Monday 26 June 2017

মুক্তগদ্য

বোলান

শুভঙ্কর দে



অনেক বছর আগে আমি  মামারবাড়ি গেছিলাম শুধুমাত্র একটা উৎসব দেখবার জন্য । তখন আমি অনেক ছোটো,কিন্তু সেই স্মৃতি আজও আমার মনের আয়নায় জ্বলজ্বল করে । জীবনে প্রথম মা'কে ছেড়ে এক অজানা আনন্দের টানে মামার হাত ধরে চলেছি মামারবাড়ির গ্রামে। আমি ছুটে গেছিলাম একটা কৌতুহল নিয়ে 'বোলান' নামক এক উৎসবের টানে। কিন্তু তার সঙ্গে আমি পেয়েছিলাম গ্রামের মায়ের অমলিন মুখের সৌন্দর্য ও তার আঁচলের সুবাস। আমরা হেঁটে চলেছি ধূলোভরা মাটির রাস্তা উপর দিয়ে। দূরে যতদূর চোখ যাচ্ছে ধূ-ধূ করছে শুকনো মাঠ । ঝাঁ ঝাঁ করছে চৈত্রের রোদ। সেই রোদে দু'তিনটে গরুর পাল মাঠে চরছে আর বড় বড় দুটো কালো ছাতা ফুটিয়ে দুজন ছাতার তলায় বসে আছে। হাঁটতে হাঁটতে যখন গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছালাম, লক্ষ করলাম অদূরেই ছোটো একটা জঙ্গল, গাছের গায়ে গাছ, জঙ্গলের ঘাড়ে জঙ্গল, বাতাসে ভেসে আসছে গাছের পাতার গন্ধ। শোনা যাচ্ছে বুনো পাখির কলকলানি। দিনদুপুরেই দুটো শেয়াল মাথা তুলে একবার দেখে নিয়েই ছুট। গ্রামের মুখে ঢুকতেই বিরাট আকারের একটা বটগাছ চারিদিকে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। গাছের ডালে ডালে অনেক গুলো টিয়াপাখি টা-টা করে চলেছে আর টুপ টুপ করে বটের বীচগুলো মাটিতে পড়ছে। রোদে এতটা হেঁটে গাছের ছায়ায় প্রাণটা জুডালো। একটু এগিয়ে যেতেই হোগলার ঝাড়। পাশেই এঁদো ডোবা। ডোবাতে কচুরিপানায় ভর্তি। রাস্তার দু'ধারে আম, জাম,তাল,পাকুড় গাছ সারি সারি। গাছে গাছে পাখিদের কিচিরমিচির। কয়েকজন বালক ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে কাঁচা আম পাড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মামারবাড়িতে ঢুকবো ঢুকবো তার আগেই একটা মাটির মন্দির, টিনের চাল দিয়ে ঘেরা। মন্দিরটি পাড়ার মন্দির। আজ সন্ধ্যে থেকে এই মন্দিরের সামনের চাতালেই 'বোলান' হবে। তার জন্য বেশ সাজ সাজ রব। মন্দিরের ভিতরে তিনজন বসে বসে একটা লম্বা পাটের দড়িতে আমপাতার শাখা বাঁধছে। মামাকে জিজ্ঞাসা করতেই মামা বলল," ওটা এই মন্দিরের চারপাশে টাঙানো হবে।" অর্থাৎ গ্রামের অলংকার। আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওখানে বসে ওদের কাজ দেখতে, কিন্তু গরমে এতটা পথ আসায় মামা থাকতে দিলনা, অগত্যা গিয়ে ঢুকলাম মামারবাড়িতে।
সন্ধ্যের সময় আমি দাদুর হাত ধরে এসে বসলাম সেই মন্দিরের চাতালের একপাশে। গ্রামের অনেক লোক ইতিমধ্যেই জড়ো হয়ে গেছে 'বোলান' দেখার জন্য। মাথার উপর আমপাতার শাখা ঝুলছে, দুটো গাছে দু'দিকে দুটো মাইক আটকে রাখা হয়েছে। রাস্তার ধারে ধারে টিউবলাইট জ্বলছে। তখন এমন একটা সময় যখন গ্রামের ইলেকট্রিক এসে পৌঁছায়নি। তাই জেনেরেটার দিয়ে টিউবলাইট জ্বালানো হয়েছে। সারাদিনের প্রখর রোদের দাবদাহের পর সন্ধ্যের সময় শেষ বসন্তের ঠাণ্ডা হাওয়া জুড়িয়ে দিচ্ছে তপ্ত শরীর। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। গ্রামের অন্যান্য প্রান্তর থেকেও অনেকে এসেছে 'বোলান' দেখার জন্য। গ্রামে সেইরকম কোনো অনুষ্ঠান হয়না। তিন পুজো ছাড়া 'বোলান' একমাত্র লোকায়ত উৎসব। 'বোলান' নিয়ে এত কথা অথচ কী এই 'বোলান'? এটা নিয়ে কিছু কথা আমি বলব যাতে পাঠকের বুঝতে সুবিধে হয়।
বোলান একপ্রকার লোকগীতি। যা শিবের গাজন উপলক্ষে গাওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া,বীরভূম ও মূর্শিদাবাদ জেলায় এই গানের প্রচলন বেশি। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো আমার মামারবাড়ি মূর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত 'দেচাপড়া' নামের গ্রামে। যে কথা বলছিলাম, এই বোলান নৃত্য-গীত-অভিনয় সমন্বয়ে পরিবেশিত হয়।


