Wednesday 28 June 2017

গল্প

করোটির ছাদে গুলি

 চন্দন আনোয়ার
মিছিলের দিনক্ষণ পড়লেই শুরু হয়ে যাবে মোকাদ্দেস আলির বিধবা মায়ের কান্নাকাটি,  চিৎকার, চেঁচামেচি আর অছিয়ত-নছিয়ত! বাড়ির উঠোন ছেড়ে পা ফেললে বাতাস ফাটিয়ে বিলাপ চলবে। হাত-পা আছড়ে চোখ উল্টিয়ে মূর্ছা যায় যায় ভাব। ছেলের লাশের খাটিয়া বাড়ি থেকে বের করার সময়ও তার মা এমন করে ইনিয়ে-বিনিয়ে অভিনয় করে বিলাপ করে না। বিলাপ করবে তো মনের সুখে চুপচাপ কর্ না কেন? না, তা করবে না। করতে হবে ছেলেকে জাপটে-লেপ্টে, পথে ব্যারিকেড দিয়ে।
-মোকাদ্দেস আলি! ও মোকাদ্দেস আলি! বাপ তুই মিছিলে যাইস না রে! আমার কোলটা খালি করিস না রে! বাপ! ও বাপ! তোর পা টা ধরি, তোর মরা বাপের কিরা দিছি! বুকের দুধের কিরা দিলাম
এই একই বিলাপ, একই সংলাপ, চলছে ভাঙা রেকর্ডের মতো পাঁচ বছর ধরে। কাহাতক সহ্য হয়!
ধৈর্যের বাউন্ডারি অতিক্রম হয়ে গেলে মোকাদ্দেস আলি মুখ খোলে। তখন ওর মা, তার মা, তার মার মা এইরকম সিরিয়ালি ন্যূনতম আট-দশ পুরুষের নাম ধরে এমন সব বাক্যবাণ  ছুঁড়ে, মোকাদ্দেস আলির মা তখন মুখে শক্ত কুলুপ আঁটেমায়ের এই আদিখ্যেতার জন্যই হাইস্কুলে পড়া হল না। হয়বতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ ঘেঁষে মহাসড়ক, কোনদিন যে ট্রাক-বাসে মোকাদ্দেস আলি মাকোল খালি করে!
বছর পাঁচেক ব্যবসা-বাণিজ্যর কিছু ধান্ধাপানি চলে। সব ইস্তোফা দিয়ে এখন ইনকামের  শর্টকার্ট লাইন। পলিটিক্স। এই লাইনে এক টাকাও পুঁজি লাগে না।  লাভ আছে, লোকসান নেই। এক বছরে ভালই কামিয়েছে। ইউনিয়ন লিডার নিয়ামত হোসেনের নেক নজরে আছে। ফলে প্রতি মিছিলে অন্যদের একশো, খুবজোর দেড়শো, মোকাদ্দেস আলির পকেটে ইন করে পাঁচশো টাকার গোটা নোট।
নিয়ামত আদুরে কণ্ঠে বলে- আমার মকুই হানড্রেডে হানড্রেড পিওর! আর সব খানকির পোলার খালি ধান্ধাপানি! গলা দিয়া কাটা মুরগার লাহান আওয়াজ বাইর অ! মিছিলে মকুর গলাই হুনি খালি। মকু বাপের বেটা সাদ্দাম! শর্ট সাইজের হলে কী হবে, গলাডা ত্যাজি ষাঁড়ের মতন।
মকু নাকি আজাদ ভাইয়ের চোহে লাগছে? কথাটা সত্যিই নাকি নিয়ামত ভাই? ওয়ার্ড সভাপতি মিয়া হোসেন এই প্রশ্ন ছুঁড়ে মকুর দিকে ঈর্ষার চোখে তাকায়। নিয়ামত চোখ টিপে! এর অর্থ, বিষয়টা চেপে যা।
লিডারের মন মাতানো কথায় মকুর আধা-হাত বুক ফুলে দশহাত হয়ে গেল! তবে নিজের কাছেই কেমন গোলমাল ঠেকে! লিডার ওকে এত প্রিফার করে কেন? তার ভিতরের মতলবটা কী? রনজু, রহিম, লতিফ ওরা তো জোরেই চিল্লায় মিছিলে। বরং মকুই ওদের পিছনে পিছনে লচপচ হাঁটে, আবোল তাবোল চেঁচায়। পাঁচশো টাকার নোট বুক পকেটে। ঘোলাটে অন্ধকারের মধ্যেই টাকাটা পকেট থেকে বের করে। গন্ধ শুঁকে। জোরে শ্বাস টেনে সেই গন্ধ ভিতরে প্রবেশ করিয়ে ফুসফুসকে গোসল করায়। বিরাট এক প্রশান্তিতে যখন  বুঁদ হবে তখনই ছিঁচকাঁদুনে মায়ের ডিস্টার্বিং মাথা ফুঁড়ে মগজের বিন্যাসকে এলোমেলো করে ফেলে! মকু ভাবে-মার নাক বরাবর পাঁচশো টাকার নোটটা ছুঁড়ে বলবে, তোর জনমে, তোর বাপের জনমে, তার বাপের জনমে চৌদ্দজনমে একদিনে পাঁচশো টেকা রুজি করছে নি? খালি যে মরা কান্দা কান্দিস! কিন্তু বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে মাকে টাকা ছুঁড়ে দেবার কথা মাথা থেকে উধাও। শরীরের রক্ত বরফ হয়ে আসে। পা অবশ অবশ। টিমটিম করে বাতি জ্বলছে মার সিঁথানে। ফুটবলের মতো গোল হয়ে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা ঢুকিয়ে তিরতির করে কাঁপছে মা। আস্তে করে মকু হাত রাখে মার শরীরে। জ্বরের আঁচ।  শূন্যঘরে বুঝি কাতরাতে কাতরাতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ভাতের হাঁড়ি উপুড় হয়ে মুখগুঁজে আছে, কিছুটা দূরে চাল মাপনি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চাল।  
মকুর চেঁচাতে ইচ্ছে করছে-মা, তুই মরবিই! তোর খাজিলতের কারণেই তুই মরবি! কেরে? বাজারে কাউরে দিয়া খবর দিতে পারলি না। এত জিদ কেরে? আমি কি বাজারে রঙ-তামাশা করি নাকি? দুইটা টাকা রুজির ধান্ধাই তো করি।  
