Friday 10 March 2017

বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
টিকটিকি
শুভঙ্কর দে



বর্ধমানে এম.এ. পড়বার জন্য একটা মেসে যখন থাকতে শুরু করি তখন বর্ধমানের সব কিছু অচেনা। আমি কাউকে তেমন একটা চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না। সারাদিনের পর সন্ধ্যা নামলে মেসে ফিরতাম। চেনা মুখ বলতে আমার রুমমেট। এভাবেই ছিল দিন যাপন । কিছুদিন পর আমাদের থাকার ছোট্ট আস্তানায় কারা এসে জুটলো, অনাহুতের মত দুটো টিকটিকি। সন্ধ্যে থেকেই তাদের হুটোপুটো শুরু হতো। প্রথম প্রথম ঠিকই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে দেখলাম ঘরের মধ্যে ধুলোর সঙ্গে পড়ে আছে কালো কালো টিকটিকির গু। মাথাটা গেল গরম হয়ে, রুমমেটকে বললাম " দ্যাখ শালা উদ্বাস্তু দুটোর কাজ, খাচ্ছে দাচ্ছে আর ঘরের মধ্যে সব সারছে"।শুরু হল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। যেমন করে হোক ব্যাটাদের ঘর থেকে বার করতেই হবে। একটাকে বার করি তো আর একটা যায় না, একজনের টানে  দু'দিন পর বেরিয়ে যাওয়া টিকটিকিটা এসে আবার হাজির হয়। বুঝলাম এ দু'জনে নিশ্চয় প্রেমিক প্রেমিকা। নয়তো এদের মধ্যে কোনোদিনও মারামারি করতে দেখলাম না, মাঝে মধ্যে অবশ্য রাগ-অভিমানের বোঝাপড়া দেখতে পাই-- একজন উত্তরকোণে তো অপরজন দক্ষিণ কোণে। তবে তাদের দৌলোতে ঘরের মধ্যে পোকার উপদ্রপ থেকে রেহায় পাওয়া গেছে। দিন যায় রাত যায়, মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভাঙে, যেমন করে ভেঙে পড়ে নদীর পার। এবারে শীতটা দু'দিন পড়ল বেশ জাকিয়ে। লক্ষ্য করতাম টিকটিকি দুটোর প্রাণ চঞ্চলতার নিস্তব্দতা। চুপটি করে দু'জনে দেয়ালের মধ্যে লেপটে থাকতো। খিদে পেলে দু'একটা পোকা মাকড় খেত, বাকি সময়টা দু'জনে পাশাপাশি নিশ্চুপ,নিশ্চল হয়ে সেঁটে থাকত দেয়ালে। শীত গেল, এল বসন্ত। প্রকৃতির বুকে সকলের মধ্যে একটা রোমাণ্টিক রোমাণ্টিক ভাব। প্রকৃতির কি লীলা!! শুধু মানুষ না, গাছ-গাছরা, পাখ-পাখালী সবাই মেতে ওঠে বসন্তের হাওয়ায়। আমাদের রুমের টিকটিকি দুটোও ব্যতিক্রম নয়। বেশ চলছিল তাদের জীবন। এমন সময় ঘটল একটা ঘটনা।
সন্ধ্যের সময় বসেছি পড়তে। তখন সময় ঘড়িতে আটটা কি সাড়ে আটটা। হাতে প্রবোধকুমার সান্যালের 'মহাপ্রস্থানের পথে' প্রবন্ধটি। এত ভালো গদ্য আর ভ্রমণের অমন চিত্র, পড়তে পড়তে আমিও লেখকের সঙ্গে হেঁটে চলেছি কেদারনাথের সুমুখে বরফাবৃত উৎরাই চড়াই বন্ধুর পথে। হঠাৎ ছন্দপতন। ঝুপ করে আওয়াজ। নানা এটা বই এর মধ্যে নয়। আমাদের মেসের রুমটায়। আমি সেদিন একা। শব্দটা শুনে চুপ করে বইটি বন্ধ করে বসে রইলাম। ঘোর যখন ভাঙলো বেড থেকে নেমে দেখলাম ওই টিকটিকি দুটোর একজন মুখ থুবরে পড়ে। বুঝলাম শিকারের ঝাপ। রাত সাড়ে দশটা। ডিনার শেষে ঘামছায় হাত মুছতে মুছতে ওদিকে গিয়ে দেখি এ কি কাণ্ডরে বাবা!