ইলিউশন
অমিয় আদক
সময়টা বিকেল। সূর্য তখনও দিগন্তের নিচে
নামেনি। দিগন্ত ছুঁয়েছে সবে। সিঁদুরে রঙের আলোর আভা লেপটে দিচ্ছে ছেঁড়া মেঘগুলোতে।
বৈকালিক প্রসাধনে তারাও যেন খুশি। রাস্তার গাছে পাখিদের শেষ বিকেলে মিটিং চলছে।
সেখানে চড়াই বুলবুলি শালিকের কিচির মিচির। কয়েকটা কাকের দাম্ভিক কা কা আওয়াজও
সেখানে জুটেছে। দিন শেষের
এপিসোড।
আমি সুদীপ্ত বাবুর কাছে চেকটা ফেরৎ দিতে
এসেছি। বিধ্বস্ত আমি সেই সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হয়েছি। কারণ তুলি আমাকে চেকটা
দিয়েছিল আজ সকালেই। সেই তুলির যখন কোন খোঁজ নেই। সে মৃত কিনা নিশ্চিত হতেও পারিনি।
তাই চেকটা ভাঙিয়ে টাকাটা কাজে লাগাব না। কাজে লাগাতে মনটাও সায় দিচ্ছে না। তুলির
সম্পর্ক ধরেই সুদীপ্ত বাবু চেকটা আমার নামে ইসু করেছেন।
আমার মনে এখন চলছে মুরগি লড়াই। লড়াকু দুটো
মুরগি। একজন ট্যাক্সি চালক আমি। অন্যজন লেখক আমি বা আমার বিবেক। দু’ জনাই সুযোগ
বুঝে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কেউ কাউকে জখম করে লড়াই শেষ করতে পারছে না।
ট্যাক্সির মধ্যেই বসে আছি। ট্যাক্সিটা
লেকের থেকে একটু দূরে। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেটের মধ্যে আমি। আমার ভাবনার
টুকরোগুলো এখন এলোমেলো। এখন দুটো বিষয়ের মাঝেই ভাবনার মাকুর তানা-বানা চলমান। এক তুলির ভাবনা। দুই চেক ফেরৎ
দেওয়ার ভাবনা।
তুলি আমার প্রেমিকা। যে দিন প্রথম
সওয়ারি হয়েছিল আমার ট্যাক্সিতে,সেদিন থেকেই একেবারে প্রেমের সিংহাসনে। তারিখটা
সম্ভবতঃ জুনের আটাশ। হাওড়া ষ্টেশন থেকে বরাতে জুটেছিল সওয়ারি হিসাবে।
একম্ অদ্বিতীয়ম্ যাত্রী।যাত্রীটিকে যুবতী না
বলে কিশোরী বলাই ভালো। বয়স আঠার উনিশের মাঝে। উনিশ পার হয়নি মনে হয়েছিল। দোহারা গড়ন। মাঝারি মাজা রঙ।
পানপাতা মুখ। টিকালো নাকে একটা সংক্ষিপ্ত নাকছাবি। কানে দুটো নীল পাথর লাগান সস্তা
দুল। কিন্তু চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর। ভীষণ সারল্য মাখা। পনি-টেল করে বাঁধা চুল।
শালোয়ার, কামিজ, পায়ের চটির রঙ জৌলুস তেমন নয়। এক কথায় ওই পোশাক বনেদিয়ানা
প্রকাশে অক্ষম।দীর্ঘ ট্রেন
যাত্রার ধকলের রঙছিল তার সারা শরীর জুড়ে।সঙ্গেদুটো ঢাউস ভারি গন্ধমাদন মার্কা ট্রলি ব্যাগ।
চেহারা দেখে মনে হয়েছিল, ট্যাক্সি চড়ার ইচ্ছাই
ছিল না। কেবল ব্যাগ দুটোই তাকে বাধ্য করেছিল। ব্যাগ না থাকলে সে বাসেই যেত। সেনিজেই
ব্যাগ তোলার চেষ্টা করল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে পারল না। আমি তা্কে তার চেষ্টা থেকে
বিরত করলাম। ব্যাগ দুটো তুলে দিলাম ডিকিতে। ডিকি লক করলাম। আমি তাকে পিছনে বসার ইঙ্গিত করলাম। আমার
ইঙ্গিতকে তার ঠোঁটের কোণার হাসি দিয়ে অমান্য করল।বা বলতে পারেন, খানিক তাচ্ছিল্য
করল। নিজেই পিছনের গেট আঁটল। তারপর সামনের গেট খুলে আমার বাম দিকের সিটের দখলদারি
নিল। গন্তব্য
আগেই বলেছিল। গাড়ি ছাড়লাম।
হাওড়া ষ্টেশন এলাকার ভিড় কাটিয়ে ট্যাক্সি
উঠল রবীন্দ্র সেতুতে। বড়বাজারের আগে রবীন্দ্র সেতুতে ঢিমে তেতালা গতি। ব্রেক
ক্লার্চের অনুপম ওঠা পড়া চলছিল। সামনে পড়ে থাকা পত্রিকা হাতে তুলল অনুমতি নিয়ে। পত্রিকার
পাতায় চোখ। মাঝে মাঝে আড় চোখ আমার দিকে। আমি অন্য মনস্ক হওয়া থেকে বিরত ছিলাম।
উল্টোডাঙ্গা ঢোকার মুখে পত্রিকাটা রেখেই স্বগতোক্তির মত বলল, দারুন লেখেন অরূপ
বাবু। এবার সরাসরি আমাকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্নটা করল, পত্রিকায় দেখা অরূপ বাবুর ওই
ছোট্ট ছবির সাথে আপনার আশ্চর্য মিল। আপনি অরূপ বাবু কিনা বলুন না?