না, এসব কথা এখন কি ভাববার সময়! নিজের উপরেই বিরক্তিতে হিস করে ওঠে মকু। চুল ছিঁড়ে। ভাবে- শালা মকবুল ডাক্তার যে জনম আইলসা, সে কি এত রাতে আইতে চাইবো। পকেটের পাঁচশো টাকার নোট হাতায়। শালার ডাক্তারের নাকেমুখে ছুঁড়ে দিবো পাঁচশো টাকার নোট! দেখবে, মোখলেস আলির ব্যাটা মোকাদ্দেস আলির কী পাওয়ার! এখন আবার বাপ সমুন্দির কথা মনে পড়ল কেন? মকুর অস্থিরতা বাড়ে। সমুন্দি মরে গিয়েই আমার কপালে এই লড়োদাস! নইলে, থানা সভাপতি আজাদ ভাইয়ের মতো একদিন বড়ো লিডার হবার স্বপ্ন দেখতে পারত মকু। তখন নিয়ামত-ফিয়ামত ভাই ভাই করে পিছনে ঘুরত লেউরার মতো। গলাকাটা স্বপ্নটা মকুর চোখে ভাসে। কে যেন মাথাটা নিয়া চম্পট দিলে! এসব ভাবতে ভাবতে মকবুল ডাক্তারের উঠানে যেই না পা ফেলছে অমনি তিনটা কুকুর সমস্বরে মিছিল করে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে আসছে। তাড়া খেয়ে পিছনে ফিরে মকু। এখন উপায়! ডাক্তার সমুন্দি তো মানুষ খারাপ! বাড়িতে তিনটা কুকুর পোষে! তবে নতুন একটা আইডিয়া জন্ম নিল মকুর মাথায়। কুকুরের গলার যা তেজ, আর দাঁতে যা শক্তি, অপজিশনকে ঘায়েল করার জন্য মিছিলের সামনে বিশ-পঁচিশটা কুকুর রাখলে কেমন হয়! অবশ্য শহরের কুকুর দিয়ে এ কাজ হবে না। কেননা, শহরের মানুষের মতোই কুকুরও গায়েগতরে নাদুসনুদুস। আরামপ্রিয়। অন্যদিকে দেখো, না খেয়ে না খেয়ে দিনে দিনে বাঘের মতোই শরীরে হিংস্র শক্তি জোগাড় করেছে গ্রামের কুকুরগুলো! বুকে থু ফু দিয়ে আল্লা-রসুলের নাম নিয়ে পা টিপে টিপে এগোয় মকু। কুকুরেরা ছুটে আসে না আর, শুয়ে থেকেই নিস্তেজ কণ্ঠে পালন করে চলছে পুলিশি দায়িত্ব। মোটের উপরে মকুকে দয়াই দেখাচ্ছে ওরা। ঘরের শেকল নাড়ে মকু। মানুষের সাড়াশব্দ পায় না। কানে আসছে  ডাক্তারের নাক ডাকার গরর গরর শব্দ। মকু ভাবে, ও সমুন্দির নাক সমিল হয়ে গেল নাকি! কেমন গরর গরর শব্দ করে নাক ডাকছে। ফের জোরে শেকল টানে।
ডাক্তার ঘুমকাতর কণ্ঠে বলে- ঐ কে?  
মকু ভাঙাচোরা কণ্ঠে বলে- আমি, ডাক্তার ভাই। মোকাদ্দেস।
ডাক্তার বলে- সক্কালে আইস, ঘুমের ডিস্টার্ব দিছ্ না।  
মকু কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ করে বলে- ডাক্তার ভাই, আমার খুব বিপদ। মায়ের দাঁতি লাগছে। একটু উঠেন।
চোখ বুঁজেই মাছ ধরার মতো হাতড়িয়ে দরজা খোলে ডাক্তার। ভীষণ বিরক্তি কাঁচা ঘুমভাঙা শরীরে। ঘুমের মাথা ঝাঁকিয়ে মকুকে নয়, কুকুরদের উদ্দেশ্য করে বলে- হালার পুতেরার শরীলে তেল জমছে! রাইতে বেরাইতে কোনো ডিউটিই পালন করে না। এরপর মকুর উদ্দেশ্যে বলে, এত রাইতে আমারে ডাকতে আইছিস! ভিজিট দিতে পারবি?
মকু মাথা দোলায়।
আমার রাইতের ভিজিট পাঁচশো-দরজা বন্ধ করতে এক পাট টানে ডাক্তার।
মকু ত্রস্ত কণ্ঠে বলে- তাই দিবো। আপনে চলেন। মায়ের দাঁতে খিল লাগছে। তিরতির করে কাঁপছে।
দরজার দ্বিতীয় পাট টানতে টানতে ডাক্তার বলে- তোর বাপে দেখছে নি পাঁচশো টাকা!
বুক পকেটে হাত চালিয়ে পাঁচশো টাকার নোট বের করে ডাক্তারের চোখ বরাবর ধরে মকু। বলে, এই নেন পাঁচশো টাকা।
জ্বীন ছাড়ার মতো শরীর কাঁপুনি দিয়ে ঘুম পালায় ডাক্তারের চোখ হতে। পড়িমরি করে অন্ধকার ঘরে হুলস্থূল বাঁধিয়ে দিল। নিদ্রাপ্রিয় শয্যাসঙ্গিনী হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে ওঠে-তোমার খাসলত গেল না! দুইটা পয়সার লোভে রাত-বিরাতে ঘরের বাইরে যাও। সিঁথান থেকে টর্চ আনতে গিয়ে আধা-জাগরণে বিলাপরত মেয়েমানুষটাকে কানে কানে শোনায়-পাঁচশো! পাঁচশো!!
মকু ভাবে-শালার টাকার কী পাওয়ার রে! মনটা কষ্টে কষা হয়ে ওঠে। কালকের মিছিলটা গেল ফাউ ফাউ। দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে, মাকে এভাবে ফেলে মিছিলে কী করে যায়? কে আছে আর যে দেখবে। সমুন্দির বাপটা মরে কী যে প্যাঁচকলে আছি!
ডাক্তারের ধ্যাবড়া পায়ের চটিজোড়ার সাপাট সাপাট শব্দ মকুর বিরক্তি জন্মায়। শালা এক নম্বর কুঞ্জুস! এ যুগে ফকিরফাল্লাও তো চটি পরে না। বলবে ভাবে, টাকা পয়সা নিয়া কব্বরে যাবা নাকি ডাক্তার? বলা হয় না। বলে, মা কি এই যাত্রায় বাঁচবেই না নাকি ? ডাক্তার যেন কী বলে। চটিজোড়ার শব্দে ক্লিয়ার শুনা যায় না।


