বার্ণিক এর গল্প –
.......................................................................................................................................
মান্যবর
অনিন্দিতা মণ্ডল
আজ ও সেই ছোট্ট ছেলেটা ঘাটে এসেছে। কতইবা বয়স! চার পাঁচ বছরের শিশু হবে। একদল ছেলের সঙ্গে সেও এসেছে। রোজই আসে। ছেলের দল আসে মহাচার্যের স্নানের সময়। বিক্রমশিলা মহাবিহারের একেবারে শীর্ষ প্রকোষ্ঠ থেকে একটি সিঁড়ি গুপ্তপথে সোজা নেমে এসেছে জাণ্হবী তীরে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন তিনি। মহাপুরুষের শিশুর মত মন! এই বালকের দল আসে ভিক্ষা নিতে। বিহারের আচার্যদের দেওয়া দান গ্রহন করে ফিরে যায় ঘরে। গৃহস্থ বৌদ্ধ এইভাবে দিন শুরু করে। অন্য যারা আছেন তাঁরা এ নিয়ে খুব একটা সময় ব্যয় করেন না। কিন্তু দীপঙ্কর এদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। খেলা করেন এদের সঙ্গে। বালকের দল একসঙ্গে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। তিনিও তাদের সঙ্গে জুড়ে দেন সাঁতারের প্রতিযোগিতা। শিশুর কলহাস্যে মেতে ওঠে গঙ্গার জল। আর সেই শব্দ ছাপিয়ে শোনা যায় দীপঙ্করের ভারী অথচ শিশুসুলভ হাসির শব্দ। বিহারের নবীন শ্রমনের দল কখনও এদিক পানে এলে সেই হাসি খেলার শব্দে দাঁড়িয়ে পড়ে। অবাক হয়ে দ্যাখে আচার্যের অদ্ভুত শিশুসুলভ আচরণ। কখনও তাদেরও ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে এক চিলতে হাসি। তবে এই মহাপণ্ডিতকে যতটা ভয় ও সমীহ করতে হবে বলে দ্বারপণ্ডিত বলে দিয়েছিলেন, ততটা সত্যি নয়! ইনি তো তাদের চেয়েও সরল! অধ্যাপনায় কি করেই বা বজ্রকঠিন হবেন! যে শিশুটি দীপঙ্করের কাছ ঘেঁসে এসে দাঁড়ায় কিন্তু মুখে কিছু বলেনা তাকে তিনি বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন। চোখ দুটিতে কি মায়া! দীপঙ্কর চান যে সে একবার বলুক – অতীশ কিছু দাও। কিন্তু সে বলেনা। অন্যদের সঙ্গে সেদিন গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেও। হঠাৎ দীপঙ্কর দেখলেন একি! শিশুটি তো সাঁতার জানেনা! ভেসে যাচ্ছে স্রোতে। ছেলের দল হয়ত তাকে লক্ষ্যই করেনি। বা হয়ত তাকে জলে ঝাঁপাতে বারণ করেছিল। সে শোনেনি। ক্ষিপ্রগতিতে সাঁতার কেটে এসে তিনি শিশুটিকে রক্ষা করেছিলেন। জল থেকে তুলে এনে যখন ঘাটে বসিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কেন সে সাঁতার না জেনে জলে ঝাঁপ দিয়েছে, সে কোনও উত্তর করেনি। ছেলের দল থেকে একজন বলেছিল ছেলেটি কথা বলতে পারেনা। সে মূক। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন আচার্য। এত সুন্দর শিশুটি মূক! কে বলতে পারে জন্মান্তর রহস্য! সেই থেকে এর ওপর এক বিশেষ স্নেহ জন্মেছে তাঁর। ঘাটে এসে খোঁজেন তাকে। নিয়ে যান গঙ্গায়। তাকে বুকের ওপর নিয়ে চিত সাঁতার কাটেন। শিখিয়ে দিতে চেষ্টা করেন সাঁতার। তারপর যখন দান শেষে উঠে আসেন ঘাট ছেড়ে বিহারের সোপানে, তখন ছেলের দল চিৎকার করে – ভালা হো ও নাথ অতীশ। তিনি হাসতে হাসতে উঠে যান।
