Monday 26 June 2017

গ্রন্থ আলোচনা

শেকল পরার কথকতা

           আলোচক- অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়



কালচে সবুজ মরা মরা আলোর মধ্যে পলেস্তারা খসা ফাটল ধরা দেওয়ালের একটা সাবেকি বাড়ি। একটা জানালা,  রঙিন কাচের ঘোমটা দেওয়া। বন্দিত্বের ছবি? মানুষের বেছে নেওয়া একাকিত্বের ঘেরাটোপ কি তার যেকোনো বসতখোপকেই জেলখানা করে তোলে?
"দিগ্বিদিক ছুটে যায়, যদিও কেন্দ্রে আসে ফিরে
 শুদ্ধিকরণ জাগে নিজস্ব জেলখানা ঘিরে"
মানুষের জীবনের নির্মমতম পরিহাস হল, সে সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ তাকে বদ্ধ করে, বিদ্ধও। যুথবদ্ধতা তাকে নিরাপত্তা দেয়, সমৃদ্ধি দেয়, আনন্দ কোলাহল দেয়। যা দিতে পারে না, তা হল নিজের পাশে দুদণ্ড চুপচাপ বসে থাকার অবসর। " পতিতোদ্ধারিণী নয়, সীমিত দীর্ঘশ্বাস পুষে রাখে যে গঙ্গা, তার কাছে। "।
কবি তাই নিভৃতির উপাসক। হ্যাঁ, কবিই। কবিতা তো কবির অনুমতি নিয়ে বা কোনোরকম প্রস্তুতির সুযোগ দিয়ে কবির ওপর ভর করেনা কখনো! কাজেই কবি প্রয়োজন মত কবিতার হাতটি মাথা থেকে নামিয়ে রাখতে পারবেন, এ আশাও বৃথা। তাই তরুণ কবিকে যদি বন্ধুস্থানীয় কারো কাছে শুনতে হয়, ' তোর গদ্যগ্রন্থের প্রত্যেকটা কবিতাই অসাধারণ ', তাহলে তা সংকোচ বা উপহাস তো নয়ই, বরং সার্থকতা।
" আমি সৃজন চাই না, ঘর চাই না, শুধু তোমার সঙ্গে চিৎকার করে পৃথিবীতে একটা সার্থক ভূমিকম্পের জন্ম দিতে চাই। আমাদের সেই সন্তান আমাদেরই বধ করুক তারপর।"
আত্মবীক্ষণ? নাকি স্রেফ ভেতরের আয়নায় চোখ রেখে একটা আটপৌরে জীবনকে পড়ে নিতে চাওয়া?  বাবার কিনে দেওয়া তীরধনুক নিয়ে বাড়ি ফেরার আগেই তীর হারিয়ে ফেলার শৈশব, আড়চোখে চাউনিকে পাশ কাটানোর কৈশোর পার হয়ে শেষমেশ বন্ধুকে মায়ের পায়ে, ঠোঁটের নীচে, কপালে ঘি মাখাতে দেখে হঠাৎ বড় হয়ে ওঠা। প্রবৃত্তি নয়, পরিস্থিতির হাত ধরে। "গ্যালোপিন ট্রেনজার্নি। স্টেশনের নামগুলো পড়া যায় না ঠিকঠাক। সামনের সিটের লোকটা উঠে গেলে মনে হয়, আমাকেও নামতে হবে।"। আয়না নয়, যেন সেই রঙিন কাচের জানালাটা। নানা রঙের দৃশ্য। টিউশনফেরত গলি, পুকুরপাড়, উইকেট, সাইকেল, প্রেমিকা, বেকারত্ব, সিগারেট, ঘুমের ওষুধ,  চুলে বিলি, চিতাভষ্ম... সাধারণ, কিন্তু নিতান্ত সামান্য থাকে না আর।
" এবং চমৎকৃত হই, সাধারণ একটা নৌকায় সাধারণ মাঝি কীভাবে অসাধারণের পরিপূরক হয়ে ওঠে।"
 ভেতরের আয়নায়, প্রতিবিম্বের শরীরে লগ্ন হয়ে থাকে বিষাদ।  " যেরকম পরীক্ষা শেষ হলেও আগুপিছু অনেক আফশোস আমাদের ঘিরে থাকে, একবার যদি ফেরত পাওয়া যেত খাতাটা..."। প্রতিযোগিতা, যার ঘরে একটাই ঘুলঘুলি বা যার কোনো প্রেমিক নেই ; ভাগ্য, যা অপকেন্দ্র বলের অপর নাম - এসব পেরিয়ে আসতে আসতে একদিন চোখে পড়ে, " মাঠগুলো অন্যের দখলে। যেরকম আমরাও কবে জীবনের দখলে চলে গেছি,  বুঝতেই পারিনি..."। তখন পিছু ফিরে তাকালেই গ্রাস করে অনুভব,  " অলক্ষ্যে কোনও এডিটর নেই। কয়েকটা ক্লিপ মুছে দেয়া বড্ড প্রয়োজন। "    
কয়েদির দিনলিপি? নাকি জীবনের মায়াময় তুচ্ছতায় বাঁধা পড়া প্রাণপাখীর শেকল পরার  কথকতা? তুচ্ছতা যতক্ষণ ব্যক্তিগত, ততক্ষণ তা গারদ তুলে রাখে চারপাশে। আর কলম যখন তুচ্ছতাদের সার্বজনীন করে তোলে, তখন গারদই আয়না হয়ে ওঠে।
"এসবই কল্পকথা, কিছুটা অতীত স্মরণীয়
 যদি তুচ্ছ ভালো লাগে, ঘটনা তোমার করে নিও"

গ্রন্থ : নিজস্ব জেলখানা ঘিরে
লেখক : তন্ময় ভট্টাচার্য
প্রকাশক : আঙ্গিক
প্রচ্ছদ ও নামাঙ্কন : আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
লেখকের আলোকচিত্র : সুপ্রিয় মিত্র


প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি  ২০১৭)

No comments:

Post a Comment