'বোলান' শব্দের অর্থ বঙ্গীয় শব্দকোষে রয়েছে-'প্রবচন'! কিন্তু গ্রামের মানুষদের কাছে জানতে পেরেছি 'বোল' মানে ডাক। ডাক থেকেই বোলান। আবার কেউ মনে করেন 'বুলা' থেকে বুলান গান। 'বুলা' অর্থে বেড়ানো। অর্থাৎ পাড়া ঘুরে এ গান গাওয়া হয় বলে একে বলে 'বুলান'! বোলান গানের একটা করে দল থাকে। সেই দল গায়ক, বাদক ও অভিনেতাদের সমন্বয়ে গঠিত। একজন ওস্তাদ দলের নেতৃত্ব দেয়। বোলান গান বাঁধা হয় পালার আকারে। এর মুখ্য বিষয় সাধারণত পৌরাণিক হয়ে থাকে, তবে সময় সাপেক্ষে সামাজিক বিষয় হয়ে থাকে। এতে লঘু-গুরু উভয় বিষয়ই স্থান পায়। গুরু বিষয় খণ্ডগীতি, আর লঘু বিষয় রঙপাঁচালী নামে পরিচিত। রঙপাঁচালী মূল পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পর হয়। এতে কৌতুক ও হাল্কা রসের বিষয় থাকে। হাস্যরসই এর প্রধান উপজীব্য।
বন্দনাগীতির মাধ্যমে বোলান গান শুরু হয় এবং পরে পাঁচালীর ঢঙে মূল পালা শুরু হয়। সংলাপ ও গআনএর মধ্যে দিয়ে পুরো বিষয়টা পরিবেশিত হয়। বোলান গান শিক্ষিত মানুষদের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। এটা মূলত গ্রাম্য অশিক্ষিত কিন্তু অভিজ্ঞ ব্যক্তি বিভিন্ন সুর তৈরি করে একটা ঘটনাকে সুন্দরভাবে রচনা করেন। এদের 'ছড়াদার ' বলে। এতে একজন 'বইবাঁধা'র কাজ করে। অর্থাৎ একটা ঘটনাকে গান ও সংলাপ দিয়ে রচনা করে পালাগান সৃষ্টি করে । বোলানে মানুষের জীবনে হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের ঘটনাই মূল উপজীব্য। চৈত্র মাসে সংক্রান্তির আগের দিন শুরু হয় টানা দুদিন চলে। এতে অংশগ্রহন করেন সাধারণত অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নিম্নবর্ণের মানুষ। তারাই জানে মানুষে কষ্ট। তাই তারাই নৃত্য-গীত-অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারে মানুষের অন্তর্বেদনার ছবি।

সেদিন সন্ধ্যে থেকে টানা একটার পর একটা 'বোলান' গান হয়ে যাচ্ছিল। আমার বাল্যবয়সের জন্য সব পালা দেখতে পাইনি। একটু রাত হতেই দাদুর কোলে মাথা রেখে বোলানের সুর শুনতে শুনতে হারিয়ে গেছিলাম ঘুমের দেশে। পরেরদিন ও সকাল থেকে শুরু হয় একটার পর একটা পালা । চলতে থাকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। জীবনে সেই প্রথম 'বোলান' আমার মনে এমন একটা জায়গা করে নিয়েছে যে তারপর থেকে প্রতি বছর যেতে থাকি বোলান এর সময় মামারবাড়ি। কিন্তু দুঃখটা এসে সামনে দাঁড়ালো গত দুবছর আগে। 2015 তেও উৎসুক মন নিয়ে গেছিলাম 'বোলান' দেখতে। কিন্তু সেবারে একটাও পালা দেখতে পেলাম না। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে কেউ আর বোলান করতে চায়না। এসব করে কোন রোজগার হয়না। বরং গ্যাঁটের কড়ি খসে। তাছাড়া যুগের পরিবর্তন ও পৃষ্টপোষকতার অভাবে বোলান লোপ পেয়েছে। সরকারের সাহায্য ছাড়া এই প্রাচীন সংস্কৃতি ভবিষ্যতে টিকে থাকা অনিশ্চিত। অগত্যা পরের দিনই আমি বিষন্ন মন নিয়ে চেপে বসলাম বাসের সিটে।




No comments:

Post a Comment