কিছুকাল পূর্বেও তিব্বতের রাজা একদল শ্রমণকে পাঠিয়েছিলেন বিক্রমশিলায়। উদ্দেশ্য দীপঙ্করকে তিব্বতে আসতে রাজি করানো। তিব্বতে ধর্ম নাশ হতে চলেছে। রাজা তার পুনরুদ্ধার চান। কিন্তু দ্বারপণ্ডিত রত্নাকর শান্তি প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন দীপঙ্করকে। ভারতবর্ষ এক ভীষণ সঙ্কটের মুখে। এসময়ে দেশত্যাগ ভারতভূমিকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার মত। তাই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই রাজপ্রেরিত দলকে। মাঝে মাঝে দীপঙ্কর চিন্তা করেন। সেই অশোক রাজার সময় থেকে বৌদ্ধধর্ম নানা শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত। রাজানুগ্রহে স্থবিরবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলেন তখন। কিন্তু বুদ্ধের স্বভুমিতে ও বঙ্গ মগধে মহাসাঙ্ঘিক মহাযানজ্ঞানীদেরই প্রভাব। আর এখন তো শতধাবিভক্ত ধর্ম! এ কেমন ধর্মের কথা ভেবেছিলেন তথাগত! দীপঙ্করও তো লোকোত্তরবাদী। তিনিও তো বিশ্বাস করেন তথাগতের অলৌকিক অস্তিত্ব জগতকে শান্তির পথে, করুণার পথে, মৈত্রীর পথে নিয়ে যাবে। তবে কেন এই ধর্মসংকট? ব্যাথিত হয়ে পোড়েন এইসব চিন্তায়। কত শত পণ্ডিত নিজের নিজের মত নিজের নিজের দর্শন প্রচারে ব্যাস্ত। কেউ ভাবেননা সমন্বয়ের কথা। এসব সময়ে তাঁর চিদাকাশে ভেসে ওঠে অবলোকিতেশ্বরের মুখ। পরম করুণায় চোখ দুটি মেলে তিনি বসে আছেন। জগতের একটি মানুষও যতক্ষণ নির্বাণলাভ করতে বাকি থাকবে ততক্ষণ তিনি নির্বাণ নেবেননা। কই তিনি তো হীনযানপন্থীদেরকে জগতের বাইরে রাখছেননা? যে সঙ্কটের কথা পালরাজা আলোচনা করেন রত্নাকর শান্তির সঙ্গে সেই রাজনৈতিক সঙ্কটের চেয়ে এই ধর্মের সংকট কি বেশি ভয়াবহ নয়? তিনি তাঁর এই প্রজ্ঞা নিয়ে এই শুদ্ধ দর্শন নিয়ে তবে কতটুকু অগ্রসর হতে পারলেন করুণার পথে? গভীর চিন্তায় ডুবে যখন বসে থাকেন তিনি তখন সেই ধ্যানমগ্ন আচার্যের কাছে কেউ ঘেঁষতে পারেনা। দূর থেকে তাকে দেখে প্রণাম জানায় ছাত্রের দল।
তিব্বতের সেই রাজা পরলোকে। আবার এসেছেন তিব্বতী রাজদুত। এবার প্রেরন করেছেন পূর্ববর্তী রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র। অধিক সতর্কতার কারণে দীপঙ্কর তাই বিহারময় জারি করেছেন এক নির্দেশ। দুতেদের কাছে তাঁর কোনও চিত্র নেই। তাই তাঁকে চিণ্হিত করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। কেউ যেন তাঁকে চিনিয়ে না দেন। এই লুকোচুরি খেলায় কিন্তু সহস্র সহস্র ছাত্র ও শিক্ষকের দল মহা উৎসাহে যোগ দিয়েছেন। তিব্বতী রাজদূতেরা ঘুরছেন সারা বিহারে। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সে উত্তর দিচ্ছে – অতীশ এখন সুবর্ণদ্বীপে। ধর্মকীর্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন। কেউ বা বলছে, অতীশ এখন জলন্ধরে। কনিস্করাজার সেই গোপন কুঠুরি খুঁজতে গেছেন। যেখানে মহাযানধর্মকে তামার পাতে খোদাই করে তোরঙে ভরে রাখা আছে। একলক্ষ মন্ত্র! কম কথা! দূতের দল অপেক্ষমান। না, তাঁরা এত সহজে হাল ছাড়বেননা। মজার কথা হল, অতীশ তাঁদের চোখের সামনেই দিনে দশবার ঘোরাঘুরি করছেন। তাঁরা ধরতে পারছেননা।