-যিনি অত ভালো গল্প
লেখেন, তাঁর পক্ষে ট্যাক্সি চালানো সম্ভব? ভাবলেন কী করে?
-কেন সম্ভব নয়? আমি এমন আরও
কয়েক জন অসাধারণ ট্যাক্সি চালকের কথা খবরের কাগজে পড়েছি।
-তাহলে একটা নাম বলুন।
-ওই তো, দেবারতি সরকার।
তাঁর লেখা উপন্যাসও আছে।
-অনেক খোঁজ রাখেন। তাহলে
অরূপ বাবুর গল্প কতগুলো পড়েছেন?
-তা দশ বারটা হবেই।
আজকের গল্পটা বেশ অন্য রকম। ভদ্রলোকের প্রত্যেকটা গল্পই আলাদা অনুভূতিতে
মন ভরিয়ে দেয়। আমি অনেকটা ওনার গল্পের ফ্যান হয়ে
পড়েছি।
-ঠিক আছে, দেখা হলে
ওনাকে বলব। আপনার নামটা বলুন। বলব আপনার একটা ফ্যানের দেখা পেয়েছি। কথাটা মুখ
ফস্কেই বেরিয়ে গেল। বুঝলাম ধরা
দিতেই হবে।আর নিজেই ধরা দেওয়ার রাস্তাটা বানিয়ে ফেলেছি।
-আমার নাম তুলি সরকার। অরূপ
বাবুর সাথে আপনার তাহলে দেখা হয়? নাকি আপনি নিজেই অরূপ
বাবু?
-আপনি প্রথমেই যেটা
সন্দেহ করেছিলেন। সেটাই। আমিই অরূপ ভট্টাচার্য্য।
-ইস্, আমার কী সৌভাগ্য!
আমি আমার প্রিয় লেখকের গাড়িতে। উঃ আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে বুঝিয়ে
বলতে পারব না। তার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস জোয়ারের
ঢেউ উঠল। ক’টা ঢেউ গুণতে পারলাম না।
-একটা অনুরোধ করব।
রাখবেন?
-কী আবার অনুরোধ?
-আপনার কন্টাক্ট
নাম্বারটা দেবেন?
-অ্যাই সেরেছে! এটাই তো
সমস্যা। ওটা আমি পারব না। না বাবা, অনেক ঝক্কি আছে।
-কেন, বৌদি জানতে পারলে
সমস্যা হবে?
-না, না, বৌদি টৌদি নেই।
বিয়ে টিয়ে করিনি। ওসব ভয় নেই।
-তাহলে ভয় কিসের?
বিশ্বাস করুন। আমি কোন ভাবে আপনাকে বিরক্ত করব না। কেবল মাঝে মাঝে
জেনে নেব, কোন্ পত্রিকায় আপনার লেখা বের হবে।
আর অন্য কিছু প্রশ্ন করব না। কথা দিলাম।
-দেখা যাক কতটা কথা
রাখেন? কী আর করা যাবে? একজন মুগ্ধ পাঠিকার জন্য এই ত্যাগটা অন্তত
স্বীকার করি। নিন, বলছি। লোড করে নিন।
আমার গাড়ির সম্মানীয়া
আরোহী তুলি সরকার তখন মোবাইল খুলে রেডি। আমি স্মৃতি থেকে নম্বরটা আউড়ে দিলাম। আর
তিনি লোড করেনিলেন। সেখানেই
থামলেন না। আমার নম্বরে একটা মিস্ড কলও হাঁকালেন। আমার পকেটে বাজতে থাকা
রিংটোনটারও প্রশংসা করলেন।
নিজের গন্তব্যে নামলেন
যাত্রী। দুই হাতে দুই গন্ধমাদন ঠ্যালার ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। চিনিয়ে দিলেন তাঁর আবাস
স্থল। আর জানালেন, এটা আমার পাতানো দাদুর বাড়ি। দাদুর ছেলে বৌমা নাতি চিকাগোতে
থাকে। তারা বছরে একবারই আসে। তখন বাড়িটা জম-জমাট থাকে মাত্র ক’ দিন। দাদুর মেয়ের
বাড়ি দুর্গাপুর। সেখান থেকেই আমি ফিরলাম। আমি নেহাতই দাদুর আশ্রিতা বা পোষ্য। পোষ্য কথাটা শুনে আমি হাসলাম।
উত্তরে জানালেন, একদিন আপনাকে বুঝিয়ে দেব কেন নিজেকে পোষ্য হিসাবে বলেছি। বলেই
আমার হাতে টাকা ধরিয়ে গেটের মধ্যে ঢুকলেন।
মাঝে মাঝে ফোনালাপ চলতেই থাকল। আবার কোন
দিন দুজনে লেকের ধারে বসে গল্পও করতাম। ধীরে ধীরে আমাদের প্রেমের সম্পর্কটা হাল্কা
মিষ্টির শরবত থেকে মধুর মত গাঢ়তর হতে থাকল। এর মধ্যেই তুলির উনিশ বসন্ত পার হওয়া
ম্যাড়ম্যাড়ে জীবনের সাদা-কালো গল্প আমার জানা হল।
তুলির বাড়ি মালদা জেলায়।