ঘরের বাতিটা আর জ্বালা নেই। অশুভচিন্তা মকুর মগজের প্রবেশ পথে বাধা খেল ঘর থেকে আগত হু হু শব্দে। মকু ডাকে, মা, এই মা। অন্ধকারেই হাতড়ে দিয়াশলাই খুঁজে নিয়ে বাতি জ্বালায়। মা এখন বেদম কাঁপছে। বুক-পিঠ উদোম, নিচের দিকে কাপড় হাঁটুর উপরে, পাতলা নোনাধরা সাদা কটা চুলে জালের মতো মুখ ঢাকা। ওর অনুপস্থিত সময়ে পানি খেতে উঠার চেষ্টা করে যে ব্যর্থ হয়েছে তার প্রমাণ গ্লাসটা এখনো গড়াগড়ি খাচ্ছে। চাপা ঠোঁটে ঢেউতোলা কাঁপন। মকু ডাকে, মা, এই মা, দেখ তোর লাইগা ডাক্তার আনছি। উঠার কোন সম্ভাবনা না দেখে নিজেই মায়ের বুকে-পিঠে কাপড় বিছিয়ে, হাঁটুর উপর থেকে পায়ের পাতা পর্যমত্ম টেনে ডাক্তারকে ডাকল।
রোগীর ডান হাত ধরে ডাক্তার বলে, মকু তোর মায়ের কিছুই হয়নি রে। স্রেফ জ্বর। তড়াক করে তিনটা প্যারাসিটামল দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, দে মকু, ভিজিট দে। মকু কাঁচুমাচু করে। বারুদের ন্যায় জ্বলে ওঠে ডাক্তার, এইজন্যেই তোদের মতন গরীব-কাঙালদের কলে আমি আসতে চায় না। মকুর ভিতরেও জ্বলে ওঠে বারুদের দ্বিগুণ আগুন-সমুন্দির ডাকাত! তিনটা প্যারাসিটামল দিয়া হাতিয়ে নিবা পাঁচশো টাকা। শক্ত হয়ে বাঁশের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ মকুর বুক পকেটে হাত চালিয়ে পাঁচশো টাকার নোট বের করে লাফিয়ে ঘর হতে বেরিয়ে গেল ডাক্তার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই উঠোনের সীমানা অতিক্রম করে রাস্তায় এখন। মকু ভাবে, ডাকাত ডাকাত বলে চিল্লাবে নাকি? তাড়া করবে নাকি? আরো একটু বড়ো হলে মকু সত্যিই তাড়া করতে পারত।
মা চোখ মেলে। তবে সে চোখে নোনাজলের জাফরি কাটা পর্দা। কিন্তু দেখো, ছেলের চোখ একেবারে খটখটে, জলশূন্য। মকু কাঁদো কাঁদো ভাব করতে গেলে ভিতর থেকে সাপোর্ট পায় না। ফলে সে চেষ্টা আর করে না। স্রেফ জ্বর। সুতরাং বাজে চিন্তাও মাথায় নেই। ফুরফুরে মেজাজে ডাকে- মা, এই মা, উঠতো রে। ভাত তো রাঁধলি না। চিড়া-মুড়ি কিছু খেয়ে ওষুধ খা। হাত ধরতেই হেঁচকা টানে!
মকু এবার বিপরীতটা ভাবে-জ্বর-ফর কিছুই না! আসলে মার মনে ঢুকছে শয়তানি! মিছিলে যেতে দিবে না। মার কয়টা স্পাই আছে। মিছিলের ডেট ফিক্সট হলে, আগেভাগেই কানে তুলে। আর তখন শুরু হয় নাটকের রিহার্সেল।
টিনের কৌটা খুলে কিছু চিড়া ও দুই টুকরো খেঁজুরের গুড় বাটিতে করে মায়ের সামনে ধরে মকু। বলে-আমি কি চুরি-ডাকাতি করতে যাই নাকি? মিছিলের দিন পড়লেই এমন নাটক করিস! এবার এম পি হইবো যে, হেই থাকবো কালকার মিছিলের সামনে। আমি মোকলেস আলির ব্যাটা মোকাদ্দেস আলি থাকলেই যতো দোষ, অ্যাঁ!
হাত-পা ছুঁড়ে উঠে বসেই মকুর হাত চেপে ধরে মা। বলে- তুই আমার একটা পুত! হাতের লাডি। বাপ তুই মিছিলে যাইস না! আমরা গরীব মাইনসের এইতা করে পেট ভরতো না?
বিকট শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে করছে মকুর! আপাত একটা টক-মিষ্টি হাসি দিল। সেই হাসির প্রতিধ্বনি থই থই করছে ঘরময়। নোনাজলের পর্দা পড়া মায়ের চোখ বুঁজে আসে ছেলের এমন উপহাসে। মকু মনে মনে বলে- মা, এই লাইনে যে কত্তটাকা! তুই যদি আন্দাজ করতে পারতি! নিজের উপরে ভীষণ বিরক্তিতে হিস্ করে ওঠে। এখন পাঁচশো টাকার নোটটা যদি মার নাক সোজা ধরতে পারত তাইলে চিরদিনের জন্য মুখ বন্ধ করা যেত। খানকির বাচ্চা ডাক্তার! তোর গুষ্টি ঠাপাইয়া ছাড়ব। দিন আসুক।


