুরে সুরে, ‘তোমায় হৃদমাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না’। 
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খিদেটা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ইদানীং মুনাইয়ের না খেয়ে খেয়ে খিদে হয় না। কিন্তু আজ ও মুখ ফুটে বলছে, ‘খিদে পেয়েছে’। কাছে দু’লিটার জলের বোতল ছাড়া কিছু নেই। আমার কাছে কিছু ক্যান্ডি ছিল সেগুলো দিয়েই খিদে মারছিলাম। কিন্তু ও একটার অর্ধেক খেয়েই ফেলে দিল। পারল না গোটাটা খেতে। আমি অপারক। খিদে মেটানোর জন্য আর কোন উপায় নেই। ততক্ষণে বেজে গেছে দেড়টা। ময়দান কেন, সারা কলকাতা খুঁজেও খাবার পাওয়া যাবে না। 
নাটক শেষ হয়ে আবার শুরু হয়েছে বাউল গান। অনুষ্ঠান শেষ হওয়া অবধি চলবে। ভোর হতে এখনও অনেক দেরি। রাতের নন্দন এত জনশূন্য! এত ধোঁয়াহীন! শুধু মাঝেমাঝে দ্রুতবেগে চলছে একের পর এক মালবোঝাই লরি। দু’একটা লরিকে মাঝেমধ্যে থামিয়ে দিচ্ছে এই বাউলসুর। মোহরকুঞ্জের ধারের গাছগুলিতে জ্যোৎস্না পড়ছে আর তার ছায়া রাস্তায় এঁকে দিচ্ছে প্রকৃতির অনন্য ক্যানভাস। এমন রাতে কেউ কি পারে চারহাতের অধিকার ভুলে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে? এতটা কি সত্যিই পেরেছি ভাষাকে মর্যাদা দিতে যে সারারাত্রি খোলা আকাশের নীচে নিজের প্রেম ছড়িয়ে দেব একুশের জন্য? এখনও ‘হাই’, ‘হ্যালো’, ‘থ্যাঙ্কু’ থেকে বেরোতে পারিনি। আমরা দুটি প্রাণী ছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের কেউ মেম্বার, না হলে কেউ পার্টিসিপেন্ট। আর বেশিরভাগেরই বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। আমাদের দেশে প্রেমটা একটু দেরীতেই মানুষের মধ্যে জাগে। তবুও জাগে বলেই হয়ত আমরা টিকে আছি। সকলেই অবাক দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছে। অচেনা-অজানা দু’জন চুপচাপ বসে সারারাত্রিব্যাপী অনুষ্ঠান দেখছে! তাও পঁচিশের তরুণ-তরুণী! আধোপ্রেম, আধোঅধিকার পেরিয়ে কখন যে সাড়ে তিনটে বাজল বুঝতে পারিনি।
না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে প্রেসার হাই। ডিম খাওয়া ডাক্তারের বারণ। ওর সেই আধোখ্যাপামি, আধোআদুরে গলায়, ‘খিদে পেয়েছে খুব। সকাল হলে ডিম খাব। ডিমের পোচ, ডিম সিদ্ধ, ডিম টোস্ট। পাওয়া যাবে তো?’