কালিয়াচক থানায়। সে প্রকৃত পক্ষে এক অভাবী দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের বড় মেয়ে।
তারপরে তার একটা বোন এবং ভাই আছে। নিজেদের ভিটে বা বসত বাড়ির জায়গার বাইরে কোন
চাষযোগ্য জমি নেই। বাবা ক্ষেত মজুর। মাকেওপ্রয়োজনে ক্ষেত মজুরের কাজ করতে হয়। সেই পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও
একান্তই নিজের জেদেই পড়াশোনা করেছে ক্লাস এইট পর্যন্ত। গ্রামের জুনিয়র হাইস্কুলের
পাঠ শেষ হতেই পাঁচ কিমি দূরের হাইস্কুলে পাঠাতে মা-বাবা গররাজি।
মা-বাবার ভাষায় ‘মেয়ে শেয়ানা হইসে। আর লয়। পথে
ঘাটে কত বেপদ হাঁ করি আসে।’ পড়াশোনায় ইতি ঘটল। তাই ভাই বোনেদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার অলিখিত দায়িত্বটাই
নিজের ঘাড়ে বোঝার উপরশাকের আঁটির মত চাপিয়ে নিল। পাশাপাশি চলতে থাকল প্রতিবেশি
বাচ্ছাদের পড়িয়ে দেওয়া। সোজা কথায় ট্যুইশানি।তাও মাসের শেষে পয়সা আসত না। কেউ কিছু
দিত। কেউ দিতে পারত না।
সংসারে অপরিমেয় অভাব। তুলি নিজের
চেষ্টাতেই একজন মহাজনের সাথে যোগাযোগ করল। সে দিয়ে গেল শাড়ির থান আর চুমকি জরি
ইত্যাদি। আর কাগজে
আঁকা ডিজাইন। অল্প কিছু দিনের চেষ্টায় সে মোটামুটি দক্ষ কারিগর হয়ে উঠল। পরিবারে
স্বচ্ছলতা না এলেও তিন জনের আয়ে পেট পুরে খাওয়ার ব্যবস্থাটা হল।
এদিকে তুলির বাবা পড়ল অসুখে। তার চিকিৎসার রেস্ত
চাই। তার চিকিৎসা শুরু করাই যাচ্ছে না। ডাক্তার বাবু গাদা খানেক টেস্টের কথা লিখলেন। সেই টেস্টগুলো করাতেই এককালীনপাঁচ
হাজার টাকার বেশি লাগতে পারে। এমন সময় তুলির মায়ের কাছে ‘সাক্ষাৎ ভগবান’এর মত
হাজির হল তহিদুল। তাদের বর্তমান অবস্থার কথা সে মন দিয়ে শুনল। তারপর সে বলল, “ভাইব্নার
কিস্সু নাই চাচিমা। তুলি তো সব কাজই পারবা। কোলকাতায় আমাগো জানাশোনা একটা
ফ্যামিলিতে ও একটা বাচ্ছার গভর্নেস হিসাবে থাকতি পারবা না? অরা মাসে হাজার তিনেক
টাকা ব্যাতন আর থাকা খাওয়া ফ্রি দিবা।”
তুলির মা তো হাতে চাঁদ পেল। তহিদুলের হাত দুটো
ধরে কী প্রবল আকুতি, বাবা তহিদ, তুমি যা কইরাই হোক ব্যাপারডারে পাকা কর। ‘আমি অদের
সাথে ফোনে কথা কই। ব্যবস্তা একডা হইবই চাচিমা। আর আমি কী ব্যবস্তা করলাম, আজ
বিকালেই তোমারে জানান দিবা চাচিমা। তুমি ভাইবো না।’ বলেই তহিদুল মনের ভিতর অন্য
হিসেবের অঙ্ক কষতে কষতে বিদায় নিল। কিন্তু তহিদুলের ধূর্ত চোখের দুঃশাসন দৃষ্টির ভাষা
কেউ পড়তে পারল না।
সে দিন বিকেলেই ‘মহান’ তহিদুল ‘দেবদূত’ হাজির হল
তুলিদের বাড়ি। এসেই আনন্দের আতিশয্যে ঈষৎ উপরের দিকে চোখ রেখে বলল, “চাচি ও চাচিমা,
কোন চিন্তা নাই গো। আল্লা কও,
ভগমান কও সব তোমাগো সহায়। ওরা কইসে কি তোমাগো খুব টাকার দরকার থাকলি আমার কাস্
থিকা লইতে পার। তুলির ব্যাতন থিকা পরে কাটান কইর্যা আমাগো দিবে। আর দশ দিন পর
তুলিরে কোলকাতায় পৌঁসাইতে হইব। ইংরেজি মাসের পয়লা থিকা তুলির জয়েনিং।” মনে মনে তুলির মা তহিদুলকে
হাজার রকম আশীর্বাদ করল। আর একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর তহিদুলের আপ্যায়ণের
জন্য চা মুড়ির ব্যবস্থা করতে গেল রান্না ঘরে। চা মুড়ি খাওয়ার ফাঁকে তার