এ টিকটিকি তখন থেকে এভাবেই পড়ে কেন? পায়ে করে নাড়িয়ে দেখলাম, না, এর তো নো শব্দ, নো চলনবলন। বুঝতে আর বাকি রইল না। মনে মনে বললাম এই রাতবিরিতে তোকে মরতে হল। হায় রে! এখন তোর সৎকার করি কী ভাবে? কোনো রকমে পায়ে করে ঠেলে ঠেলে দরজার কাছে নিয়ে গেলাম। এবার উপায়? বার করি কি করে? হাত দিয়ে তুলতেও গা করছে শিরশির। যতই হোক আমি তো মানুষ। ক্ষুদ্র প্রাণীকে ছুঁতে ঘিনঘিন তো করবেই। তবু নিরুপায়। হাত দিয়েই তুলতে হবে এ যে ভাগ্যের খেলা। নীচু হয়ে হাত দিয়ে তুলতে যাব এমন সময় মাথাটা গেল ঘুড়ে। চোখের সামনে একটা নিথর দেহ; মৃত্যু কত শান্ত অথচ ভয়ানক। আমার হাত কোনো মতেই টিকটিকিটাকে স্পর্শ করতে পারছে না। মৃত্যু বুঝি এরকই হয়? তখন সে এই জগতের সীমা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে কোনো এক অমর্ত্যলোকে। সে এখন মৃত্যুর অবয়ব ধরে আমার সামনে। এ যেন নবারুণের হারবাট। মাথার মধ্যে এরকম এবড়ো খেবড়ো নানান চিন্তা ভীড় করছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে শত শত শব্দ। যাদের ঠিক মতো ধরতে পারলে জন্ম দেওয়া যায় সাহিত্যের। হঠাৎ বাইরে মেসের মালিকের গলার আওয়াজে আমি জেগে উঠলাম। উনি দেখে বললেন "এক্ষুণি এটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসো, যত সব আবর্জনা।" সত্যি আবর্জনাই বটে। ফেলে দিয়ে এলাম পুকুরের জলে। পুকুর পারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। চারিদিকে চাঁদের আলোয় ছেয়ে গেছে, বসন্তের হাওয়া বয়ছে শিরশির করে, তিড়তিড় করে নড়ছে সমস্ত গাছের পাতা । শরীরে বসন্তের হাওয়া মেখে রুমে ঢুকলাম। চোখ গেল দেয়ালে। যাদের তাড়াবার জন্য একদিন যুদ্ধের আয়োজন করেছিলাম অথচ তারাই আমাদের সর্বকালীন সঙ্গী ছিল, আজ তাদের একজন নেই, অপরজন চুপটি করে দেয়ালে সেঁটে রয়েছে। ও কি জেনেছে ওর সঙ্গী চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল? ও কি শোকে বিহ্বল? হতেও পারে, ওরা তো মানুষ নয় যে শোকে চিৎকার করবে। ওর কষ্ট আজ শুধু ওর একার। জানলা খুলে শুয়ে পড়লাম। খুব সকালে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুমটা গেল ভেঙে। অব্যেশমত দেয়ালে তাকিয়ে দেখলাম  টিকটিকিটি নেই, ঘরের কোথাও নেই। এমনি করেই সবাই চলে যায় একদিন। বেড থেকে নেমে জানালার কাছে দাঁড়ালাম, চোখে পড়ল অদূরেই কাঠখোট্টা পলাশ গাছটা। দেখলাম গাছটা ছেয়ে গেছে পলাশ ফুলে।

1 comment:

  1. Baaaaa. Darunnnn. Likhe6is. Re. Vaai.... Best. Of luck💖


    ReplyDelete