‘এক মারব, পাগলি’ খুব বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু প্রেমিকাকে ছাড়া কি আর অন্য কাউকে পাগলি বলা যায়? একবার কাকে বেশ ভুল করে বলেছিলাম। মুনাই প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিল। তারপর থেকে পাগলি নামটা যে শুধু ওরই জন্য।
‘পাগলী তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন’- আর কি কখনও শোনাতে পারব এ কবিতা? এখন যে জীবন কবিতা থেকে তা অনেকটা দূর।
বহুদিনের ইচ্ছে ভোরের ময়দানে হাঁটব। বসন্তের কোকিলের আত্মীয়তায় দুলে উঠবে আমার পৃথিবী। কুয়াশাচ্ছন্ন ফাঁকা ময়দান জীবনকে দেখাবে অনেক কাছ থেকে। এই যা তুমি অস্পষ্ট দেখছো, তা এতটা অস্পষ্ট নয়। কাছে যাও, আরও কাছে। দেখবে সবই সাদা। সবই স্পষ্ট।  
চারটে বেজে গেছে। শুরু হয়ে গেছে পেপারওয়ালা, বিভিন্ন হকারদের যাতায়াত। বাইকে পুলিশের টহলদারি। দু’একটা লোক শুরু করেছে ময়দানের দিকে হাঁটাহাঁটি। বোঝা যাচ্ছে, এরা প্রাতঃভ্রমণের উদ্দেশ্যেই বেরিয়েছে। ওদিকে মঞ্চে সমাপ্তি ঘোষণা চলছে ভোর ঠেলে হৃদয়ে হৃদয়ে আলো ফেলে-
‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রানে
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারারাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পরবে সেথায় দেখবে আলো
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে উর্ধ্ব-পানে।।’
বসন্তের সকাল। পাখির ডাক আর কচিকচি সবুজ পাতার ছায়ায় হেঁটে যাওয়া কেবল দুটি প্রাণী, আজ রাজা-রানী। কারো কোনো শাসন নেই। কে বলবে ‘রাস্তা তোর একার?’ সকাল তখনও পুরোপুরি রাত্রির বিছানা ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে আসেনি। নন্দন থেকে ময়দানের সামনে গিয়ে ঘুরে আসলাম দু’জনে। রাস্তায় শরীর এলিয়ে পরে থাকা কিছু লোকজনকে দেখে ঠিক সুবিধের মনে হল না। নন্দনের দিকে আবার হাঁটা শুরু করলাম। তখনও আয়োজকদের যন্ত্রপাতি গোছগাছ চলছে। ফাইন আর্টসের ঠিক একটু আগে একটা প্রতীক্ষালয় আছে। ওখানেই বসলাম দু’জনে। আর একটু সকাল হোক। তারপর না হয় ময়দানের শিশিরে কিছুটা ভেজা যাবে। বসে আছি দু’জনে। অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে লোকজন। এমনকি গাড়ি করে যাওয়া পুলিশও কাঁচের জানালা নামিয়ে একবার দেখে নিচ্ছে। ফেরিওয়ালা, পেপারওয়ালা, প্রাতঃভ্রমণকারী সকলের একই ঔৎসুক্য দৃষ্টি। ‘এত সকালে দু’জন যুবক-যুবতী এভাবে পিঠে ব্যাগ নিয়ে কি করছে? নিশ্চয় বাড়ি থেকে দু’জনে পালিয়েছে।’ এই প্রশ্নগুলোই হয়ত তাদের মনে দোলা দিচ্ছে। আর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে চোখদুটি।
জনসমাগমহীন রাস্তা, বসন্তের কোলে পাখির ডাক শুনতে শুনতে সবুজ পাতার ভিতর দিয়ে আবির ছড়িয়ে দেওয়া সূর্যকে জন্ম নিতে দেখা মানে ইহকাল পেরিয়ে স্বর্গলোকে পৌঁছে যাওয়া। মনে মনে আওড়াতেই হয়, ‘আহা, কী দেখিলাম জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিব না’। এই রোম্যান্টিকতার মধ্যে নিজেদের রোমান্সকে পিষে ফেলা মানে মৃত্যুদিনের পাশ দিয়ে গোপনে হেঁটে যাওয়া। হাত নিজে থেকেই কোন বাঁধা না মেনে চলে যেতে চাইছে মুনাইয়ের কাঁধে, কখনও বা দশ আঙুল চাইছে সমস্ত বাদানুবাদ ভুলে আত্মীয়তা স্থাপন করতে। কিন্তু কোথাও যেন আটকে যাচ্ছে। কোথাও যেন কেউ কানে কানে ফিসফিস করে বলছে, ‘তুমি লিওনার্দো নও’। অধিকার হারিয়ে গেছে। রংতুলি চুরি করে পালিয়েছে ইতর ভবিষ্যৎ। কিভাবে আঁকবে মোনালিসার ছবি? কিভাবে আঁকবে মুনাইয়ের ছবি?