সকালের নাস্তার জন্যে অপেক্ষা করে না মকু। কিছুক্ষণ পরেই শহর কাঁপিয়ে যে মিছিল বেরোবে, সেই মিছিলের নেতৃত্বে থাকবে যে আজাদ ভাই, তার ডানে থাকবে নিয়ামত ভাই, বামে থাকবে থানা সেক্রেটারি হাফিজ ভাই, এদের ঠিক পিছনেই থাকবে মকু। মায়ের এইসব ছোটখাট অসুখের অজুহাতে দেরি করলে চলে! কাকডাকা ভোরেই ঘুম ভাঙে। বিছানায় শুয়েই মিছিলের পরিকল্পনার কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখে। রাতেই বালিশের নিচে ভাঁজ করে রেখেছিল কটকটে লাল রঙের ডানাকাটা গেঞ্জি, যাতে নৃত্যরত মাইকেল জেকসনের ছবি বুকে, পিঠে লেখা ২০০০, এবং ছাইরঙের জিন্সের প্যান্ট। সেগুলো বের করে ঝটপট শরীরে চাপিয়ে আর অপেক্ষা করে না। মসজিদের কল হতে এক আঁজলা পানি ছিটাল চোখে-মুখে। ফাঁকা দেখে রাস্তার ধারেই এক জায়গায় প্যান্টের চেইন খুলে মুতে নিল। হাটে পা ফেলতেই নিয়ামতের কড়া ধমক-এই ছেমড়া, এতো লেট! এই করে লিডার হবে উনি!
মকু শ্লেষ্মাঘন কণ্ঠে বলে- মা কান্দে!
তোর মা ধাড়ি মাগিটার এই তো কাম! খালি কান্দা!
রাইতে মা আমারে ধইরা কাঁনছে!
ধ্যাত! ঘ্যানঘ্যন করিস না তো? আমারে যে বাপে ত্যাজ্য করছে। তো আমি এই লাইনে আইসা সাইন করছি না। এখন তো বাপ সমুন্দি আমারে লইয়া অহংকার করে! তুইও সাইন করলে তোর মা ঘোড়ার মতন লাফাইবো সুখের চোটে। আর শোন, এই লাইনে সাইন করতে বেশিদিন লাগে না। তোর বয়স কত? ষোল-ফোল হবে। দেখবি, বিশ বছর হতে না হতেই থানার কোন পদ পাবি। আজকেই তোর মোক্ষম চান্স। এরপর একশো টাকার নোট মকুর পকেটে গুঁজে দিয়ে বলে, নে তোরে ছয়শো দিলাম। ওরা দুইশো করে পাইছে।
তিন কিলোমিটার ভ্যানে চড়ে যেখানে এসে বরাবরই মকুরা মিছিলের জন্য জড়ো হয় আজ সেখানে নয়। সরাসরি থানা সভাপতি আজাদের বাসায় চলছে মিছিলের প্রস্তুতিমকুর ভয় ভয় ঠেকে। পরিবেশটাই কেমন থমথমে। কয়েকজন প্লেকার্ড বুঝে নিচ্ছে। বিচিত্র স্লোগান লেখা প্লেকার্ডেযেমন, . আজাদ ভাইকে নমিনেশন দিতেই হবে! . আজাদ ভাইয়ের চরিত্র গোলাপের মতো পবিত্র! . আজাদ ভাইয়ের দুই নয়ন এলাকার উন্নয়ন! . আজাদ ভাই চায় কি, দেশ ও দশের শান্তি! এই সব স্লোগানই মিছিলে দিতে হবে। আগেভাগেই মুখস্থের কাজটা সেরে নিচ্ছে মকু। পড়তে পড়তে হঠাৎ লক্ষ্য করে ইটের খোয়া ভর্তি গোটা দশেক বস্তা সারি সারি সাজানো, পাশেই ঝালর চুলের রাগী ধাঁচের চারজন যুবক চারটে পিস্তল হাতে নিয়ে দামি সিগারেটের মতো নাড়াচাড়া করছে। মকু ঢেকুর গিলে ভয়ে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। প্লেকার্ডের স্লোগান পড়বে বলে চোখ উল্টিয়ে তাকাতেই দেখে, স্লোগানগুলো মুছে ফকফকা সাদা! কাঠপেন্সিলে আঁকা ছবির মতন একটি ছবি প্রত্যেকটি প্লেকার্ডে ঈদের চাঁদের মতো বাঁকা হয়ে আছে। মকু চোখ কচলায়। ছবিটাকে ক্লিয়ার দেখতে চেষ্টা করে। কিছুতেই ছবির মানুষটা পুরো আকৃতি নিয়ে ধরা দিচ্ছে না। চোখের ভিতর দিয়ে ঢুকে ছবিটা ঠাঁই করে নিয়েছে মগজে। তখনই সে স্পষ্ট দেখতে পায়, একজন মেয়েমানুষের বড়ো বড়ো খয়েরি চোখজোড়া থেকে টপটপ করে গুটি আমের মতো জলের ফোটা পড়ছে! মকু ভাবে, মেয়েমানুষটা কে হবে! তার এতো দুঃখ! পিছন থেকে নিয়ামত কাঁধ ঝাঁকায়, কিরে মকু, ধন্ধের মতন খাড়ায়া কী দেখিসমকুর সম্বিৎ ফেরে। প্লেকার্ডের লেখা স্লোগানগুলো ক্লিয়ার দেখে এখন। নিয়ামত বলে, চল, আজাদ ভাই তোরে ডাকছে। 