একদিন প্রাতঃকালে প্রধান দূত বেড়িয়েছেন বিহারের বাইরে। এদিকপানে বড় কোলাহল। মানুষের ভিড়। নির্জনে বসে একটু ভাববেন কি করে দীপঙ্করের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে তা সম্ভব নয়। অজস্র মানুষ, বিপণি, শ্রমণছাত্রের বিশাল দল রাজপথে অনর্গল চলেছে। একটু নির্জনতা খুঁজতে তিনি ঘুরে ঘুরে বিহারের পিছনে চলে এলেন। বাহ, কি অপূর্ব শোভা তো এই স্থানের! বিহারের গা ঘেঁসে চলেছে বিশাল নদী। ইতস্তত গুলঞ্চ অশ্বত্থ গাছ। নিবিড় ছায়ায় নির্জন ধ্যানাসন যেন প্রকৃতির নিজের নিয়মেই গড়ে উঠেছে। হঠাৎ শিশুর কলহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠল প্রাচীরের আর এক প্রান্ত। দূত চমক ভেঙে প্রাচীরের প্রান্তে এসে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন এক মধ্যবয়সী বলিষ্ঠ পুরুষ। কি তাঁর দেহকান্তি! একদল বালক তাঁকে ঘিরে। সকলেই যেন স্নান করে উঠেছেন। পুরুষটির কোলে একটি শিশু। তিনি দেখলেন পুরুষটি সকলকে ফল ও মিঠাই দিচ্ছেন। শিশুটির মুখে তুলে দিচ্ছেন ফল, মিষ্টির টুকরো। তারপর আস্তে আস্তে তাকে নামিয়ে দিলেন মাটিতে। এবার তিনি সিঁড়িতে উঠছেন। পিছনে ছেলের দল চিৎকার করছে – ভালা হো ও নাথ অতীশ। চমকে উঠলেন দূত। এই দীপঙ্করশ্রী জ্ঞান অতীশ! তাঁর চোখের সামনে অসংখ্য বার আসছেন! অথচ একটি কাকপক্ষীও বলছেনা যে তিনিই দীপঙ্কর!
সেদিন সন্ধ্যায় বিহারের শীর্ষ প্রাঙ্গণে সভা বসেছে। রাজদূত নিবেদন করছেন তিব্বতে ধর্মের ভয়াবহ অবস্থা। আশার কথা একটাই। রাজা নিজে এই দুর্দশা কাটাবার জন্যে সচেষ্ট হয়েছেন। রাজার অনুগ্রহে এ কাজ অসম্ভব নয়। দীপঙ্কর তাঁকে ভারতবর্ষের আসন্ন দুর্দশার কথা ব্যক্ত করলেন। জানালেন তিনিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিকরে নিজের দেশকে এই বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে যাবেন! দূত হাসলেন – আপনি রাজপুত্র। আপনার চিত্তে সেই স্বভাব এখনও প্রবল। তাই ধর্মরক্ষা নয়, স্বদেশকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষাই আপনার কাছে ধর্ম হয়েছে আচার্য! দীপঙ্করের চমক ভাঙল। তাই তো! তিনি তো রাজধর্ম পালন করছেন! তাঁর তো শুধু স্বজাতিপ্রীতিই পরিলক্ষিত হচ্ছে! জগতের কল্যাণ কামনায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন কই!
রত্নাকর শান্তির চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক রাত্রির মধ্যযামে দীপঙ্কর বিহার ত্যাগ করলেন। সঙ্গে রইলেন তিব্বতের দূতদল। নৌকো যখন গঙ্গায় ভাসতে শুরু করেছে একবার ফিরে তাকালেন পিছনে। সেই শিশুমুখটি একবার মানসে ভেসে উঠল। প্রধান দূত কি জানি কি বুঝলেন। বললেন – মান্যবর জগতে আপনি স্বাগত!
