Friday 10 March 2017

বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
অতীতের ভার
রূপক সান্যাল




 রিক্সাটা গুঞ্জবাড়ি চৌপথি থেকে ডানদিকে বাঁক নিতেই পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো নিখিলেশ। ক’দিন আগেই দীপঙ্কর ওর নতুন বাড়িতে চলে এসেছে। তাই বাড়িটা চেনেনা নিখিলেশ। দীপঙ্কর ব’লে দিয়েছিল, একটু এগিয়ে বাঁদিকে একটা গলির মাথায় প্রথম বাড়ি। কিন্তু আশেপাশে কোন গলি চোখে পড়ছে না নিখিলেশের।
 অনেক্ষণ রিং হবার পর ফোন ধরলো দীপঙ্কর। নিখিলেশ বললো,‘কী রে,তোর বাড়িটা কোথায়? এখানে কোন গলিই তো চোখে পড়েনা!’
 ‘শোন, তুই একটা কাজ কর। ডানদিকে লক্ষ্য রেখে এগো। দেখবি পাল ফার্মাসি ব’লে একটা বড় ওষুধের দোকান আছে। ওই দোকানের সামনে তুই দাঁড়া।নিশা তোকে রিসিভ করবে।’
 ‘নিশা কেন, তুই কোথায়?’
 ‘আমি একটু বাইরে আছি। ফিরতে হয়তো রাত হবে।’
 ‘বাইরে মানে? কোচবিহারের বাইরে?’
 হ্যাঁ, আমি এখন আলিপুরদুয়ারের কাছাকাছি আছি।’
 ‘বাঃ, সেটা আগে বলবি তো! আমি তবে আজ আসতাম না।’
 ‘ডিসিশানটা হয়েছে বেলা দু’টোর পর। তুই ততক্ষণে কোচবিহারে প্রায় পৌঁছে গেছিস। কী করবো ভাই, আমার তো আর তোর মতো সুখের চাকরি নয়!’
 ‘এতটা সময় আমি কী করবো একা একা?’
 ‘একা মানে! নিশা রয়েছে তো। কলেজের পুরোনো বান্ধবীর সাথে গল্প ক’রে কাটিয়ে দে। তুই তো একটা সময় ওকে খুব চাইতিস। দেখনা, পুরোনো প্রেমটা যদি আবার জেগে ওঠে! আমার তো প্রায় পাঁচ বছর হলো, এখন আর কিছু মনে করবো না।’
 ‘তোর মুখে কিছু আটকায় না রে! তাছাড়া আমি তো ...’
 ওষুধের দোকানটা এসে গিয়েছে। নিখিলেশ বললো,‘এখন রাখছি, পরে কথা হবে।’
 রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে নিখিলেশ দোকানটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো।

 ‘তুই তাহলে এতদিনে বিয়ে করছিস?’
 ‘হুঁ, কেন, ঠিক করছি না?’
 ‘বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক ক’রে, কার্ড-টার্ড ছাপিয়ে এখন বলছিস, ঠিক করছিস কিনা? আশ্চর্য! নিশ্চই ঠিক করছিস। ... কেনরে, এখনো সন্দেহ আছে নাকি?’
 ‘না না, তা না।’
 ঘন সবুজ রঙের একটা স্লিভলেস চুড়িদার পরে আছে নিশা। চুলগুলো এলোমেলো। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। থেকে থেকে মেঘের ডাক আর বিদ্যুতের আলো। দূর থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাকের আওয়াজ। ঘরের ভেতরে কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে। সব মিলিয়ে একটা মায়াবী পরিবেশ।
 টি-পট থেকে কাপে চা ঢালে নিশা। নিখিলেশ তাকিয়ে দেখে তার আঙুলের নড়াচড়া। নিশার ওপরের ঠোঁটের বাঁদিকে ছোট একটা কালো তিল। আর দু’টো বড় বড় চোখ।এই দুইয়ের সমন্বয়ে সে পেয়েছে এক সম্মোহনী রূপ। গায়ের রঙ একটু কালো বলেই হয়তো ওর নাম রেখেছিল নিশা। কিন্তু এই মেয়েকে দেখে প্রেমে পড়েনি এমন ছেলে বোধহয় কলেজে একজনও ছিল না। এমন কী প্রফেসরদেরও কেউ কেউ....