রবিবাবু গুহা থেকে বেরিয়ে শুরু করছে ক্রমশ আলো ঢালতে। আলো এখনও গাঢ় হয়নি। মৃদু, নরম আলোয় নন্দন থেকে ভিক্টোরিয়ার সামনে যাবার সরু ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ নিজেকে সামলাতে পারলাম না। হাত হাতে রেখে জড়িয়ে ধরলাম। একটা বছর মানে তো একটা যুগই। একযুগ পর মুনাইকে জড়িয়ে ধরলাম। পাখি ডাকছে, বৃষ্টির মত পুরানো পাতা খসে পড়ছে, চারিধার ছড়িয়ে লাল শিমূল, হলুদ কৃষ্ণচূড়া। সকলেই ‘স্বাগতম সেলিম, স্বাগতম বলে’ যেন হাততালি দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে বলে দিই, ‘হে বসন্ত, তুমি কি পারো এভাবে প্রাণ ঢেলে দিতে?’ স্রেফ দশ সেকেন্ড। তারপর মুনাই আপত্তি জানালো। জানাবে নাই বা কেন? হাত ধরা, চুমু খাওয়া এর জন্য তো সম্পর্কের লাইসেন্সও দরকার পড়ে। ইনভ্যালিড একটা লাইসেন্স নিয়ে বন্ধু। কাছে এসো, কিন্তু গা ঘেঁষো না। দূরে থাকো, কিন্তু ফেলে যেও না। যেটাকে বলে ‘মিউচ্যুয়াল ব্রেক আপ’।
হাত পকেটে গুঁজেই বাকিটা পথ এগোলাম। ভিক্টোরিয়ার সামনে বসে দেখে নিলাম ভোরের ময়দান। সকালের ময়দান। মন খারাপের ময়দান। সারারাত্রির আবেগ, খুনসুটি ক্রমশ মিশে যাচ্ছে ময়দানের কুয়াশায়। এই কুয়াশায় ভিতর শিশির থাকে, না বৃষ্টি থাকে? সকালের কুয়াশায় ঘাম মিশলে তার গন্ধ কিভাবে আতরের গন্ধ হয়ে ওঠে তা প্রত্যক্ষ করলাম। নিজের ভিতরকার মৃত্যু দিয়ে। মৃত্যুটা কতটা গোপন? কতটা যুক্তিযুক্ত? সব প্রশ্নের বাইরে একটা প্রশ্ন জাগছে ‘মিউচুয়াল ব্রেক আপ’ কি? আবেগকে টুপি পরে প্রাণহীন কোন বস্তুর মতো বেঁচে থাকা?
খেতে হবে। সারারাত খাওয়া-দাওয়া নেই। সাকালের ময়দানের কাছে অনেক আশা-প্রত্যাশা ছিল। একটাও দোকান খোলা নেই। ভোর পাঁচটাতে কেই বা খুলবে? কে জানে আজ মুনাই আসবে ভোরের ময়দানে? ওর  জন্য ডিমের পোচ, ডিম সিদ্ধ, ডিম টোস্ট লাগবে। সারা ময়দান ঘুরে শেষ মাথায় একটা চায়ের দোকান খোলা পাওয়া গেল। বিস্কুট আর চা ছাড়া কিছুই নেই। তা দিয়ে সকালটাকে আর পেটবাবাকে স্বাগতম জানালাম। কিন্তু খেতে হবে এত সকালে কোথায় পাব খাবার? ভারি কিছুই খেতে হবে। ময়দান থেকে ওর রুম পর্যন্ত হেঁটেই যাব ঠিক করলাম। যেতে যেতে কোন দোকান নিশ্চয় পাবো। হাঁটতেই আছি দু’জনে আশা নিয়ে। কোনো দোকান নেই। আটা আর তেল মিশিয়ে কচুরি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে কেউ কেউ। ওর আবার ঘুগনি খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এত সকালে ঘুগনি? কলকাতায় এত সকালে মটর ভেজানো হয় কী তারই সন্দেহ আছে। মাঝরাস্তায় একটা দোকান দেখে মনে হল ভারি কিছু খাবার পাওয়া যাবে। না, সেই চা। আবার দু’জনে চা খেয়ে নিলাম। সঙ্গে নিলাম এক প্যাকেট কুরকুরে আর এক প্যাকেট লেইজ। ওগুলো চিবোতে চিবোতে ওর রুমের দিকে হাঁটছি।
-কিরে খাবার পাবো না?