কর্তব্যজ্ঞানের গভীরতা বিষয়ে আরও কিছু আষাঢ়ে গল্প শোনাল। শেষে আট হাজার টাকা তুলি
মায়ের হাতে গছিয়ে দিতেও ভুলল না তহিদুল।
মহাজনের কাছে রেডি কাপড় জমাদিয়ে
নতুন থান আর জরি নিয়ে তুলি ফিরল। তখন সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে। তারপর মায়ের কাছে শুনল
‘মহানুভব’ তহিদুলের গল্প। শুনেই সে তো তেলে বেগুনে অবস্থা। সে অসুস্থ বাবাকে ফেলে
কোলকাতায় যেতে রাজি নয়। এদিকে তার মা তহিদুলের টাকা হাতে নিয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত
সে ঘুমোতেই পারল না।শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল তহিদুলের দেওয়া টাকাতে তার বাবার
চিকিৎসাটা অন্তত শুরু হোক।
তুলি মহাজনের এক
সপ্তাহের কাজ সারল পাঁচ দিনে। বাবার টেস্টগুলো করাতে নিয়ে গেল কালিয়াচক। মহাজনের
হিসেব মিটিয়ে কিছু টাকা তার হাতে এল। মাকে সব টাকা বুঝিয়ে দিল। এবার তার কলকাতা যাওয়ার
পালা। তহিদুল সাথে ছিল। দিনের ট্রেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। শান্তিনিকেতন আসার আগেই
তুলি বুঝতে পারল, সে সম্ভবত বিক্রি হতে চলেছে। কলকাতাতেই তার হাতবদল। সস্তা মোবাইল ফোনটাও মায়ের কাছে
রেখে এল। না হলে সেটা ব্যবহার করেও সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা যেত।
তাই তার বুদ্ধি যেন ক্রমশ
লোপ পাচ্ছিল। এই বিপদ থেকে বাঁচার কোন পথ সে খুঁজে পাচ্ছিল না।তহিদুলের দালালকে সে
ভালো ভাবেই চিনে নিয়েছিল। এখানে কাউকে কিছু বলে তার সন্দেহ প্রমাণ করা অসম্ভব। শান্তিনিকেতনে ট্রেন এল। এক বয়স্ক
রাশভারি মানুষের পাশের সিটটা খালি হল। তুলি ইচ্ছা করেই মানুষটির পাশে বসল।
তহিদুলের দালালের বাজপাখি নজর থেকে কেবল একটু আড়াল হওয়ার জন্য। লোকটার নজর যেন তার
কিশোরী শরীরটাকে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চিতে মাপছিল।
তুলি্র মনের মধ্যে উস্খুস্ করছিল তার আসন্ন
বিপদের কথাগুলো। কিন্তু পাশে বসা বয়স্ক ব্যক্তিটিকে বলার সাহস পাচ্ছিল না। এক বুক
সাহস ভরে তুলনায় নিচু স্বরে বলল, ‘দাদু, আমি কিছু বলতে চাইছি আপনাকে।’ ভদ্রলোকের
কানে কথাটা যেতেই তিনি বলেন, ‘আমায় কিছু বললে?’তুলি নিচু স্বরেই উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ
দাদু। আমার খুব বিপদ। আমাকে বাঁচান। বেশি কথা বললে সব ভেস্তে যাবে। বিপদ বেড়ে
যাবে।’ ভদ্রলোক না শোনার ভান করেই থাকলেন। ব্যাগের সাইড চেন খুললেন। সেখান থেকে
লেটার প্যাড আর ডটপেন বের করলেন। কিছু লিখে নিজের বাম দিকে রাখলেন। তারপর নিচু
স্বরে বললেন, ‘তোমার কথা লেখ।’
তুলি অল্প কয়েকটি বাক্যে তার বিপদের
কথা জানাল। তার প্রতি ভদ্রলোকের নির্দেশ আগেই লেখা ছিল। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থামল।
তুলি পূর্ব নির্দেশ মত ভদ্রলোকের একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে তাঁকেই অনুসরণ করতে রইল।
তহিদুল হাঁক দিল, ‘তুলি, ও দিকে কোথায় যাচ্ছ?’ তুলি যেন তাকে চেনেই না। তুলি আর ওই
ভদ্রলোক জি আর পি অফিসের দিকে হাঁটা দিচ্ছিল।দেখেই তহিদুল আর তার আড়কাঠি বিপদের
আঁচ পেল। তারা নিজেদের বিপদের মধ্যে না জড়িয়ে জন-সমুদ্রের ঢেউয়ের তলা দিয়ে সরে