.......................................................................................................................................
মান্যবর
অনিন্দিতা মণ্ডল
আজ ও সেই ছোট্ট ছেলেটা ঘাটে এসেছে। কতইবা বয়স! চার পাঁচ বছরের শিশু হবে। একদল ছেলের সঙ্গে সেও এসেছে। রোজই আসে। ছেলের দল আসে মহাচার্যের স্নানের সময়। বিক্রমশিলা মহাবিহারের একেবারে শীর্ষ প্রকোষ্ঠ থেকে একটি সিঁড়ি গুপ্তপথে সোজা নেমে এসেছে জাণ্হবী তীরে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন তিনি। মহাপুরুষের শিশুর মত মন! এই বালকের দল আসে ভিক্ষা নিতে। বিহারের আচার্যদের দেওয়া দান গ্রহন করে ফিরে যায় ঘরে। গৃহস্থ বৌদ্ধ এইভাবে দিন শুরু করে। অন্য যারা আছেন তাঁরা এ নিয়ে খুব একটা সময় ব্যয় করেন না। কিন্তু দীপঙ্কর এদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। খেলা করেন এদের সঙ্গে। বালকের দল একসঙ্গে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। তিনিও তাদের সঙ্গে জুড়ে দেন সাঁতারের প্রতিযোগিতা। শিশুর কলহাস্যে মেতে ওঠে গঙ্গার জল। আর সেই শব্দ ছাপিয়ে শোনা যায় দীপঙ্করের ভারী অথচ শিশুসুলভ হাসির শব্দ। বিহারের নবীন শ্রমনের দল কখনও এদিক পানে এলে সেই হাসি খেলার শব্দে দাঁড়িয়ে পড়ে। অবাক হয়ে দ্যাখে আচার্যের অদ্ভুত শিশুসুলভ আচরণ। কখনও তাদেরও ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে এক চিলতে হাসি। তবে এই মহাপণ্ডিতকে যতটা ভয় ও সমীহ করতে হবে বলে দ্বারপণ্ডিত বলে দিয়েছিলেন, ততটা সত্যি নয়! ইনি তো তাদের চেয়েও সরল! অধ্যাপনায় কি করেই বা বজ্রকঠিন হবেন! যে শিশুটি দীপঙ্করের কাছ ঘেঁসে এসে দাঁড়ায় কিন্তু মুখে কিছু বলেনা তাকে তিনি বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন। চোখ দুটিতে কি মায়া! দীপঙ্কর চান যে সে একবার বলুক – অতীশ কিছু দাও। কিন্তু সে বলেনা। অন্যদের সঙ্গে সেদিন গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেও। হঠাৎ দীপঙ্কর দেখলেন একি! শিশুটি তো সাঁতার জানেনা! ভেসে যাচ্ছে স্রোতে। ছেলের দল হয়ত তাকে লক্ষ্যই করেনি। বা হয়ত তাকে জলে ঝাঁপাতে বারণ করেছিল। সে শোনেনি। ক্ষিপ্রগতিতে সাঁতার কেটে এসে তিনি শিশুটিকে রক্ষা করেছিলেন। জল থেকে তুলে এনে যখন ঘাটে বসিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কেন সে সাঁতার না জেনে জলে ঝাঁপ দিয়েছে, সে কোনও উত্তর করেনি। ছেলের দল থেকে একজন বলেছিল ছেলেটি কথা বলতে পারেনা। সে মূক। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন আচার্য। এত সুন্দর শিশুটি মূক! কে বলতে পারে জন্মান্তর রহস্য! সেই থেকে এর ওপর এক বিশেষ স্নেহ জন্মেছে তাঁর। ঘাটে এসে খোঁজেন তাকে। নিয়ে যান গঙ্গায়। তাকে বুকের ওপর নিয়ে চিত সাঁতার কাটেন। শিখিয়ে দিতে চেষ্টা করেন সাঁতার। তারপর যখন দান শেষে উঠে আসেন ঘাট ছেড়ে বিহারের সোপানে, তখন ছেলের দল চিৎকার করে – ভালা হো ও নাথ অতীশ। তিনি হাসতে হাসতে উঠে যান।