 নিখিলেশের আরষ্ঠ লাগে। যতই কলেজের বান্ধবী হোক, এখন তো সে অন্য একজনের বউ। তাও আবার এতদিন বাদে দেখা। এরকম একলা একটা ঘরে নিশার সামনে ব’সে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে যেন কলেজের দিনগুলোতে ফিরে যায়। নিশা যখন তার চোখের দিকে তাকায় তখন নিখিলেশের সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসে।নিখিলেশ অবাক হয়ে ভাবে, নিশার প্রতি তার দুর্বলতা কী তাহলে এখনো পুরোপুরি কাটেনি!মনে মনে সে যেন কামনা করে – এই সময় আরো দীর্ঘায়িত হোক।
 বুকের ওপর ওড়নাটা একটু টেনে নিয়ে নিশা বললো,‘তুই নাকি আমায় খুব ভালোবাসতিস? কোনদিন বলিসনিতো!’
 নিখিলেশ মেঝের দিকে তাকিয়ে বললো,‘বললে কী হতো?’
 ‘কিছু হতো না, ... তবুও’
 নিশা যেন একটু উদাস হয়ে যায়। বলে,‘সত্যি, তখন যেন একটা অন্য জগতে থাকতাম। যেন সবসময় একটা ঘরের মধ্যে চলাফেরা করতাম।’
 তারপর যেন বাস্তবে ফিরে এসে বলে,‘থাক, সেসব পুরোনো কথা। এখন তোর বউ-এর কথা বল।’
 নিখিলেশ হেসে বললো,‘এখনো বিয়েই করিনি, বউ এলো কোথ্থেকে!’
 ‘সে কী রে! এখনো সন্দেহ আছে নাকি?’
 নিখিলেশের আরোষ্ঠতা যায় না। তার কথাগুলো তার নিজের কানেই বোকা বোকা লাগেছে। কথা বলার সময় নিশার বড় বড় চোখ দুটো যেন নাচতে থাকে। নিখিলেশের যেন ভেতর পর্যন্ত দেখতে পায় সে। নিখিলেশ জামার বোতাম নিয়ে খেলা করে, আঙুল কচলাতে থাকে। মাঝে মাঝে নাকের ঘাম মোছে আর নিজেকে একটু সহজ করার চেষ্টা করে।
 নিশা জিজ্ঞেস করে,‘কী নাম রে তোর বউ’এর, মানে হবু বউ’এর?’
 ‘লাবনী।’
 ‘বাড়ি থেকে ঠিক করেছে?’
 ‘নাঃ, নিজেই।’
 নিশা প্রায় লাফ দিয়ে ব’লে উঠলো,‘তাই নাকি! তুই তাহলে অনেক বড় হয়ে গেছিস, বল। আমি ভাবতাম তোর দ্বারা কখনো প্রেম হবে না।’
 তারপর আবার একটু উদাস ভাবে বললো,‘তোমার হলো শুরু,আমার হলো সারা। তাই না রে?’
 নিখিলেশ যেন দীর্ঘশ্বাস গোপন ক’রে বললো,‘তা নয় রে, নিশা। একে প্রেম বলেনা। এ হলো একরকম গুছিয়ে নেওয়া।লাবনী’কে আমি বিয়ে করছি, ওকে ভালবেসে নয়। করছি একটা সংসার দাঁড় করাবার জন্য। সেটা মানিসিক দিক দিয়ে কতটা শান্তির হবে জানিনা, তবে আর্থিক দিক থেকে সবল হবে।’
 তারপর উঠে জানলার কাছে গিয়ে বললো,‘সেইসব দিনের মতো উদ্দামতা আর নেই। শুধু ভবিষ্যৎ আর নিজেদের সুখ-সুবিধের জন্য...’
 বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। ঘরের ভেতর একটা একটা ক’রে মুহূর্তগুলো কেটে যাচ্ছে। ভালো লাগছে নিখিলেশের। নিশা তার কোন এককালের স্বপ্নের নারী। যদিও আজ ও অন্যের বউ। নিখিলেশের হবু বউ লাবনী– সেও তো অসুন্দর নয়। হয়তো নিশার চেয়েও বেশি সুন্দরী সে। হয়তো নিশার চেয়েও গুণী। তবুও ভালো লাগছে নিখিলেশের। কে জানে কেন। সে মনে মনে চাইছে, দীপঙ্কর আরো দেরি ক’রে ফিরুক।


 বারান্দা দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। এই সিঁড়ির নিচ দিয়ে চলে গেছে আরো কয়েকটা সিঁড়ি। সেটা বেয়ে নামলে একটা ছোট ঘর। ঘরটার অর্ধেকটাই মাটির নিচে। ছোট একটা দরজা, সেটা বন্ধ। ভেতর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে। নিশা দরজায় টোকা দিয়ে বললো,‘নীলিমা, দরজাটা খোল।’
 দরজাটা খুলে গেল। গোঙানির শব্দটা আরো স্পষ্ট আর তীব্র হলো। ঘরের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার। নীলিমা মেয়েটি একটা আলো জ্বাললো। ঘরে ঢুকে নিখিলেশ যে দৃশ্যটা দেখলো, তাতে তার চোখদুটো আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এলো।
 ঘরের ডানদিকে একটা ছোট বিছানা। তাতে ব’সে আছে সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা। মাথার চুল দিয়ে মুখটা ঢাকা। সেই চুলের ফাঁক দিয়ে দুটো বিস্ফারিত চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হাতদু’টো খাটের পায়ের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা। কথা বলতে গেলে জিভটা প্রায় পুরোটাই বেরিয়ে আসে। কথার একটাবর্ণও বোঝা যায় না। নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসছে সেই গোঙানির শব্দ।
 নিশা নীলিমাকে বললো,‘চুলটা বেঁধে দিসনি কেন এখনো?’ তারপর নিখিলেশের দিকে চেয়ে বললো,‘আয় নিখিলেশ, এই যে আমার মা।’
 ঘোর কাটিয়ে নিখিলেশ বললো,‘তোর মা! এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে ওঁর?’
 নিশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,‘জানিনা রে, কেউ বলতে পারেনা।’
 ‘কতদিন হলো?’
 ‘প্রায় সাড়ে তিন বছর। আমার তো আর কোন ভাই-বোন নেই, মা’কে আর রাখবো কোথায়?’
 ‘উনি কী ভায়োলেণ্ট হয়ে যান? মানে, হাত বাঁধা কেন?’
 ‘না, তা হয় না। তবে ছাড়া পেলে বাইরে চলে যেতে চায়। একবার তো প্রায় তিন দিন কোন খোঁজ খবর পাই নি। নইলে নিজের মা’কে শেকলে বেঁধে রাখার যন্ত্রনা কী কম!’
 ছোট একটা টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো। নীলিমা সেটা তুলে নিয়ে বাইরে চলে গেল। মুখটা হাতের তালু দিয়ে আড়াল করে ফিসফিস ক’রে কথা বলতে লাগলো। মনে হলো খুব গোপন কথা।
 নিখিলেশ ধীরে ধীরে নিশার মায়ের কাছে এগিয়ে গেল। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললো,‘আমি নিখিলেশ, নিশার বন্ধু। আমরা কলেজে একসাথে পড়তাম।’
 চোখদুটো বড় বড় হয়ে উঠলো ওঁর। বোধহয় একটু হাসবার চেষ্টা করলেন। কিছু একটা বলতেও চাইলেন বোধহয়। কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। বরং মুখের মধ্যে অবশিষ্ট খানকয়েক দাঁত আর জিভ এমন ভাবে প্রকটিত হলো যে, সমগ্র মুখমণ্ডল এক অশরীরী প্রেতের মত দেখতে লাগলো। হাতদু’টো তুলে আশীর্বাদ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেকলে টান পড়ায় হতাশভাবে আবার বিছানায় নামিয়ে রাখলেন।

 রাত প্রায় সাড়েআটটা। দীপঙ্করের কোন খবর নেই। নিশা কয়েকবার ওকে ফোন করার চেষ্টা করেও ধরতে পারলো না। কেবলই উত্তর আসছে –‘আউট অব রিচ।’
 ওরা আবার আগের ঘরটাতে এসে বসলো। ঘরের পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। দু’জনেই চুপচাপ। নিখিলেশ একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে লাগলো অলসভাবে। কিন্তু বারবারই সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে নিশার মা’কে।
 নিখিলেশ প্রথম কথা বললো,‘ওঁর চিকিত্‍সা করাচ্ছিস কোথায়?’