পড়ল।
সেই থেকে তুলি গচ্ছিত সুদীপ্ত বাবুর কাছে।
সুদীপ্ত বাবু তুলির বাড়িতে খবর পাঠালেন। তুলির মা-বাবা আর তাকে নিয়ে যেতে এলেন না।
উল্টে জানালেন, “বাবু, তুলি আইপ্নার কাসেই থাক। অরে গাঁয়ে আনলি বেপদ আরো বাড়বা।
এমনিতেই তহিদুলের শাগরেদরা বেশ শাসান দিসে। অটারে আপনার নাতনি ভাইব্যা কাসে রাখেন।
আমরা পরে দেখা করসি।” মাঝে মধ্যেই এখন তুলি সুদীপ্ত বাবুর মুঠো ফোন মারফৎ মা বাবার
সাথে কথা বলে।এখন আর
সুদীপ্ত বাবুকে হোম ডেলিভারির চচ্চড়ি গিলতে হয় না। তুলিই রান্নাবান্না করে। দাদু
নাতনির সুখের সংসার। এ ভাবেই তুলির তিনটে বসন্ত কলকাতায় কেটে গেল। মাঝে একবার
মাত্র তার মা-বাবা সুদীপ্ত বাবুর সাথে দেখাকরে গিয়েছিল।
তুলিকে নিয়ে আমার মাথায় হাজার চাপ। মাথার মধ্যে কিলবিল
করে, নড়াচড়া করে। ওই তহিদুল মিয়া যদি কোনভাবে তুলির অবস্থান জেনে ফেলে। যদি ওর কোন
ক্ষতি করে। আর আমি বললেও তুলি শোনে না। দোকান বাজার সাইকেলে চড়ে বেপরোয়া ঘোরা ফেরা
করে। ইদানীং আমার কি হয়েছে জানি না। ওর বয়সী শালোয়ার কামিজ পরা মেয়ে দেখলেই আমার
মনে হয়, ওই তো আমার তুলি আসছে। সামনে এলেই ভুলটা ভাঙ্গে। আজকাল আমি যেন দিনে রাতে
সব জায়গায় তুলিকে দেখতে চাই।
আমার ট্যাক্সিটা একটু
দূরেই রাখি। সুদীপ্ত
বাবুর বাড়ির বাইরের ছোট্ট গেটটা খুলি।ভিতরে যাই। কলিং বেল দাবাই। ভিতর থেকে আওয়াজ
আসে, কে? কাকে চাই? আমি তুলনায় একটু জোরে বলি, সুদীপ্ত বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
‘একটু দাঁড়ান। আসছি......’ উত্তরটা শোনার কয়েক সেকেন্ড পরে দরজাটা আধ খোলা হয়।
সুদীপ্ত বাবু বলেন, ‘কি দরকার?’ আমি মুখ নিচু ল্যাম্প সেডের মতই মাটির দিকে
তাকিয়ে। আমার দৃষ্টি ভদ্রলোকের পায়ে গড়াগড়ি খায়। আমার পকেটের চেকটা এখন হাতে। কী
ভাবে কথা শুরু করব, সেই ভাবনায় ডুবে আছি। আমার দিক থেকে কথা শুরু হয় না। অধৈর্য
সুদীপ্ত বাবুই আমার প্রশ্ন করেন, ‘কি দরকার বলুন?’ আমি মুখ নিচু করেই বলি, ‘স্যার,
চেকটা রেখে দিন। ওটা আমার আর দরকার নেই।’ ‘কী চেক? কিসের চেক? কই দেখি চেকটা’
বলতেই আমি চেকটা তাঁর হাতে দিই।
চেকটা হাতে নিয়েই বলেন,
এই চেক আমি আপনাকে দিলাম কবে?
-আপনি দেন নি। তুলি
আমাকে দিয়েছিল।
-তাহলে, তুলিকেই ফেরত দেবেন।
-তুলি আমাকে দিলেও,
টাকাটা তো আপনার।
-সেটা মানছি। কিন্তু
তুলি নিয়েছিল তার বন্ধুর বই প্রকাশের জন্য। আমি চেকটা ফেরত নেব কেন? আপনি যদি মনে
করেন, টাকাটার দরকার নেই, তাহলে চেকটা তুলিকেই ফেরত দেবেন। সে আমাকে ফেরত দেবে।
খুব সহজ ভঙ্গিমায় কথাটা বলেন সুদীপ্ত বাবু। আমি বলতে বাধ্য হই, ‘স্যার, আমি তুলিকে
এখন পাব কোথায়?’
-আপনি তুলির বন্ধু? তুলি
কোথায়? এ প্রশ্ন আমাকে করছেন কেন? তুলি তো ভোরে উঠে রান্না করল। অন্য কাজ সেরে
সাইকেল নিয়ে আপনার ওখানে গেল। আপনাকে চেকটা দিতে। আমি তো ভাবলাম,তুলি আপনার হাত
ধরে পাব্লিশার্স পাড়ায় মহানন্দে চাঁদা মাছের মত জোড়া মিলিয়ে চক্কর কাটছে। তাই হয়তো এখনো ফেরেনি।
-না মানে, আমি.........
-কী, আমি আমি করছেন? চেক
নিয়ে আপনার কাছে না গেলে, চেকটা আপনি পেলেন কোথায়?