মকু বলে- কারে? আমারে? আমার ভয় ঠেকছে যে!
নিয়ামত হাসে-তোর কিসের ভয় রে! তোর তো ফাটা কপাল! যে পজিশনে ফিট করে দিছি তোরে, কতজনে মাথা কূটেও পায় না। আজাদ ভাইয়ের নজর লাগছে! তুই তো রাতারাতি নেতা রে!
কৃতজ্ঞতার চোখে তাকায় মকু। থানা সেক্রেটারির সবচেয়ে কাছের লোক নিয়ামত ভাই। তাই এই পজিশন পেল মকু।
আজাদ ভাইয়ের সিকিউরিটির প্রধান দায়িত্বই এখন মকুর। ফলে ওর দিকে চোখ সকলের। মকুও সিনা উঁচিয়ে পূর্ণ পুরুষের মতো সামান্য বাঁকা হয়ে স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে ধোয়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিচ্ছে। বেনসন সিগারেট এই প্রথম মকুর ঠোঁটে। আজাদ ভাইয়ের কাছ থেকে উঠে আসার সময় বলে, মকু এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে যা। রক্ত চাঙা কর। আজাদ ভাইয়ের মতন ভালো মানুষও আছে এই লাইনে! মকুর মনে পড়ে, একটা নাসির বিড়ি চুরির অপরাধে কী পিটানোটাই পিটিয়েছিল বাপে! পিঠের নোনাছাল তুলে দিয়েছিল। বেঁচে থাকলে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট নাকেচোখে ছুঁড়ে দিত। হঠাৎ কেঁপে ওঠে মকু। পিছন থেকে কাঁধে ভারি হাত পড়ে। চমকে পিছন ফিরে দেখে আজাদ ভাই। মকুর ঠোঁট থেকে ছিটকে পড়ে জ্বলন্ত সিগারেট! বিষম খেয়ে খুক্ খুক্ করে ওঠে।

কিরে, রেডি তো? এই নে, দুইটা দুই পকেটে ঢোকা। ওদের মিছিল মুখোমুখি হলেই পর পর দুইটাই ছুঁড়বি।
আজাদ ভাই বিসমিলস্নাহ বলে নিয়ামতকে ইশারা করে। নিয়ামত গলা চড়িয়ে প্রথম স্লোগান ধরে-লও লও লও সালাম, আজাদ ভাইয়ের লও সালাম। খুব দ্রুত মিছিল শহরের বড়ো রাস্তায় ওঠে। মুহূর্মুহূ হাততালি, অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকার, হই-হুল্লোড়ে জমজমাট মিছিল। স্লোগানের ভাষা ক্রমেই বিধ্বংসী হয়ে উঠছে। মিছিলকারিরা ভয়ানক মারমুখী। আপাত প্রতিপক্ষ সামনে নেই। তবে কয়েকটা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে, কিছু টায়ার রাস্তায় পুড়িয়ে, আর কিছু গাড়ির গ্লাস ভাঙচুর করে আজাদ ভাইয়ের নমিনেশনের পথ পরিষ্কার করে! শহরে হুলস্থূল আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দোকানপাট, মার্কেটে ফটাফট সাটার পড়ছে দড়াম দড়াম করে। যে যার মতো সেফ জায়গায় দৌড়াচ্ছে।

মকু বরাবরই আজাদ ভাইয়ের পিছনে আছে। এবং তার ইশারার অপেক্ষায়শহর ঘুরে মিছিল জিরোপয়েন্টে আসতেই হঠাৎ কী যে ঘটল! বিশৃঙ্খল হয়ে ভেঙে গেল মিছিল। শুরু হল হুড়োহুড়ি। দৌড়াদৌড়ি। মকু লক্ষ্য করে, আজাদ ভাই চোখের পলকে নাই হয়ে গেছে। কালো পোষাকের র‍্যাব ঘেরাও করে নিয়েছে মকুসহ আরো কয়েকজনকে। নিয়ামত ভাই বলে যে চিৎকার দিবে, সেও জান নিয়ে উধাও! মকু পকেটে হাত রাখে। ভাবে, ছুঁড়বে নাকি? কিন্তু কোনদিকে ছুঁড়বে ভাবতে ভাবতেই পেছন থেকে খপ্ করে শক্তহাতে ঘাড় টিপে ধরেছে। পিকআপ ভ্যানে উঠিয়েছে পাছায় লাথি চালাতে চালাতেথানার বারান্দায় নিয়ে ফুটবলের মতো কিক মারতে মারতে অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে দিল।



 মকুর সহযোদ্ধাদের ছেড়ে দিল ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে। মকুকে ছাড়বে না। ককটেলসহ কোর্টে চালান দেবে। মকুর ভিতরটা ত্রাসে কাঁপে। মা যদি শুনে, তার মোকাদ্দেস আলি এখন থানায়! ঠাঁই মরে যাবে!
ডোবা মানুষের মতো এক অদৃশ্য অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে মকুর শরীর। কিন্তু সবটুকু ডোবার আগেই দেখে, আজাদ ভাই জানালার গ্রিল ধরে মিটমিট করে হাসছে! পিছনে থানা সেক্রেটারি হাফিজ। কি রে মকু ভয় পাইলি নাকি? আজাদ ভাই হা হা করে হেসে ওঠে। নতুন আইছিস তো!
মকু বিব্রত চোরের মতো এক পা এক পা করে সামনে এসে লোহার শিক ধরে দাঁড়ায়।

আরে এইসব তো আমাদের শ্বশুর বাড়ি রে পাগল! ত্রিশ বছরের পলিটিক্সের লাইফে ত্রিশ দুগুণে ষাটবার শ্বশুর বাড়ি আইছি আর গেছি। তুই আমার ছোট ভাই না! চল, একসাথে খাবো দুই ভাই। তোর ভাবি তোর জন্য গরম ভাত রেঁধে বসে আছে।
আজাদ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে ওঠে মকু। মানুষ নাকি ফেরেস্তা!  এমন আপন করে মকুকে কেউ বুকে টানেনি। বাপটাকে ভালো করে চেনার আগেই দুনিয়া ছাড়ল। মায়ের তো চোখের জলই ফুরোয় না, ছেলেকে ভালবাসবে কখন।