-আমার রুমের কাছে একটা দোকান আছে, পাওয়া যায় ডিম, ঘুগনি। ভাল বানায়।
-কিন্তু সে পথ এখনও দশ মিনিট বাকি।
-চল না।
আশা নিয়ে এগোচ্ছি। সামনে একটা বাজার পেরোলাম। সেখানেও কোনো দোকান খোলা নেই খাবারের। কেন জানি না, কলকাতার বুকে সমস্ত আলিস্যি ঈশ্বর ঢেলে দেয় রবিবারগুলোতে। হাঁটছি আর হাঁটছি। এই পথটুকু শেষ হলেই তো আবার না পাওয়া, আবার সেই দূরত্বের শিকলে নিজেকে বেঁধে রাখা। সমস্ত ব্যথা-যন্ত্রণাকে নরম মাখনের মতো খসখসে রুটির উপর লাগিয়ে চিবিয়ে ফেলা।
ইচ্ছে করছে হাতটা ধরতে। একবার অনুমতি নিয়ে বলতে, ‘পাগলী। হাতটা একবার ধরবো?’ পুরানো স্মৃতিরা ভিড় করছে একটা ভিতরকার লড়াই নিয়ে। এই লড়াই কার? শুধুই কি এটা লড়াই নাকি প্রতিবাদও?
পৌঁছে গেলাম দোকানটার কাছে। আজ রবিবার খোলা থাকে না। খুললেও দেরিতে খোলে। কিছুই তো খাওয়া হল না। আমি না হয় রাস্তায় যেতে যেতে কিছু না কিছু খেয়ে নিতে পারব। কিন্তু মুনাই? ও এই যে রুমে ঢুকে যাবে আর বেরোবে না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে না হলে এমনিতেই খেতে বেরোয় না। খিদে মারার অভ্যাসটা বহু পুরোনো। এখন উপায় কি? ওর মুখে একটু খাবার দিতে পারলাম না। সারারাত্রি না খেয়ে জেগে জেগে বড়ই ক্লান্ত। ওর পায়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। কিভাবে আবার বলি, ‘চল, অন্য কোথাও খুঁজি। নিশ্চয় পাবো খাবার’।
শেষ পর্যন্ত ওর রুমের দিকেই হাঁটা শুরু করলাম। ওকে এগিয়ে দিতে। সামনেই একটা গলি। গলিটা পেরোলেই ওদের রুম। গলির মুখটাতে দাঁড়িয়ে দেখছি মুনাই চলে যাচ্ছে। অধিকারের শাসন না থাক, ভালবাসার দাবি না থাক- রাতটা তো ছিল আমার আর মুনাইয়ের। মুনাই এগিয়েই চলছে। একটু পর থেকেই শুরু হবে সেই গতানুগতিক জীবন। সেই একার জীবন। প্রিয়জনকে কাছে না পাওয়ার জীবন। ও এগোতেই আছে। জানি, ঠিক মাথাটায় গিয়ে একবার তাকাবে। এবারও তাই হল। তারপর মিলিয়ে গেল। বুক থেকে কেউ যেন একটা ফুসফুস ছিঁড়ে নিল। রাস্তায় মধ্যে মিনিট পাঁচ স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে। নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবানীপুরে আজ একটা মৃত্যু মিছিল হবেই। উপসংহারহীন মৃত্যুমিছিল। আমাকেই কি তাঁর নেতৃত্ব দিতে হবে?          
সবকিছুর পরও একটা ফেরা থাকে। সেটা ফেরা না চলা জানি না। তবে চলতে হবে। একাই চলতে হবে। চলতে চলতে আবার কোনো বাঁকে হয়ত মুনাই এসে দাঁড়াবে। বলবে ‘আসবি ফিরে? নন্দনে না আমার জীবনে?’

No comments:

Post a Comment