-তুলি আজ সকালেই
গিয়েছিল। আমাকে চেকটা দিতে।
-তাহলে চেকটা ফেরত দিতে
এলেন কেন? তা হলে তুলি গেল কোথায়? আজ সকালে সাইকেল নিয়ে গেল। রইলো কোথায়? তার তো এ
শহরে থাকার দ্বিতীয় কোন জায়গা নেই। বলুন, তুলি কোথায়?সুদীপ্ত বাবুর চোখে মুখে পাহাড়
প্রমাণ উত্তেজনার ছাপ। আমি বলি, স্যার, একটু ভিতরে গিয়ে বসার অনুমতি দিন। আমি
আপনাকে উত্তরটা দেওয়ার চেষ্টা করব। তিনি বলেন, ঠিক আছে ভিতরে আসুন। বেশী সময় দিতে
পারব না কিন্তু। যা বলার সংক্ষেপে বলবেন। আমাকে তো আপনি বেশ বিপদে ফেললেন মশাই। সুদীপ্ত বাবুর গলায় এক রাশ
বিরক্তি আর উষ্মা ঝরে পড়ে।
উৎকণ্ঠায় আমার শ্বাস যেন থেমে যেতে চায়। আমি ভিতরে ঢুকি। করিডরে একটা চেয়ার টেনে বসি। গলা
শুকিয়ে কাঠ। এক গ্লাস জল বড়ই দরকার। বলতে বাধ্য হই, স্যার একটু জল খাব। সুদীপ্ত
বাবু আমায় একটা জলের বোতল ধরিয়ে দেন। আমি ঢক ঢক করে সবটাই সাবাড় করি। উনি আমার
জলপান দেখার সাথে তাঁর দৃষ্টি দিয়ে আমাকে মাপজোক করেন। তাঁর দৃষ্টিতে খানিক সন্দেহের চোরা
স্রোত চুঁইয়ে পড়ে। আমার আড়
চোখের চাহনিতেই তা অনুভব করি। তবুও আমাকে ঘটনাটা বলতেই হবে।
আমি বলি, “আমার কথা বিশ্বাস করা, বা না
করা আপনার ব্যাপার। তুলির সাথে আমার পরিচয় তিন বছর আগে। তুলিই আমার পরিচয় জেনে
নিয়ে যেচে আলাপ করে।”
-কি ভাবে পরিচয়? আমার
জেনে কী লাভ? মেয়েটা কোথায়? তাই প্রিসাইজলি বলুন।
-দেখুন, সমস্তটা না
শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন না। তাই আমি খুব ছোট্ট করেই বলব।
-আপনি তো আবার গল্প
লেখেন?
-হ্যাঁ লিখি। তাতে কি
হয়েছে?
-আপনি ছোট্ট করে বলতে
পারবেন?
-দেখিনা, চেষ্টা করে।
একটু বড় হলেও আপনাকে একটু সহিষ্ণু ভাবেই শুনতে হবে।
-বলুন।
আমি বলতে শুরু করি,‘আমার
ল্যাম্প সেডটা মুখ নিচু করেই থাকে। তার উপর ধুলোর পলেস্তরা। রঙ তার কবেই মুখ লুকিয়েছে। থাকে আমার
লেখার টেবিলে। সে আমাকে আলো পেতে সাহায্য
করে। তবু আমার অনাদর তাকে ঘাড় নিচু করেই সইতে হয়। নির্বোধ পোষ্যের মত। মুখ নিচু
করেই সে আছে। তার আলোর দৃষ্টি টেবিলেই গড়াগড়ি খায়। সে আমার মতই। মুখ তুলে কাউকে
কিছু বলেনা। আমিও সেই আলোর সাহায্য নিই। মুখ নিচু করেই লিখতে থাকি।’
সুদীপ্ত বাবু আমাকে থামিয়ে বলেন, ‘আপনি তো
আমায় গল্প বলছেন। এসব জেনে আমার কী লাভ? আপনি আমায় ঘটনা বলুন।’ আমি বলি, ‘ঘটনাই তো
বলছি।’
আবার শুরু করি,‘শুনুন
তাহলে। দিনের পর দিন নিজের খেয়ালেই শব্দের ইট সাজাই। গল্পের কাঠামো বানাই। তাতে
কিছু উপমার পলেস্তরা পড়ে। তাও খুব মাঝে মাঝে। হয়তো বা বাক্যগুলোতে কিছু সাহিত্যের
ছোঁয়া পড়ে হেমন্তের কুয়াশার মত। কখনো বাক্য পছন্দ হয় না। নির্মম কালির আঁচড়ে বাদ
দিই। আবার নতুন করে ভাবি। আবার লিখি। এমনি করেই আট দশ দিন চলে ভাঙা-গড়ার খেলা।
একটা গল্প চেহারা নেয়।পেশায় আমি ট্যাক্সি চালক।লেখাটা আমার পেশা নয়। নেশা বা
প্যাশন। লেখা ডাকে পাঠাই পত্রিকার ঠিকানায়। মনোনীত হলে, প্রকাশিত হয়। পত্রিকার কপি
হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকি। যতক্ষণ ভালো লাগে। নিজের সাফল্য সুগন্ধে বিভোর হই। আমার তো
সেই গল্প পড়ার দরকার হয় না।’
সুদীপ্ত বাবু অধৈর্য হয়ে পড়েন। বলেন, ‘আপনি কি আমাকে হিপ্নোটাইজ
করার চেষ্টা করছেন? ছোট করে বলুন। আচ্ছা, আপনার নামটা কি বলুন তো?’ আমি একটু হেসে
বলি, ‘সে কি? আমার নামে চেক লিখলেন। আর নামটাই ভুলে গেলেন?আমার নাম, অরূপ ভট্টাচার্য।’
সুদীপ্ত বাবু বলেন, “আপনার ওই সমস্ত সাহিত্য কথা শোনার আগ্রহ আমার নেই। আমাকে
জানান, তুলি কোথায়?”