আজাদ ভাইয়ের পায়ে ছালাম করবে বলে ধনুকের মতো বাঁকা হতেই মকুকে বুকে টেনে নিল। মনের লজ্জায় করুণভাবে হাসে মকু, কি সব আবোলতাবোল না ভেবেছে এই দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে। একজন পুলিশ এসে আজাদ ভাইকে সালাম করে মকুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে- মকু ভাই, কিছু মনে কইরেন না। এইসব ধরপাকড় কিছু করতে হয়, পাবলিকের সার্ভেন্ট বলে কথা। মকুর আফসোস হয়, ইস্, মা যদি দেখতো এই সব।
ডাইনিং টেবিলের বাহারি সাজ, থরেথরে সাজানো তিন আইটেমের মাংসের তরকারি, সবজি, ভর্তা, ডাল, লাল টকটকে টমেটোর সালাদ, ধবধবে সাদা চিকন ভাত, আজাদ ভাই নিজের হাতে তরকারি তুলে দেওয়া, তার স্ত্রীর সোহাগী কথাবার্তা, মাখো মাখো ভাব ইত্যাদি মকুর তামাটে মুখের শিরাগুলোতে নিঃশব্দ কাঁপুন জাগায়। ভাত খেতে খেতেই আজাদ ভাই বলে-মকু শোন্, পলিটিক্সে সিক্রেট বলে একটা কথা আছে। খবরদার, কখনই সিক্রেট ফাঁস করবি না। তাইলে তোর বিপদ, সাথে আমারও। দলের কিন্তু কিছুই হবে না। চিলের মতো  ছোঁ মেরে তোরে ফেলে দিয়ে আসবে বঙ্গোপসাগরে। শুনিস নি, দলের মহাসচিবকে বিনা নোটিশেই দল থেকে বাইর করে দিছে। এখন তার কী দাম, আম-আঁটি সবই গেল ! তাই, বুঝেশুনে পা ফেলবি। এই লাইনটা হলো সিঁড়ির মতন। উপরে উঠতে হলে সামনের জনকে ধাক্কা দিয়ে উঠতে হয়। পিছনের সবকিছু ভুলে যেতে হয়। পা ফস্কে গেলে খেল্ খতম
মকুর বিস্ময় আক্রান্ত কালো চোখে জিজ্ঞাসার রেখা-উপরেখাগুলো ফুলে উঠেছে। হাতের মুঠোতে ভাত চিপসে হয়ে শুকিয়ে আসে, আজাদ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে। মানুষটা কী চায় মকুর কাছে! কেমন ধন্ধে পড়ে সে। ভারি ভারি দার্শনিক কথা মকুর মগজে অনুপ্রবেশ না ঘটলেও তাকে নিয়ে যে অনেক ভাবছে, অনেক পরিকল্পনা, এইটুকু বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু, মকুর ফাইভ পাস বুদ্ধিতে পলিটিক্সের এইসব শক্ত শক্ত আইডিয়ার চাষবাষ চলে কী করে! কালো, ঋজু ও দীর্ঘদেহি শান্ত পুরুষ আজাদ ভাই মকুকে প্রলুব্ধ করে ভীষণভাবে। তার প্রতিটা বাক্যই মকুর পলিটিক্সের সিঁড়ি ভাঙার রসদ ভেবে সে নিজেও মগজের মেমোরিতে সেভ করে নিচ্ছে। পলিটিক্স মানে সিঁড়ি ভাঙার খেলা! বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আশা-নিরাশার খেলা! লাভ-লোভের, হিংসা-প্রতিহিংসার খেলাডিগবাজি খেলা! খেলা! মানুষ নিয়ে খেলা!
মকু কী ভাবছিস রে! আজাদ ভাই নিস্তেজ কণ্ঠে বলে।
মকু বিষম খেল! ব্যাকুল ও দ্রুত হাতে পানির গ্লাস ধরতে গেলে উপুড় হয়ে পড়ে গেল নিচে। গ্লাস দুই টুকরো হয়ে গেল। মকুর বুকের ভিতরে চড়াৎ করে ওঠে। ভয়ের মাতাল সমীরণ বেপরোয়া হয়ে আরো বেড়ে গেল বিষম।

আজাদ ভাই পিঠ চাপড়ায়। তোরে কেউ মনে করছে মকু রে!

কে সে? মকুর এই ভরা সুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে দূর থেকে! কাছেপিঠে হাতড়ে দুইজনকে পায়, এক, নিয়ামত ভাই, দুই, মা। কিন্তু নিয়ামত ভাই আজ যে বেঈমানিটা করল তাতে তার মনে করায় বিষম খাওয়ার কথা না। বাকি থাকে মা। সেই-ই এই কাজ করছে। মা হয়ে ছেলের সর্বনাশ করছে!
ড্রয়িংরুমের সোফায় শরীর হেলিয়ে আয়েশি হাই তোলে মকু। ভাবে, বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে। বাড়ির কথা ভাবতেই ভিতর হতে বন্ধ হয়ে আসে দম।  নিয়ামত ভাই যদি গ্রামে রাষ্ট্র করে দেয় পুলিশে ধরার খবরটা। তাইলে মা তো এতক্ষণে ফিট! শালা বেঈমান! বিড়বিড় করে গালি দিল নিয়ামতকে। পর্দা নাড়িয়ে আজাদ ভাই ঘরে ঢোকে। কি রে মকু, বিড়বিড় করে কাকে গালি দিচ্ছিস। মকু লজ্জায় শামুকের মতো গুটিয়ে আসে।

এই নে, বলে একটা নকিয়া মোবাইল ও পেপারে মোড়ানো একটা পিস্তল মকুর হাতে তুলে দিল আজাদ ভাই। বলে- তোরে যেভাবে নিয়ামত ফালাইয়া গেল তাতে ভরসা পাচ্ছি না। তোর নিজের সিকিউরিটির জন্যে কাছে রাখবি সবসময়। একদম নতুন। একটা গুলিও খরচা হয়নি। তোর খরচাপাতির লাগি আপাত এই এক হাজার টাকা নে। কাজ চাই কিন্তু! কাজ!