কিছুকাল পূর্বেও তিব্বতের রাজা একদল শ্রমণকে পাঠিয়েছিলেন বিক্রমশিলায়। উদ্দেশ্য দীপঙ্করকে তিব্বতে আসতে রাজি করানো। তিব্বতে ধর্ম নাশ হতে চলেছে। রাজা তার পুনরুদ্ধার চান। কিন্তু দ্বারপণ্ডিত রত্নাকর শান্তি প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন দীপঙ্করকে। ভারতবর্ষ এক ভীষণ সঙ্কটের মুখে। এসময়ে দেশত্যাগ ভারতভূমিকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার মত। তাই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই রাজপ্রেরিত দলকে। মাঝে মাঝে দীপঙ্কর চিন্তা করেন। সেই অশোক রাজার সময় থেকে বৌদ্ধধর্ম নানা শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত। রাজানুগ্রহে স্থবিরবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলেন তখন। কিন্তু বুদ্ধের স্বভুমিতে ও বঙ্গ মগধে মহাসাঙ্ঘিক মহাযানজ্ঞানীদেরই প্রভাব। আর এখন তো শতধাবিভক্ত ধর্ম! এ কেমন ধর্মের কথা ভেবেছিলেন তথাগত! দীপঙ্করও তো লোকোত্তরবাদী। তিনিও তো বিশ্বাস করেন তথাগতের অলৌকিক অস্তিত্ব জগতকে শান্তির পথে, করুণার পথে, মৈত্রীর পথে নিয়ে যাবে। তবে কেন এই ধর্মসংকট? ব্যাথিত হয়ে পোড়েন এইসব চিন্তায়। কত শত পণ্ডিত নিজের নিজের মত নিজের নিজের দর্শন প্রচারে ব্যাস্ত। কেউ ভাবেননা সমন্বয়ের কথা। এসব সময়ে তাঁর চিদাকাশে ভেসে ওঠে অবলোকিতেশ্বরের মুখ। পরম করুণায় চোখ দুটি মেলে তিনি বসে আছেন। জগতের একটি মানুষও যতক্ষণ নির্বাণলাভ করতে বাকি থাকবে ততক্ষণ তিনি নির্বাণ নেবেননা। কই তিনি তো হীনযানপন্থীদেরকে জগতের বাইরে রাখছেননা? যে সঙ্কটের কথা পালরাজা আলোচনা করেন রত্নাকর শান্তির সঙ্গে সেই রাজনৈতিক সঙ্কটের চেয়ে এই ধর্মের সংকট কি বেশি ভয়াবহ নয়? তিনি তাঁর এই প্রজ্ঞা নিয়ে এই শুদ্ধ দর্শন নিয়ে তবে কতটুকু অগ্রসর হতে পারলেন করুণার পথে? গভীর চিন্তায় ডুবে যখন বসে থাকেন তিনি তখন সেই ধ্যানমগ্ন আচার্যের কাছে কেউ ঘেঁষতে পারেনা। দূর থেকে তাকে দেখে প্রণাম জানায় ছাত্রের দল।
তিব্বতের সেই রাজা পরলোকে। আবার এসেছেন তিব্বতী রাজদুত। এবার প্রেরন করেছেন পূর্ববর্তী রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র। অধিক সতর্কতার কারণে দীপঙ্কর তাই বিহারময় জারি করেছেন এক নির্দেশ। দুতেদের কাছে তাঁর কোনও চিত্র নেই। তাই তাঁকে চিণ্হিত করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। কেউ যেন তাঁকে চিনিয়ে না দেন। এই লুকোচুরি খেলায় কিন্তু সহস্র সহস্র ছাত্র ও শিক্ষকের দল মহা উৎসাহে যোগ দিয়েছেন। তিব্বতী রাজদূতেরা ঘুরছেন সারা বিহারে। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সে উত্তর দিচ্ছে – অতীশ এখন সুবর্ণদ্বীপে। ধর্মকীর্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন। কেউ বা বলছে, অতীশ এখন জলন্ধরে। কনিস্করাজার সেই গোপন কুঠুরি খুঁজতে গেছেন। যেখানে মহাযানধর্মকে তামার পাতে খোদাই করে তোরঙে ভরে রাখা আছে। একলক্ষ মন্ত্র! কম কথা! দূতের দল অপেক্ষমান। না, তাঁরা এত সহজে হাল ছাড়বেননা। মজার কথা হল, অতীশ তাঁদের চোখের সামনেই দিনে দশবার ঘোরাঘুরি করছেন। তাঁরা ধরতে পারছেননা।
