পৌষের বুকে সংক্রান্তির গল্প
-বিদগ্ধ দুর্জয়
আজ যদি চুপ করে বসে থাকি মানে "আমি চাষি নয়"!
একজন ঐশ্বর্যের ভাগীদার, বৃথা আমার কোদাল নাঙলের পরিশ্রম, বৃথা আমার দু-আওড়ি খেটে নতুন ধান ফলানোর পৌষালী নেমন্তন্ন।
তার প্রথম মজা যে আজই 'পৌষের পার্বন'।তাই নতুন ধানের স্বাদটা দাঁতে কেটে দেখতেই হবে আর মুখের লালায় সরু-চাকলি কিংবা গড়গড়ি অথবা দুধ-পুলি তে ভুলে যেতে হবে পরিশ্রমের কষ্টকে ।মাকে তাই তাড়াতাড়ি দিতে বললাম খেজুর-গুড় আর পিঠে! মুখে দিতেই মনে পড়লো সেই দিন_____
যেদিন আমাকে কেউ বলতো না পিঠে তৈরির মাটির তাওয়া এনে দিতে,কেউ বলতো না বার লক্ষীর মোয়া সন্দেশ হাট থেকে আনতে, কেউ বলতো না নদীর বাঁধ থেকে ঘরঘসী গাছ আনতে।সব বাবা করতো দুহাতে ।
____আমি শুধু পাড়ার ছেলেদের সাথে নতুন খড়ের বিচুলি পাকাতাম, এত বড় করতাম যে মণ্ডলদের পাড়া হয়ে পাঁজা পাড়ার ভিতর দিয়ে যেন আমাদের পাড়াতে আসে আর তাতে ঝুলিয়ে দিতাম "আস্কে পিঠে কিংবা খড়ের ভূত। রাত্রি জাগার জন্য একদল ছেলে মিলে দুদিক থেক গরুর গাড়িড় চাল লাগিয়ে বানাতাম খড় দিয়ে ঘর।ফিষ্টির জন্য মাকে চাল চাইলে বলতো হবে না আজ দিতে নেই ঘরের সামগ্রী, পরে দিতে বাড়ির বাইরে আলাদা রাখা থেকে। মা বাউনি বাঁধতো_____
আউনি বাউনি তিনদিন তিনরাত
কোথাও যেওনি...
ঘরে বসে পিঠে ভাত খেয়ও!
এই মন্ত্র বলে ।গ্রামের বাঙালির প্রচলিত রিতি আজও বহাল।কোদাল কাস্তে নাঙল জোয়াল সব মা লক্ষীর আঁচলে বাঁধা।তিনদিন শুধু আনন্দ পার্বন।
সারা রাত জাগে তোষলা গানা গাওয়া হতো ! সেই গান আজও মনিকোঠায়______
তুষু আমার মা গো...
আলতা পড়া পা গো...
জামাই আনতে যাও গো!
জামাই আনা এতো সোজা নয় মা,
দুশো টাকা খরচ গো...
একশো টাকা খাওয়ান দাওয়ান
একশো টাকার বিছানা...
ভোর হলে খালি গায়ে তোষলা সাজানো চারিদিকে মশাল দিয়ে পুরো সড়াইটা গাঁধা আর সরসে ফুলে সাজিয়ে মাথায় নিয়ে জলে ডুব, সারা পুকুর জুড়ে আরও সকলে ভাষাতো সারা পুকুরে শুধু মাশাল জ্বলতো আর টুবটুব করে সড়াই গুলো ভাসতো...
আর হাড় কনকনে ঠাণ্ডাকে পরাজিত করে আমরা দু-ফাল দিতাম জলে।সেই চিত্র যে কী অপরুপ তা যদি কেউ সংক্রান্তির ভোরে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়েছে কেবল সে জান প্রকৃতির মাঝে এ কেমন শোভাযাত্রা ।
তারপর নতুন জামা-প্যাণ্ট পড়ে নতুন ধানের বাসী ভাজা পিঠের উদ্বোধন করে সোজা ঘুড়ির মাঠ ।সেখানেই দিনটা কখন শেষ হয়ে যেত মাজান দেওয়া সুতো লাটাইয়ে গুড়েয়ে আর আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে।
সন্ধ্যা নেমে আসতো ক্লান্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধানা কাটা জমির 'লাড়া' মাড়িয়ে মাড়িয়ে বাড়ি ফিরতাম।
আজ সেই দিনগুলো আমার দুচোখে সোনার হারের চেয়ে দামি, জানি আর কোনদিন ফিরে পাবো না,
পাবো না পাঠকের কড়তালি তবু লিখতে ক্ষতি নেই ,
এ যে জীবন খাতার আর মন কলমের দাম্পত্য সম্পর্ক।
কোনদিন ক্ষয় হতে পারে কি?
আজ আমার সময় শেষ হয়ে গেছে,তাতে কি আমার মতো আজকে যারা আছে তারও তো এপথের শরিক....
No comments:
Post a Comment