উজানখলসির বাজারে এসে মকুর পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা। খুচরো অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের পথে-প্রান্তরেভ্যান থেকে বাজারে নেমেই দেখে, নিয়ামত, আরো তিনজন চেলাচ্যামড়াসহ দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে। মকুর মাথায় রক্ত ওঠে। -শালা! তুমি দাঁত বাইর কইরা কেলাচ্ছো, অ্যা! আমারে বিপদে ফালাইয়া চলে আইছো! পকেটের পিস্তলে হাত রেখে বলে, নিয়ামত ভাই কখন আইলেন?
নিয়ামত বলে- তোরে খুঁজে না পাইয়া...
মকু বাম হাত উঁচিয়ে কথা থামিয়ে বলে- থাক! এই কথা আমি শুনতে চাই না। গেলাম এক লগে, ফিরলাম আলাদা, কাজটা ভাল্লাগল না। প্রতি উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না মকু।
উঠোনে পা ফেলেই মকুর কেমন খটকা লাগে! মা বুঝি অভিমান করে ঘরে তালা ঝুলিয়ে ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। দুনিয়াজুড়ে তার এই একটাই উঠা-বসার জায়গা।
পেচ্ছাবের বেগ চাপায় প্রস্রাবখানায় গিয়েই চিৎকার দিয়ে ওঠে মকু। প্রস্রাবের স্লাবের উপরেই লগির মতো লম্বা হয়ে পড়ে আছে মা!

কোলমাজা করে ঘরে আনতে গিয়ে মকু টের পায় জ্বরে আগুন জ্বলছে মার শরীরে। ঘরে শুইয়ে রেখে পড়িমরি করে মকবুল ডাক্তারের উঠোনে গিয়ে হাজির হল। বেদম জোরে হাঁপাচ্ছে আর ডাকছে, ডাক্তার, এই ডাক্তার। মকবুল ডাক্তার রুষ্টমূর্তি নিয়ে বেরোয়। মকু বলে-ডাক্তার ভাই, আমার মা বাঁচবে না। চলেন জলদি। আজকেও পাঁচশোই দিবো! তবু চলেন, চটজলদি। মকবুল ডাক্তার থ মেরে দাঁড়িয়ে কী যেন ভেবে বলে, কালকের মতন কেওয়াজ করবি না তো? মকু হাঁপাতে হাঁপাতেই অসম্মতির মাথা নাড়ে।

ডাক্তার রোগীর কপালে একবার হাত রেখেই বলে-ও কিছু না। জ্বর একটু বাড়ছে। প্যারাসিটামলের লগে এন্টিবায়োটিক দিতে হবে। ছয় তালি দেওয়া কালোকিষ্টি একটা কাপড়ের ব্যাগ থেকে অনেকগুলো কাটা-খুচরো বড়ি থেকে খুঁজে দুই প্যারাসিটামল ও দুই এন্টিবায়োটিক মকুর হাতে দিয়ে ডাক্তার বলল, এখন খাওয়া দুইটা, সকালে বাকি দুইটা। দে, ভিজিট দে।
কতো? এক এক দুই আর চার চার আট মোট দশ টাকা বড়ির। আর ভিজিট? মকু হু করে হেসে ওঠে।
গলাকাটা গরুর মতো ধড়ফড়িয়ে ওঠে ডাক্তার---শয়তানির জায়গা পাও না, মকবুল ডাক্তারের লগে শয়তানি। বলে মকুর প্যান্টের পকেটে হাত চালায় ডাক্তার। যেন বিষসাপে কামড় দিয়েছে হাতে, এমন করে হাত টানে। মকু চোখ নাচিয়ে হাসে।
পকেটে কী রে মোকাদ্দেস? ডাক্তারের ভয়মিশ্রিত কণ্ঠ।
মকু গুমরে গুমরে হাসে। শালার ডাকাত! এইবার জাতে আইছো। খুক খুক করে গলা পরিষ্কার করে বলে, আজাদ ভাইয়ে দিছে।
আজাদ ভাইয়ের রেফারেন্সে ডাক্তার ঢেকুর গিলে- অ্যা!
রাইত বারোটা-সাড়ে বারোটার দিকে মাকে একবার দেইখা যাবেন। এই বলে মকু দশ টাকার একটি নোট ডাক্তারের পকেটে পুরে দিয়ে ধাক্কা মারে! বলে, এখন বাড়ি যান।
রাজনীতিতে নামার পর থেকে মকুর চায়ের অভ্যাস। বিড়ি টানার অভ্যাস অবশ্য আরো আগের। সকালে মিজানের চা স্টলের এক কাপ গরম লাল চা না পেটে দিলে শরীর কেমন টালমাটাল খায়। ছোটখাটো রাজনীতির আলাপ এই চা স্টলেই চলে। ওদের দলের চা স্টল হিসেবে পরিচিত। এখানে বসে থানা সভাপতি আজাদ ভাই পর্যন্ত পার্টির মিটিং করেছে। রাতে মাকে নিয়ে অনেক ঝুক্কিঝামেলা আর সারাদিনের ধকলে মকুর শরীর বিছানায় লুটিয়ে পড়ে রাত দশটার মধ্যেই। এরিমধ্যে ডাক্তার রাইত বারোটা না বাজতেই ডেকে ঘুম ভাঙায়েছে একবার। ইসব কারণে মকুর উঠতে উঠতে সকাল নয়টা। ঘুম থেকে উঠেই দেখে, ডাক্তার রোগীর জ্বর মাপছে! মকুকে দেখেই বত্রিশ দাঁত বের করে হাসে-মোকাদ্দেস তোমার মার তো জ্বর নাই বললেই চলে। মকুর পেটে হাসি ইঁদুরের মতো দৌড়ে বেড়াতে লাগল। সমুন্দির ডাক্তার! তোমারে আমি চিনি না। কি মতলবে যে এত সকালে মার জ্বর মাপছো বিনা পয়সায়! মকুর সব আন্দাজকে বাইপাশ করে ডাক্তার এমন এক আবদার করে বসে, মকু নিজেই টাসকি খেয়ে নির্বোধের মতো চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে-তার ছেলের পুলিশের চাকুরির জন্যে আজাদ ভাইকে শুধু বললেই কাজ হবে। টাকা দুই লাখ দিবে! চাইলে আরো দিবে। মকু ফিট হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলে- দেখি। 
মিজানের চা স্টলে জমজমাট আড্ডা চলছে। মিছিলের বিচার বিশ্লেষণ চলছে। নিয়ামতের পকেট গরম। যে যা চাচ্ছে তাই অর্ডার করছে। গরম চায়ের উত্তাপ ছড়িয়ে নিয়ামত এর ওর নাম ধরে প্রশংসা করছে। গাড়িতে আগুন দিতে পারায় বীরত্বের গৌরবে লতিফ স্ফীত। নিয়ামতও লতিফের বোনাস প্রশংসায় করছেএরিমধ্যে মকু হাজির হতেই সকলের চোয়াল চুপসে গেল। কোন শব্দ বেরুচ্ছে না কারো মুখ হতে। নিয়ামত উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মকু এদিকে আসো। বসো এখানে। নিজেই কিছুটা সরে বসে। জোরে হাঁকে, এই মিজান এক কাপ চা দে কুইক। মকু ভাবে- বিষয়টা কী! এমন জামাই আদর নিয়ামত ভাইয়ের তরফ থেকে! ওরা কি তবে জেনে গেল সব। আজাদ ভাইয়ের সাথে আঁতাত, পিস্তলের খবর, পুলিশের তোয়াজ। নিশ্চল নীরবতা চলে কিছুক্ষণমকু চুপচাপ। ওরাও চুপচাপ। নিয়ামতই কথা বলে, মকু, মরারে নজরে রাইখো ভাই। এরিমধ্যে পকেটের মোবাইল বেজে ওঠে, মকু হাফ ছেড়ে বলে, আজাদ ভাইয়ের ফোন।  আড়ালে গিয়ে কথা বলে ফিরে আসে। নিজে থেকেই বলে- মিছিলে পুলিশি হামলা ও নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আগামী ১৩ তারিখে ফের মিছিলের ডেট ফেলেছে।
এতকাল নিয়ামতের কাছেই প্রথম সংবাদ আসত। তার বুঝতে বাকি নেই, মিছিলের খরচপাতি এখন মকুর হাতেই আসবে। বহুদিনের রোজগারে এভাবে ভাগরা বসাবে এই দুধের শিশু! কইয়ের তেলে কই ভাজছে লিডার! পলিটিক্সের এই খেলা ধরতে পারে নি নিয়ামত! নাক টিপলে দুধ বেরোবে যার, ওর কাছেই হেরে গেল! কিন্তু রা শব্দ করার জো নেই। পার্টির কমান্ড ফলো না করলে ছাঁটাই করে দেবে। ভিতরে ঠিকই কাঁচা পেট্রোল জমছে, সামান্য সুযোগ পেলেই দাউ করে জ্বলে উঠবে। আর সেই আশা দুরাশাই বলে মনে হচ্ছে। মকুর সাথে আপাত আপোষরফা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অযাচিত হাসি ফোটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাঁড়ির মতো মুখ করে খসখসে গলায় নিয়ামত বলে- মকু, এরা এবার তিনশো করে দাবি করছিন্। তুমি আজাদ ভাইকে বলে দেখো তো ভাই।