-ঠিক আছে বলছি। আজকের
ঘটনা। আমার বাড়ি থেকে তুলি সাইকেলে ফিরছে। আমি তখন তিন নম্বর ট্যাঙ্কের দিকে আসছি। সে বিপরীত দিকে
যাচ্ছে। আমি খানিক আগিয়ে পড়েছি। আমার গাড়ির লুকিং গ্লাসে দেখি প্রচণ্ড বেগে একটা বাস তাকে
ধাক্কা দেয়। সাইকেল সমেত
তাকে বোধহয় চিঁড়ে চ্যাপ্টা করে দেয়। কয়েক মিনিটেই সে দিকের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যায়। আমি গাড়িটা পরের আইল্যান্ডের কাছে
পার্কিং করে আসি। এসে দেখি দুমড়ে যাওয়া সাইকেলটা রাস্তার পাশে পড়ে। তুলিকে নিয়ে
তখন কোন গাড়ি হাসপাতালে চলে গেছে। লোক জনের জটলাও হালকা হয়েছে। তুলিকে কোন্
হাসপাতালে নিয়ে গেছে, তাও জানতে পারি না।
সারাদিন কাছাকাছি সব হাসপাতাল, নার্সিং-হোমে
ঘুরি। তুলির কোন হদিস পাই না।
তাই তুলিই যখন নেই,
চেকটা ব্যাঙ্কে জমা করতে মন সায় দেয় না। তাই ফেরৎ দিতে এসেছি।
আমার গলা আবার শুকিয়ে
কাঠ। আবার কয়েক ঢোঁক জল খাই। আমার জল পানের ফাঁকেই সুদীপ্ত বাবুর কথা ধেয়ে আসে। কথার মাঝে আমি কোন কথাই বলতে পারি
না।
-আমার কিন্তু অন্য রকম
মনে হচ্ছে। আপনি তুলিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে চড়া দামে কোথাও বেচে দিয়েছেন। আর এখন
চেক ফেরৎ দিয়ে সস্তা সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। ওই সব ঘাগুপনা আমার ঢের জানা আছে।
সব কিছু সত্যি করে বলুন। না হলে আমি এখুনি পুলিশে খবর দেব। কথাগুলো শুনে আমার
বুকের ভিতরটায় ফুসফুস আর হৃদপিণ্ডে টালমাটাল অবস্থা। মনে হচ্ছে, আমার জ্ঞান যেন লোপ
পাচ্ছে।হটাৎ কলিং
বেলের আওয়াজে যেন আবার আমার সম্বিৎ আসে।
“কে?” বলেই সুদীপ্ত বাবু
দরজার দিকে যান। বাইরে থেকে
উত্তর, ‘আমি তুলি।’ সুদীপ্ত বাবু দরজা খোলেন। তুলি ভিতরে আসে। আমি কি বলব, ভাষা খুঁজে হয়রান। তুলি
আমাকে দেখেই বলে, “তুমি এখানে?দুপুরে বাড়িতে খেতে যাওনি কেন? মা তোমার কথা ভেবে
অস্থির। মাকে তো একটা ফোনও কিনে দাওনি?
-সে না হয় বুঝলাম। তুমি
কোথায় ছিলে?
-তুমি বেলা এগারোটা
নাগাদ তিন নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে আসনি?
-কেন আসব? আমি তো মায়ের
কাছেই ছিলাম।
-সে কী! আমি তাহলে কি
দেখলাম। এতোটা ইলিউশন কি ভাবে হয়? বাইরে তোমার সাইকেল আছে?
-হ্যাঁ আছে।
-চল তো দেখি।
বাইরে এসে তুলির সাইকেল
দেখি। সাইকেলটা
মিলছে না। তাহলে কি তুলির মত অন্য কোন মেয়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল? আমি ক্রমশ কেমন
ঘোর লাগা হয়ে যাই।
এবার সুদীপ্ত বাবুর
প্রশ্ন, “কি হে, সব গল্পই গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে? তুমি কি করে গল্প লেখ বল তো? তাও
আবার লোকে পড়ে। আবার তোমার প্রেমেও পড়ে?” তুলি হেসে ওঠে। আমি মুখ নিচু ল্যাম্প
সেডের মতই দাঁড়িয়ে থাকি। নিজেকে কেমন অসহায় মনেহয়। আমি বলি, “দাদু, আপনার তুলি যখন
এসেছে, এবার আমি আসতে পারি?