একদিন প্রাতঃকালে প্রধান দূত বেড়িয়েছেন বিহারের বাইরে। এদিকপানে বড় কোলাহল। মানুষের ভিড়। নির্জনে বসে একটু ভাববেন কি করে দীপঙ্করের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে তা সম্ভব নয়। অজস্র মানুষ, বিপণি, শ্রমণছাত্রের বিশাল দল রাজপথে অনর্গল চলেছে। একটু নির্জনতা খুঁজতে তিনি ঘুরে ঘুরে বিহারের পিছনে চলে এলেন। বাহ, কি অপূর্ব শোভা তো এই স্থানের! বিহারের গা ঘেঁসে চলেছে বিশাল নদী। ইতস্তত গুলঞ্চ অশ্বত্থ গাছ। নিবিড় ছায়ায় নির্জন ধ্যানাসন যেন প্রকৃতির নিজের নিয়মেই গড়ে উঠেছে। হঠাৎ শিশুর কলহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠল প্রাচীরের আর এক প্রান্ত। দূত চমক ভেঙে প্রাচীরের প্রান্তে এসে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন এক মধ্যবয়সী বলিষ্ঠ পুরুষ। কি তাঁর দেহকান্তি! একদল বালক তাঁকে ঘিরে। সকলেই যেন স্নান করে উঠেছেন। পুরুষটির কোলে একটি শিশু। তিনি দেখলেন পুরুষটি সকলকে ফল ও মিঠাই দিচ্ছেন। শিশুটির মুখে তুলে দিচ্ছেন ফল, মিষ্টির টুকরো। তারপর আস্তে আস্তে তাকে নামিয়ে দিলেন মাটিতে। এবার তিনি সিঁড়িতে উঠছেন। পিছনে ছেলের দল চিৎকার করছে – ভালা হো ও নাথ অতীশ। চমকে উঠলেন দূত। এই দীপঙ্করশ্রী জ্ঞান অতীশ! তাঁর চোখের সামনে অসংখ্য বার আসছেন! অথচ একটি কাকপক্ষীও বলছেনা যে তিনিই দীপঙ্কর!
সেদিন সন্ধ্যায় বিহারের শীর্ষ প্রাঙ্গণে সভা বসেছে। রাজদূত নিবেদন করছেন তিব্বতে ধর্মের ভয়াবহ অবস্থা। আশার কথা একটাই। রাজা নিজে এই দুর্দশা কাটাবার জন্যে সচেষ্ট হয়েছেন। রাজার অনুগ্রহে এ কাজ অসম্ভব নয়। দীপঙ্কর তাঁকে ভারতবর্ষের আসন্ন দুর্দশার কথা ব্যক্ত করলেন। জানালেন তিনিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিকরে নিজের দেশকে এই বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে যাবেন! দূত হাসলেন – আপনি রাজপুত্র। আপনার চিত্তে সেই স্বভাব এখনও প্রবল। তাই ধর্মরক্ষা নয়, স্বদেশকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষাই আপনার কাছে ধর্ম হয়েছে আচার্য! দীপঙ্করের চমক ভাঙল। তাই তো! তিনি তো রাজধর্ম পালন করছেন! তাঁর তো শুধু স্বজাতিপ্রীতিই পরিলক্ষিত হচ্ছে! জগতের কল্যাণ কামনায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন কই!
রত্নাকর শান্তির চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক রাত্রির মধ্যযামে দীপঙ্কর বিহার ত্যাগ করলেন। সঙ্গে রইলেন তিব্বতের দূতদল। নৌকো যখন গঙ্গায় ভাসতে শুরু করেছে একবার ফিরে তাকালেন পিছনে। সেই শিশুমুখটি একবার মানসে ভেসে উঠল। প্রধান দূত কি জানি কি বুঝলেন। বললেন – মান্যবর জগতে আপনি স্বাগত!
No comments:
Post a Comment