Friday 10 March 2017

বসন্ত বিষয়ক গদ্য .................................................................................................................................................................................


বসন্ত

-নীপবীথি ভৌমিক




    বসন্ত ছেঁয়ে গেছে চারিদিকে।দিগন্তে দিগন্তে ফুলেদের আগুন খেলা! সৌভাগ্য বশতঃ শান্তিনিকেতনের আশ্রম ক্যাম্পাসেই আমার বাসস্থান।আকাশে বাতাসে জাগরিত এই বসন্ত বেলায় কি আর মন চায় ঘরে বন্দি থাকতে।বেড়িয়ে পড়া উদ্দেশ্য হীন ঠিকানায়।কানে ভেসে আসছে সঙ্গীত ভবনের ছাত্র ছাত্রীদের দ্বারা পরিবেশিত বসন্ত সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত নৃত্যনাট্য “তাসের দেশ”র রিহার্সাল। “আমরা চিত্র  অতি বিচিত্র / অতি বিশুদ্ধ,  অতি পবিত্র…”
     সত্যিই তো,কতটাই বা জানি আমরা এই বিপুলা পৃথিবীর? আজ  তাই এই বিচিত্র চিত্রের আহ্বানে রাঙা পথের রাঙাধুলোর নেশায় ঘরকে করেছিলাম কিছুটা সময়ের জন্য পর।
     মাঝে মাঝে এভাবেই হারাতে ইচ্ছা করে ভীষণ।জানতে ইচ্ছা করে প্রকৃতির উদার্ত আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা অসংখ্য রঙের বাহার,ফুলের মায়াবী আঘ্রাণ,কিংবা ধুলোর পথে মাটিরঙের রহস্য।কতই না জানার আছে আমাদের,কতোই রহস্যাবৃত্তে আবদ্ধ করে রেখেছে প্রকৃতি আমাদের!কত পথ ই আছে জীবনের এই দীর্ঘ পথ চলার পায়ে পায়ে,কত জানা হয়ে অজানার সত্য হাতের স্পর্শে মিশে থাকি আমরা,আবার কখনও বা অযুত অজানার সাগরেই নিজেকে করি সমর্পণ।তাইতো “জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান”।আর তাইতো “বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান”।
    চলেছিলাম এভাবেই বসন্তের বাহার ধুনে আন্দোলিত হয়ে। পথে পথে আম্রমুকুল বালিকার আসা যাওয়ার  হাওয়ার বাতাস আর আশ্রম থেকে সান্ধ্য বাতাসের পাখায় ভর করে ভেসে আসা সুর বলে যায় বারবার কানে কানে “আজি দক্ষিণপবনে দোলা লাগিল বনে বনে।“ হ্যাঁ,সত্যিই দোলা লেগেছিল হৃদয়ের কোণে।আর কেনই বা লাগবে না? পলাশের এমন অপরূপ মনলোভী সৌন্দর্য দেখে! কেউ কি পারে সত্যিই এমন করে চোখ ফিরিয়ে রাখতে? প্রাণচ্ছাসের বসন্ত রঙ মেখে আজ  তো সেই ঋতুরাজের প্রেম !
  “কুঞ্জবনের অঞ্জলি যে ছাপিয়ে পড়ে” তার রূপ মাধুরীর আগুন ধারায়,তাইতো “পলাশ ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে,/বেণুর শাখা তালে মাতাল পাতার নাচে।।“ গাছে গাছে ,পথের বাঁকে বাঁকে তাই পলাশ বন্দনা আজ ।পলাশ আর বসন্তের মুগ্ধ চাঁদ রাত তাই পরস্পরে মেতে ওঠে সেই সুরের ধারাপাতে…
  “পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়/রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।/তোমার প্রজাপতির পাখা/আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন মাখা।/তোমার চাঁদের আলোয় মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান।“
    সত্যিই হয়তো তাই,শুধু এইটুকুই মনে হয় পলাশের চাওয়া বসন্তের কাছে।আর তাই তো এত রূপ যৌবনের উৎচ্ছলা,এত আগুন মায়ার রঙের মাধুরী,সবই যেন তার শুধু একদিনের জন্য।দোলের আবীর সজ্জায় সজ্জিত অযুত প্রাণের আনন্দে মেতে ওঠা মানুষের জন্য। আর তারপর কে আর খবর রাখে আর ,তার মৃত্যু সংবাদ কাকেই বা শোকস্তব্ধ করে! কেউ কি রাখে আনন্দ উৎসব শেষে তার প্রিয় পলাশ আছে কি জীবন নিয়ে এই পুণ্যভূমির রাঙা ধুলোয়!
   রাখেনা,কেউ রাখে না,বরং কত পলাশ পিষ্ট হয়ে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যায় নীরবে। আর সান্ধ্য মঞ্চে আমরা গাই “ চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন…”হয়তো শুধু আবীর আর উৎসবেই তার স্থান,উৎসব শেষে তাই সে কদরহীন,শুধুই এক ফুল! আর মানুষ নিহত হলে তার বিচার হয়,ফুল নিহত হলে তার আবার বিচার কেন!
  “ ওই দেখো গোলাম অতিশয় মোলাম।
        নাহি কোনো অস্ত্র  খাকি-রাঙা বস্ত্র।
         নাহি লোভ,নাহি ক্ষোভ।
             নাহি লাফ,নাহি ঝাঁপ।
        যথারীতি জানি,সেই মতো মানি।
          কে তোমার শত্রু, কে তোমার মিত্র।
            কে তোমার টক্কা,কে তোমার ফক্কা।“
---হয়তো পলাশও তাই জানে! তবু, এটাও তো ঠিক পলাশ সাজে অঙ্গ সাজ ছাড়া বসন্ত কি আর মানে! তাই পলাশ ফুলে ঢাকুক অঙ্গ-শরীর,বেজে উঠুক গৃহবাসীদের দ্বার খোলার আহ্বান,শুধু এটাই যেন পারি আমরা সবাই আরো আরো বেশি করে পলাশ ফোটাতে, শিমূল,কৃষ্ণচূড়ায় লাগুক আগুন,জ্বলে উঠুক দিগ্‌ দিগন্ত ফুলের আগুনে।

No comments:

Post a Comment