মকু ঘাড় নাড়ে। এর অর্থ কী ? সকলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিন্তু মকুকে কিছু বলবার সাহস পায় না।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে নানা কথা নিজেকেই জিজ্ঞেস করে মকু। নিয়ামত ভাইকে বাইপাস করে কেন ওকে ফোন করল আজাদ ভাই? সেইদিনের কথাগুলো মকু মিলিয়ে দেখে, পলিটিক্সের সিঁড়িতে যে যাকে ল্যাং মেরে পিছনে ফেলে সামনে এগোতে পারে। নিয়ামত ভাই কেমন তোয়াজ করে কথা বলেছে। তার চ্যাংড়াগুলোর মুখ কেমন পেঁচার মতো হয়েছিল! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মকু বাড়িতে ফেরে। মানুষের সাড়াশব্দ না পেয়ে চাপাকণ্ঠে ডাকে, মা, ঐ মা। পায়খানায় যেতে পারে ভেবে নিজের ঘরে ঢোকে। ঢুকেই আঁতকে ওঠে।

সদ্যপ্রসূত শিশুর মতো পিস্তলটাকে কোলে নিয়ে আদর করছে মা! ঠোঁটগুলোকে ছুঁচলো করে চুক চুক করে চুমু খাচ্ছে আর বলছে, সোনাবাবু আমার, ওরে লক্ষ্মী সোনারে! মকু ভাবে, জ্বরে মায়ের মাথা গেছে! পিস্তলটা টানতে গিয়ে বলে, মা, তুই পাগলি হইলি নাকি? এরমধ্যে গুলি আছে! নতুন পিস্তল!
আশ্চর্য হয়ে মকু লক্ষ্য করে, মার চোখ জলশূন্য! খটখটে!
মা তার ঝুলে পড়া থাকা দুইস্তনের ফাঁকে পিস্তলটাকে লুকিয়ে ফেলেছে। আড়াল করার জন্য আঁচল দিয়ে ঢেকে দুই হাতে চেপে ধরেছে। মকু মরিয়া হয়ে চিৎকার করে-মা, তুই পাগল অইলি নাকি
মা এবার লজ্জায় জমে আসে। ফিসফিস করে- যা, যা না এহান তেদেহিস না, সোনামণি দুধ খা! করুণ শীর্ণ স্তন দুটি টেনে এক সাথে জমিয়ে পিস্তলটাকে আরো আড়াল করার চেষ্টা করে।
প্রচণ্ড শক্তিতে কলিজা ফাটা চিৎকার দিয়ে ওঠে মকু-মা তুই মরবি! মরবি তুই মা! মরবি! মরবি!!




No comments:

Post a Comment