 নিশা একটা ফুলদানীতে রাখা ফুলগুলো গুছিয়ে রাখছিল। বললো,‘ভারতবর্ষের কোন জায়গা বাকি নেই। শুধু বিদেশেই যাওয়াহয়নি।’
 ‘বিদেশে যাওয়া যায় না? তোদের তো সামর্থ আছে।’
 ‘সমর্থের প্রশ্ন নয় রে। আসলে এই অসুখের কোন চিকিত্‍সা নেই। অনেক হয়েছে, আর টানাটানি করতে চাইনা। তাছাড়া বিদেশে নিয়ে যাবে কে?’
 ‘কেন,তোরাই নিয়ে যাবি! তুই আর দীপঙ্কর। হয়তো দু’একজন লোক সঙ্গে লাগবে।’
 নিশা যেন অবাক হলো। তার অবাক হওয়ার তলায় দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা চাপ পড়লেও নিখিলেশের দৃষ্টি এড়ালো না।
 নিশা বললো,‘দিপু! ও তো এখন আর মায়ের কাছেই যায় না। ও নাকি ভয় পায়। আমার মা’কে ওর বিভৎস্য কিছু একটা মনে হয়। আমি যদি আজ বলি, তাহলে ও আজই কোন হোমে-টোমে রেখে আসবে। শুধু পারেনা আমার জন্য।’
 নিখিলেশ চুপ করে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না। নিশা হঠাৎ উঠে এসে নিখিলেশের সামনে হাঁটু গেড়ে ব’সে পড়লো। মুখটা তুলে ব্যাকুলভাবে বলতে লাগলো,‘তুই আমার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখতো নিখিলেশ, আমার মুখেও কী মায়ের ওই রোগের ছায়া দেখতে পাস?’
 ‘তার মানে?’
 ‘দিপু তো তাই বলে। আর একটু বয়েস হলে আমিও নাকি মায়ের মতোই হয়ে যাব।’
 ‘কিন্তু কেন? এরকম ভাবার কারণ কী?’
 ‘সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করিস।’
 নিশা উঠে গিয়ে আবার সোফায় ব’সে পড়ে। ওর চোখদু’টো ভিজে উঠেছে। নিখিলেশ প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করার জন্য বললো,‘ওই নীলিমা মেয়েটি কে?’
 নিশা একটু ধরা গলায় বললো,‘ও আমার বোন হয়। দূর সম্পর্কের মামাতো বোন।’
 ‘তোর মায়ের দেখাসোনা করে?’
 ‘হ্যাঁ। ও আগে একটা বেসরকারী নার্সিংহোমে কাজ করতো। ওষুধ-পত্রের ব্যপারে ধারনা আছে। ইনজেকশানটাও দিতে পারে। ওরও তো বাবা-মা কেউ নেই। তাই আমার কাছেই এনে রেখেছি। তাছাড়া দু’জন আয়াও আসে দু’বেলা। পরিষ্কার-টোরিষ্কার তারাই করে। শুধু খাবারটা আমাকে খাইয়ে দিতে হয়। মা আমার হাতে ছাড়া কিছুতেই খাবে না।’
 নিখিলেশ একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে খুব। নিখিলেশ একটু ইতস্ততঃ করে বললো,‘তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো/’
 ‘বল।’
 ‘তোদের প্রায় পাঁচ বছর হলো বিয়ে হয়েছে, অথচ এখনো কোন ...’
 নিশা বুঝতে পারে। সে বলে,‘দু’বার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।’ তারপর একটু থেমে আবার বলে,‘আর এখন তো দিপু আমাকে এ্যাভয়েড করেই চলে।’
 নিখিলেশ আর এগোয় না। ভাবে,এপ্রসঙ্গ এখানে থেমে যাওয়াই ভালো। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। ব্যাঙগুলো ডেকেই চলেছে। ভরা শ্রাবণ মাস। খুব কাছেই একটা বাজ পড়লো। সেই শব্দে দু’জনেই চমকে উঠলো। দু’জনেই তাকালো পরস্পরের দিকে।
 নিশার হঠাৎ কী হলো কে জানে। সে জানালার কাছে উঠে এসে নিখিলেশের হাত দু’টো চেপে ধরে বললো,‘তুই একসময় আমাকে খুব ভালোবাসতিস, নিখিলেশ। আজও কী বাসিস?’
 নিখিলেশ কিছুই বলতে পারলো না। তার বিমূঢ়তা কাটছে না। নিশাও ব্যাকুল হয়ে ওঠে। খুব জোরে শ্বাস পড়ছে তার। সে নিখিলেশকে আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে বললো,‘চলনা, আমরা কোথাও চলে যাই। এখানে আমার আর কিছু নেই। আর লাবনীর সাথে তোর তো ভালোবাসার সম্পর্ক নয়। তবে আর অসুবিধে কী?যাবি?’
