বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
বিষাক্ত হাসি
রাণা পাণ্ডা
হাসি হলো মনের অবস্থা প্রকাশের একটা মাধ্যম।মানুষকে প্রাণখুলে হাসতে দেখলে সহজেই বোঝা যায় মানুষটি অত্যন্ত আনন্দিত।কথায় আছে মানুষের হাসিই কিন্তু বলে দেয় মানুষটির মন কেমন।তবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ন্যাকা হাসির প্রচলন হয়েছে।সেই সমস্ত হাসি দেখে মানুষের মন বোঝা তো দুর-অস্ত ঠিককরে এটাই বোঝা যায় না সে হাসার চেষ্টা করছে না হাসছে।কিছু-কিছু মানুষের হাসির আওয়াজ এতো বেশি যে পাশের বাড়ির লোকজনও শুনতে পায়।বিভিন্ন মানুষের হাসির ভঙ্গি বিভিন্নরকম।বর্তমান যুগে হাসির অভিনয় করতে করতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে কেউ যদি প্রাণখোলা হাসিও হাসে তবুও সন্দেহ থেকে যায় সে সত্যি সত্যি হাসছে তো নাকি হাসার চেষ্টা করছে।
হাসি আমাদের জীবনে একটি অপরিহার্য জিনিস।মুচকি হাসি নামক হাসিটির গুরুত্বও নেহাত কম নয়।এই হাসি দেখে মানুষকে আনন্দিত মনে হলেও সেই আনন্দ কিন্তু অন্য প্রকারের আনন্দ।মানুষের মনের ভিতরে পুলকি না জাগলে সাধারণত এই হাসি আসে না।মানুষের দুঃখ-কষ্ট চিরকালই থাকে, কিন্তু এই দুঃখের মধ্যেও হাসিই সাময়িক আনন্দ দান করে।একটু বাড়িয়ে বললে সাময়িক সুখ দান করে।আবার এই হাসিই মানুষের দুর্ভোগের কারন হয়।দুর্বলকে ব্যঙ্গ করার ক্ষেত্রে কিন্তু এই হাসিই দায়ি।প্রেমের ক্ষেত্রেও কিন্তু এই হাসির অবদান নেহাত কম নয়।কথায় আছে- হাসি তো ফ্যাসি।কিছু কিছু মেয়ের হাসি দেখেই তো ছেলেরা প্রেমে পড়ে যায়।
এছাড়া ভয়ের হাসিও তো নেহাত কম নেই।এই ধরুন বদমায়েশদের হাসি,সর্বোপরি ভূতের হাসি- সে তো ভয়ংকর মশাই!
হাসি নিয়ে দীর্ঘ একটি বক্তৃতা দেওয়ার পর অমলেশ বাবু চুপ করলেন।তারপর ডায়েরিটা বন্ধ করে ব্যাগে পুরতে পুরতে পাশের শীটে বসা অনিলবাবুকে বললেন- বুঝলেন মশাই,আমার দেখা প্রায় সমস্তরকমের হাসিই আমি নোটবুকে লিখে রেখেছি।কথাটা শেষ করেই হি হি করে হেসে উঠলেন অমলেশ বাবু।
অমলেশ বাবু পেশায় একজন বাংলার শিক্ষক।সদ্যই লেখা-লেখির সাথে যুক্ত হয়েছেন।তাই তিনি চাইছেন হাসির ওপর একটা লেখা লিখতে।সেই জন্য যখনই তিনি নতুন রকমের হাসি দেখেন তখনই তা লিখে নেন তার ডায়েরিতে। অমলেশ বাবু বেশ হাসিখুশি মানুষ,কেউ কোনদিন তাকে দুঃখ পেতে দেখেনি।অমলেশ বাবুর মনে হয় বর্তমানে এই কর্মব্যস্ত জীবনে মানুষের হাসিটা ফিকে হয়ে গেছে।তিনি লক্ষ্য করেছেন এখন মানুষের হাসিটা কেমন যেন বিষন্ন।
সেদিন গিন্নীর কি এক কথা শুনে অমলেশ বাবু হো হো করে হাসতে শুরু করে দিলেন।সেই হাসি যেন থামতেই চায় না।গিন্নী যতই হাসতে বারণ করেন ততোই যেন আরোও বেশী করে হাসি পায় তার।তিনি চাইলেও যেন সে হাসি থামাতে পারছেন না।শেষ অবধি হাসি যখন থামল পেটে ব্যাথা ধরে যাওয়ার অবস্থা।গিন্নী তো সটান বলে দিলেন- এই বয়সে এতো হাসি ভালো নয়,বলে দিলুম।