-না এখনো, আপনার দাদু
ডাক শোনার যোগ্য হতে পারিনি। আর চেকটা নিয়ে যান। ওটা তো আর ফেরৎ নেওয়ার প্রশ্ন
নেই।
-আমাকে আপনি বলে আর
লজ্জা দেবেন না। চেকটা হাতে নিয়েই বলি, “আসছি দাদু।”
-আসছি বললেই হল? ‘দাদু’
ডাক শোনার ব্যবস্থাটা পাকা করতে দাও।
-সেটা আবার কি? আমার
প্রশ্নকে মস্করা মাখিয়ে তুলি বলে, “দাদু দ্যাখো, এমন করছে, যেন ভাজা মাছ উল্টে
খেতে জানে না। দাদু এই নাও কাগজ। আমি মায়ের কাছ থেকে অনেকটাই রেডি করে এনেছি।”
বলেই কাগজগুলো দাদুর হাতে দিল। আমি প্রশ্ন করি, “কিসের কাগজ?” তুলি আমার কথাকে
গ্রাহ্য না করেই দাদুকে বলে, “মা
দিয়েছে। বলেছে তুমি ফিলাপ করে দেবে।” সুদীপ্ত বাবু কাগজ দেখেই বলেন, “এতো ম্যারেজ
রেজিস্ট্রেশনের অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম। আর আমিও তো এক সেট এনেছি।” তুলি বলে, “যাক্ গে, তাড়াতাড়ি ফিলাপ করে
দাও। আমি ফটো তুলিয়ে এনেছি। রেডি করে অরূপের হাতেই পাঠিয়ে দেব।”
দৃশ্যপটের দ্রুত পরিবর্তন দেখে আমি ভীষণ
অবাক হচ্ছি। মুখ নিচু ল্যাম্প শেডের মতই মুখ নিচু দাঁড়িয়ে আছি। দাদু ফর্ম রেডি
করতে করতেই বলেন, “ভাই অরূপ, দাঁড়িয়ে কেন? বোস। তুলি, ভাইয়ের আমার সারাদিন বিস্তর
ধকল গেছে। আগে একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।” মুখে মুচকি হাসি মাখিয়ে তুলি বলে, “করছি
দাদু। তুমিও তো চা খাবে?”
-ওটা আবার আলাদা বলতে হয়
নাকি?খাবো। দুজনে একসাথেই চা খাবো।
কিচেনে ঢোকার আগেই ফ্রিজ থেকে এক প্লেট
মিষ্টি সাজিয়ে আমার সামনে তুলি রাখে। সাথে এক গ্লাস জল। দাদু বলেন, ‘মধুরেন
সমাপয়েৎ, নাও ভাই ওগুলো খেতে থাক। এখুনি চা এসে পড়বে।’ আমি মুখ নিচু করেই বসে।
মিষ্টিগুলোর উপর দৃষ্টি রেখে ভাবনা সাগরে সাঁতার দিচ্ছি। “কি হল? মিষ্টিগুলোর
ব্যবস্থা কর। তোমার ওই মুখ নিচু ল্যাম্প সেডের মত থাকাটা আর সাজে না। এই ফর্মে
বাকি সই সাবুদ করে তাড়াতাড়ি কোন ম্যারেজ রেজিস্ট্রেসন অফিসে জমা করবে। আর সামনে
রবিবার তোমার মায়ের কাছে যাবো। মনে থাকবে? চার হাত এক না হলে, তোমার ওই ইলিউশন
কাটবে না।” আমি প্রশ্নকরি, “ওটা কি সত্যি ইলিউশন ছিল?”
-একশ’ বার ছিল। জানো, তোমাদের
দিদাও আমার প্রেমিকা ছিল। বিয়ের আগে আমিও এমন দু’ তিনবার অসহায় অবস্থায় পড়েছিলাম। আমি
ওর কলেজ যাওয়ার পথে ওকে ফলো করতাম। একদিন পিছন থেকে মাথায় আলতো গাঁট্টা মেরে
বললাম, “এই যে ম্যাডাম, একটু পিছন ফিরে চাও।” যিনি পিছন ঘুরলেন তাঁকে দেখে চক্ষু ছানাবড়া। আর প্রতিক্রিয়াটা
নিশ্চয় অনুমান করছো? গালে থাপ্পড় পড়ে আর কী। “সরি, আমি ভেবে ছিলাম মিতা।” বলতেই
ভদ্র মহিলা বারুদ ভিজে গলায় বলেন, “আপনি সুদীপ্তদা, মানে মিতাদির ইয়ে......।” সেদিন অবশ্য ওই মিতা নামের জোরেই
উৎরে ছিলাম। নাহলে রাস্তায় কেৎরে পড়ে থাকতে হত। নাও মিষ্টিগুলো খাও তাড়াতাড়ি। বলেই দাদু হো হো করে হেসে ওঠেন। তখনিআমার
ইলিউশন প্রতিমা তুলি চা নিয়ে হাজির। আমি ভাবছি, আজকের সারা দিনের সব ঘটনাগুলো ইলিউশন নয় তো?
No comments:
Post a Comment