 এই প্রথম নিশার স্পর্শ পেলো নিখিলেশ। সেই কবেকার পুরোনো রাতজাগা আকাঙ্খা তার। কিন্তু এভাবে তো চায়নি সে। পরক্ষণেই তার মনে হয়, নিশা কী তাকে পরীক্ষা করছে? সতর্ক হয় নিখিলেশ। কিন্তু বুঝতে পারে, সেই ষোল বছর আগের অনুভুতি একেবারে মরে যায়নি এখনো। কলেজে পড়ার সময় কখনো ছুঁয়ে দেখেনি ওকে। আজ বুঝলো, ওর হাত দু’টো কত নরম। তখনও কী এমনই ছিল? নিখিলেশ জানে না।
 দীপঙ্কর নিশাকে অনেক ছুঁয়েছে-ছেনেছে, সেই বিয়ের অনেক আগে থেকেই। হয়তো নিশার শরীরের ঘ্রাণ ওর ইন্দ্রীয়ের ভেতর আর কোন ঢেউ তোলে না এখন। কিন্তু নিখিলেশের শরীর কাঁপতে থাকে। চেষ্টা ক’রেও সে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারলো না।
 নিখিলেশ এখন নিশাকে বলতেই পারে,‘কেন যাব?তোর সাথে গিয়ে আমার কী লাভ? তুই এখন অন্যের বউ। এতদিন তো আসিসনি আমার কাছে! আমি মুখে প্রকাশ করিনি বটে, কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই কী বোঝা যায় নি? আজকে ধাক্কা খেয়ে মনে পড়ছে আমার কথা?’
 নিখিলেশের মনের ভেতরে উপর্যুপরি ঢেউ তুলে যায় নিশা আর লাবনীর মুখ। একটা আর একটার ওপর। মুখদু’টো যেন পরস্পর লড়াইতে নেমেছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংযত ক’রে বলে,‘আর তোর মা! ওঁর কী হবে?’
 এবার ঝপ্ ক’রে নিখিলেশের হাত দু’টো ছেড়ে দেয় নিশা। সোফাতে ব’সে পড়ে বলে,‘কী মোক্ষম অজুহাতটাই না দিলি তুই। একবার হ্যাঁ বলতে পারলি না? না হয় মিছিমিছিই বলতিস!’

 ঘড়িতে ঠিক সাড়ে ন’টা বাজে। একটু আগে নীলিমা এসে ডেকে নিয়ে গেছে নিশাকে। ওর মায়ের খাবার সময় হয়ে গেছে। নিখিলেশ টেবিলের ওপর থেকে ম্যাগাজিনটা টেনে নিল।
 নীলিমাকে এবার স্পষ্ট করে দেখলো নিখিলেশ। বয়স বেশি নয়। হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি প’রে আছে। চোখে-মুখে রূপচর্চার স্পষ্ট ছাপ। রুগীর দেখাশোনা করার পর রূপচর্চার এত সময় পায় মেয়েটা? হাতে সেই মোবাইলটা। দেখেই বোঝা যায়, বেশ দামী। এত দামী মোবাইল কে দিয়েছে ওকে? নিশা? হতে পারে। সব মিলে মেয়েটাকে মোটেই ঠিকঠাক মনে হলো না নিখিলেশের। কোথাও যেন একটা গণ্ডগোল রয়েছে। নিখিলেশ ঠিক বুঝতে পারে না।
 মা’কে খাইয়ে এসে নিশা বললো,‘তুইও খেয়ে নে, নিখিলেশ। সারাদিন জার্নি করেছিস, খেয়ে শুয়ে পড়। দিপু কখন আসবে ঠিক নেই।’
 নিখিলেশ যেন এমনটাই চাইছিল। সত্যিই তার ঘুম পেয়েছে খুব। শরীর যেন আর চলছে না। নিশার কথায় কোন আপত্তি না ক’রে সে খেয়ে নিল। তারপর বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
 ঘুম যখন ভাঙলো, নিখিলেশ ঘড়িতে দেখলোসওয়া তিনটে। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে সে বারান্দায় দাঁড়াল। দক্ষিণ খোলা বারান্দা। এখন বৃষ্টি নেই। তবে ঝড়ো বাতাসটা আছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এখনো। সেই আলোয় চারদিক দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মুহূর্তের জন্য।
 নিখিলেশকে উপরের ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়াতেই একঝলক ঠান্ডা বাতাস লাগলো তার চোখেমুখে। শরীরটা যেন চনমনে হয়ে উঠলো। এখন আর ঘুম পাচ্ছে না।