অমলেশ বাবুর মনে হলো এ হাসি তো একেবারে অদ্ভূতূড়ে হাসি, পেটে ব্যথা ধরিয়ে দিল।
সাথে সাথেই অমলেশ বাবু তার ডায়েরি খুলে এই নতুন ধরনের হাসির কথা লিখে নিলেন।লিখলেন- এ হাসি এক ধরনের অদ্ভূতূড়ে হাসি,অলৌকিক ও বলা চলে।কখন যে আসে আর কখনেই বা চলে যায় তা নিজেও জানতে পারবেন না।কিন্তু যখন আসবে তখন পেটে ব্যথা ধরিয়েই যাবে।
অমলেশ বাবু শহরে থাকেন কিন্তু তার স্কুল গ্রামে।তাই ওনাকে নিয়মিত শহর থেকে যাতায়াত করতে হয়।তিনি রোজ বাসে করেই যাতায়াত করেন।গত পনেরো বছর ধরে তিনি এমনটাই করে আসছেন।গ্রামের মানুষেরা তাকে বড্ড ভালোবাসে।তাই গ্রীষ্মের ছুটি কিম্বা পুজোর ছুটিতে যখন স্কুলে যেতে পান না,তখন তার প্রাণটা যেন হাঁপিয়ে ওঠে।
শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হওয়ার পর প্রায় বেশ কয়েকবছর তিনি গ্রামেই স্কুলের কোয়ার্টারে থাকতেন।নিজের গ্রাম না হলেও গ্রামটাকে তিনি বড্ড বেশী ভালোবেসে ফেলেছিলেন।তাই যখন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতে হয়েছিল,তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।
গ্রীষ্মের দুপুর।চারিদিকে কোথাও তেমন লোকজন নেই।অমলেশ বাবু দাঁড়িয়ে আছেন অটো ধরার অপেক্ষায়।পুরো শরীর থেকে ঘাম ঝরছে-এক রকম বিস্রী পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছেন অমলেশ বাবু।তার জামা ঘামে এক্কেবারে ভিজে গেছে।এমন সময় একটা অটো এসে দাঁড়ালো অমলেশ বাবুর সামনে। খালি অটো পেয়ে তিনি সাথে সাথেই উঠে পড়লেন।এতোক্ষণে অমলেশ বাবু স্বস্তীর নিশ্বাস ছাড়লেন।
কিছুদুর যাওয়ার পরেই অটোটাতে তিনজন মহিলা উঠলেন।দেখেশুনে বেশ ধনী ঘরের বলেই মনে হল অমলেশ বাবুর।কিছুক্ষণ গল্প করার পর ওই তিন মহিলা মুচকি মুচকি করে হাসতে লাগলেন।অমলেশ বাবু বুঝতে চেষ্টা করলেন ঠিক কি কারণে ওরা হাসছেন। বেশ কিছুক্ষন পর অমলেশ বাবু খেয়াল করলেন,ওই তিন মহিলা তাঁকে দেখেই হাসাহাসি করছেন। তাদের চাউনি দেখে এটা স্পষ্ট।অমলেশ বাবুর পুরো জামাটাই ঘামে ভিজে গেছে-সম্ভবত এটা নিয়েই ওই তিন মহিলা হাসাহাসি করছেন।
যে মানুষটা অন্য কাউকে হাসতে দেখে খুশি হয়,সেই মানুষটা আজ হাসতে দেখে বিরক্ত হচ্ছে।অমলেশ বাবু বেশীক্ষণ হাসিটাকে সহ্য করতে পারলেন না।তার মনটা যেন বিষিয়ে উঠল।সেই হাসি তার পিত্তি জালিয়ে দিচ্ছে। এ হাসি ভয়ংকর-মুহূর্তের মধ্যেই এই হাসি মানুষের মধ্যে ক্রোধ সঞ্চার করে।অমলেশ বাবু নিজের মনকে শক্ত করলেন,তারপর তার ডায়েরিটা খুলে লিখতে শুরু করলেন- এই হাসিকে ঠিক হাসি বলা চলে না।এ হাসি মানুষের মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার করে।এ হাসি বিষাক্ত।।বিষাক্ত হাসি।
শেষটায় ওই তিন মহিলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে হাসতে অমলেশ বাবু লিখলেন- হাসি স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক।কিন্তু বিষাক্ত হাসি-একেবারেই নয়।
No comments:
Post a Comment