 নিখিলেশ দেখতে পায় বাড়ির ভেতরে একটা ছোট্ট বাগান। নিচের ঘর থেকে সেই বাগানটা দেখা যায় না। বিদ্যুতের আলোয় সে দেখতে পায়, বাগানে একটা গাছের নিচে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। আবার সব অন্ধকার। এমনি ক’রে কয়েকবার লক্ষ্য করার পর ও বুঝতে পারে, ওরা একজোড়া নারী-পুরুষ। মনে হচ্ছে যেন পরস্পরকে আলিঙ্গনে ব্যস্ত ওরা। মেয়েটির আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে। হালকা নীল রঙের শাড়ির আঁচল। নিখিলেশের মাথার ভেতরে ধক্ করে জ্বলে উঠলো নীলিমার ছবি। হ্যাঁ, ও তো নীলিমাই। আর সঙ্গের পুরুষটি? দীপঙ্করকে চিনতে অসুবিধে হয়না নিখিলেশের। কিন্তু ও ফিরলো কখন?
 নিখিলেশ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। চোখের সামনে দেখেও তার যেন বিশ্বাস হয় না। এই কী সেই দীপঙ্কর! যে কিনা নিশাকে বাদ দিয়ে একটা দিনও কাটানোর কথা কল্পনা করতে পারতো না। সারা কলেজ যাদের প্রেমকে ঈর্ষা করতো। নিশা কী দীপঙ্করের এই নতুন সম্পর্কের কথা জানে? হয়তো জানে। তাই বোধহয় সব ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল নিখিলেশের সাথে।
 নিখিলেশের মনে  হলো এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়। কিন্তু এ বাড়িতে কী আর কোন ঘর নেই? এভাবে খোলা বাগানের মধ্যে...!
নিখিলেশের একবার মনে হলো, নিচে গিয়ে নিশাকে ডেকে আনে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—‘এই দেখনিশা, তোর প্রানের পুরুষ! যার জন্য তুই দিন-রাত বিভোর হয়ে ছিলি! আমাদের কারুর দিকে ফিরেও তাকাসনি কোনদিন।’
 কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে হলো— নাঃ, তা হয় না। এমনিতেই নিশা ভেতরে ভেতরে চুরমার হয়ে আছে। ওকে আর দুঃখ দিয়ে কাজ নেই। তাছাড়া সে তো এসব করতে আসেও নি।
 ভোর হ’তে সামান্যই বাকি। নিখিলেশ তৈরি হয়ে নিলো। সে এখানে এসেছিল তার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে। কিন্তু সেই কাজটাই করা হয়নি। দীপঙ্করের সাথে তার তো দেখাই হলো না। নিখিলেশ এসেছে জেনেও সে একবার এলো না তার কাছে! এতো বদলে গেছে ও?
 নিচে নেমে নিশার ঘরের সামনে একটু দাঁড়ালো নিখিলেশ। তারপর ব্যাগ থেকে তার বিয়ের কার্ডটা বের ক’রে বন্ধ দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। ওর হঠাৎ মনে প’ড়ে গেলো, নিশা আর দীপজ্ঙ্করের বিয়ের কার্ড পেয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে অঝোরে কেঁদেছিল সে। আজ কী নিশাও তেমনই ...?
 নিখিলেশ বাইরে বেরিয়ে এলো। এখনো ভালো করে আলো ফোটেনি। তবু পথ দেখা যায়। দু’চারজন লোক এই শেষ রাতেই হাঁটতে বেরিয়েছে। ওরা ঘুমায় কতটুকু?
 রিক্সা এখনো পথে নামেনি। নিখিলেশ জোরে পা চালায়। প্রথম বাসটা ধরার চেষ্টা করতে হবে। সে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চায় না। তার স্বপ্নের অতীত এখন পাথরের মত ভারী। একে আর বহন করতে পারছে না সে।

1 comment:

  1. khub valo laglo . nikhilesh er sesh kaj ta onek ta joggo jobab er moton holo . khub valo

    ReplyDelete